এম এইচ খান মঞ্জু : জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা দুনিয়ার অন্যতম জনবহুল নগরী। মেগাসিটি হিসেবে অভিহিত করা হয় বাংলাদেশের রাজধানীকে। কিন্তু জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে ঢাকা পেছনের কাতারের নগরগুলোর একটি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জরিপ প্রতিষ্ঠান মার্সারের ‘কোয়ালিটি অব লিভিং র্যাংকিং ২০১৬’ শীর্ষক সমীক্ষায় বিশ্বের ২৩০টি নগরীর বিবেচনায় জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে ঢাকাকে ২১৪তম নগরী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ তালিকায় বিশ্বসেরা নগরীর মর্যাদা পেয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। ভিয়েনার পরের অবস্থানগুলোতে আছে যথাক্রমে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ, নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড, জার্মানির মিউনিখ, কানাডার ভ্যাঙ্কুভার, জার্মানির ডুসেলডর্ফ ও ফ্রাঙ্কফুর্ট, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনি। জরিপ অনুয়ায়ী, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ইরাকের রাজধানী বাগদাদে সবচেয়ে কম, জীবনযাত্রার মানও সবচেয়ে কম। ফলে এ শহরটির অবস্থান ২৩০তম। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দিক থেকে ২২৯তম, তবে জীবনযাত্রার মানে ২২৪তম। দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থান শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর ১৩২তম। এর পরে রয়েছে ভারতের হায়দরাবাদ ১৩৯, পুনে ১৪৪, বেঙ্গালুরু ১৪৫, চেন্নাই ১৫০, মুম্বাই ১৫২, কলকাতা ১৬০ ও নয়াদিল্লি ১৬১তম। পাকিস্তানের ইসলামাবাদ ১৯৩, লাহোর ১৯৯ ও করাচি আছে ২০২তম অবস্থানে।
জরিপ প্রতিষ্ঠান মার্সার তার জরিপে ৩৯টি বিষয় সামনে রেখে বিশ্বের ৪৪০টি শহরের জীবনমানের তথ্য সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২৩০টি শহরকে নিয়ে মূল তালিকা তৈরি করা হয়। জরিপে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনশৃঙ্খলা, ব্যাংকিং সুবিধা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, ব্যক্তি স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, স্কুল ও শিক্ষা, গণপরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, গৃহায়ন ও আবাসন ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ মূল্যায়ন করা হয়। সে মূল্যায়নে বাংলাদেশের রাজধানী এক সময়ের সমস্যাসংকুল নগরী কলকাতার চেয়েও কয়েক ধাপ পিছিয়ে থাকা বিদ্যমান দৈন্যদশারই পরিচায়ক। করাচির মতো অনিরাপদ ও সমস্যাসংকুল নগরীও এগিয়ে রয়েছে ঢাকার চেয়ে। রাজধানীর উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার মান বাড়াতে ঢাকা মহানগরীকে ভেঙে দুই সিটি করপোরেশন তৈরি করা হলেও অশ্বডিম্ব প্রসবের চেয়ে বেশি কিছু যে অর্জন নেই জরিপে ঢাকার ২১৪তম অবস্থান তারই প্রমাণ। এ পীড়াদায়ক অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।
রাজধানী ঢাকার সঙ্কটের শেষ নেই। একটি সমস্যা অন্যটিকে ত্বরান্বিত করছে। আজ রাজধানীবাসী ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রথমেই যে সমস্যাটি প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো যানজট। যানজটে থমকে যাচ্ছে নগরী এবং মানুষের জীবন থেকে কেড়ে নিচ্ছে মূল্যবান সময়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ এবং অতিরিক্ত যানবাহন।
দ্বিতীয়ত রাজধানীবাসী অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন শহরে বিদ্যুৎ সমস্যা চরমে পৌঁছেছে। দিনে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। বিদ্যুতের অভাবে আজ শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে পেশাগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ছে। এরপর রয়েছে গ্যাসের সঙ্কট। গৃহিণীরা পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছে না। অনেক কলকারখানা গ্যাস না পাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে। ইদানীং শহরের বেশিরভাগ এলাকায়ই পানির তীব্র সঙ্কট। মানুষজন খাবারের পানির জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াচ্ছে, তবু অনেক সময় পানি মিলছে না এবং বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে পানির উত্তোলন হচ্ছে না। এ সমস্যাগুলোর আশু সমাধান প্রয়োজন।
নগরীতে ক্রমেই অপরাধ বাড়ছে। চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, যৌনব্যবসা, এসিড নিক্ষেপ, মাদক ব্যবসা প্রভৃতি অনেক বেড়েছে। ফলে শহরবাসী আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এছাড়াও নগরীতে বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমে যায় এবং পথচারীর প্রচ- কষ্ট হয়। তারপর রয়েছে মশার উপদ্রব। এখানেই শেষ নয়, প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, ২০টি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এর প্রধান কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনবহুলতা। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সরকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ৭ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে।
বাসস্থান মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি। রাজধানীর দেড় কোটি মানুষের মধ্যে সর্বাধিক ১০ লাখ মানুষ নিজেদের বাড়ি বা ফ্ল্যাটে বাস করে। বাদবাকি মানুষ বাস করে ভাড়া করা বাড়িতে। এই মহানগরীতে যে হারে বাড়িভাড়া বাড়ছে তাতে চাকরিজীবীদের বেতনের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়ি ভাড়ার অংশ তার চেয়েও বেশি। অন্যান্য পেশার লোকদেরও বাড়ি ভাড়ার অর্থ আয় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রাজধানীতে গত ৫ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে শতকরা ১০০ থেকে ১৫০ ভাগ। ওয়াসার দাবি অনুযায়ী তারা চাহিদার চেয়েও বেশি পানি উৎপাদনের কৃতিত্বের অধিকারী। এই কিম্ভূতকিমাকার কৃতিত্ব সম্পর্কে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা শুধু বলব চাহিদার চেয়ে বেশি পানি উৎপাদিত হলে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে পানির হাহাকার কেন? দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ ও নগরজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। রাজধানীতে গ্যাস সংকট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। পানি ও গ্যাস সংকটে সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে নগর জীবন। এ সংকটের জন্য চাহিদার তুলনায় সরবরাহের সীমাবদ্ধতা যেমন দায়ী তেমন দায়ী অবৈধ সংযোগের ঘটনা। এখন ফিরে আসি জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার এবং দুই ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। বেদখলকৃত খালগুলো উদ্ধারের উদ্যোগ নিতে হবে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ ঘটিয়ে দ্রুত পানি নিষ্কাষণ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : প্রিন্সিপাল, এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ গোপালগঞ্জ, সাবেক সংসদ সদস্য, গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন