শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

নারীর মর্যাদা ও মুক্তির দিশারী ইসলাম

| প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : নারীর প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা, আর্থিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নসহ নারী নির্যাতন রোধই ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের মুখ্য উদ্দেশ্যে। এ দিবসটি এমন একসময় পালিত হচ্ছে যখন নারী নির্যাতন বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। নারী দিবসকে সামনে রেখে গত ৫ মার্চ ঢাকার একটি দৈনিকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে কমছে না যৌন হয়রানি’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করে সর্বত্র হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছে। উচ্চশিক্ষার তীর্থস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু জ্ঞান বিতরণই হয় না, শিক্ষা নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি নানা বিষয়ের উদ্ভাবন হয়। সেখানে জ্ঞান বিতরণের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘যৌন হয়রানির’ মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকা ভয়াবহ নৈতিক স্খলনের শামিল। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা নানা কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরাও সম্মানের ভয়ে বিষয়টি গোপন রাখেন। ইতোপূর্বে জাতিসংঘের নারীবিষয়ক অধিসংস্থা ইউএনউইমেনের এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোয় ৭৬, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ এবং মেডিক্যাল কলেজে কোনো না কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয় ৫৪ শতাংশ ছাত্রী।
সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চ‚ড়ান্তভাবে চাকরি হারায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মো. সাহদাৎ হোসেন। অশ্লীল চিত্রের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার অভিযোগে ঢাবির উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক ড. মো. রিয়াজুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মাস দুয়েক আগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক এমরান হোসাইনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলামকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়। এর বাইরে অনেক প্রভাবশালী শিক্ষক একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও তাদের বিচার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সর্বশেষ শাস্তি পাওয়া প্রায় সব শিক্ষকই বর্তমান প্রশাসনের ভিন্নমতের অনুসারী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল হালিম প্রামাণিককে যৌন হয়রানির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই চিত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের নারীরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসা, উদ্যোক্তা, সাংবাদিকতা, এভারেস্ট জয়, খেলা, গার্মেন্টশিল্পসহ যুদ্ধ বিমান চালনাতেও একে একে নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা আর গ্রহণযোগতার প্রমাণ রেখে চলেছেন। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, সংসদের স্পিকার ও বিরোধী দলীয় নেতা নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ রয়েছে নারী প্রক্টরও। নারীকে মন্ত্রী বানালে, কোটা করে নারীকে এমপি, চেয়ারম্যান বা মেম্বর থাকলেও নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। রেডিও, টেলিভিশন, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও গণমাধ্যমে প্রচার করে বা কঠিন আইন করেও বিশেষ কিছুই হচ্ছে না। নারীর নিরাপত্তায় কাগজে-কলমে আইনি সুরক্ষা মজবুত হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণ, যৌতুকের দাবি, এসিড নিক্ষেপসহ নানা রকমের সহিংসতা দমনে রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতা ঘোচেনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা প্রকট হয়েছে।
জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে বিশ্ব অভ‚তপূর্ব উন্নতি সাধন করলেও এখনো কিছু কিছু নৈতিক ও মনস্তাত্তি¡ক সমস্যা মানব সমাজকে পীড়া দেয়। এর একটি হচ্ছে নারী নির্যাতন। আমরা সভ্যতার মুখোশ পরলেও প্রকৃত অর্থে সভ্য নই। যুগে যুগে নারীরা ছিল নির্যাতিত, অধিকারহারা, দাসী, বাঁদি, ভোগ্যপণ্য কিংবা মনোরঞ্জনের সামগ্রী। নারী কি মানুষ, না অন্য কোনো জীব- এটি নির্ণয় করাই ছিল বিস্ময়। রোমান সভ্যতার প্রাক্কালে নারীকে দাসী, গ্রিকদের কাছে বিকিকিনির পণ্য, খ্রিস্টানরা নারীকে শয়তানের প্রতিভ‚ মনে করত। ইসলাম-পূর্ব যুগের আরব দেশের নারীদের সব দুঃখ-কষ্টের কারণ বলে গণ্য করা হতো। আরব দেশে শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো।
প্রায় ১৫শ বছর আগে ইসলামে নারী ও পুরুষের অধিকার এবং নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীনতার ঘোষণা দিয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে নারীকে পুরুষের সমানাধিকার দান না করলেও তাকে তার যথার্থ অধিকার প্রদান করেছে। সুতরাং প্রত্যেকের নিজ নিজ অধিকার নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমরা আকাক্সক্ষা করো না এমন সব বিষয়ে, যাতে আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের একের উপর অপরের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। আর আল্লাহ্র কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা’আলা সর্ববিষয়ে জ্ঞাত’ (নিসা)।
জাহেলিয়াতের যুগে যখন কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করাই ছিল বাবার জন্য কলঙ্কজনক, তাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো তখন ইসলাম তার অধিকার দিয়েছে এবং এই নিষ্ঠুর প্রথার চরম নিন্দা করেছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন তাদেরকে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করার সুসংবাদ দেয়া হত তখন লজ্জায় তাদের চেহারা কালো হয়ে যেত। আর বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। তারা ভাবত লোকলজ্জা উপেক্ষা করে তারা কি তাদেরকে রেখে দিবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত মন্দ ছিলো তাদের এ মনোভাব’ (সূরা নাহল)।
বর্তমান সমাজে যৌতুক একটি মহামারি অভিশাপ হয়ে আছে। যৌতুকের আগুনে পুড়ে ছারখার হচ্ছে বহু নারীর জীবন, পরিবার, সন্তান ও সংসার। যৌতুকের এ প্রথা এসেছে হিন্দু ধর্ম থেকে। হিন্দু ধর্মমতে মেয়েরা বাবার ত্যাজ্য সম্পত্তিতে কোনো ধরনের অংশ পায় না। বিয়ের সময় যা উশুল করে নিতে পারে। এ জন্য কোন হিন্দু পরিবারে সামর্থ্য থাকুক কি-না থাকুক, মেয়েকে পাত্রস্থ করতে গেলে বা ছেলেকে বিবাহ করাতে গেলে যৌতুক দেয়া-নেয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। আজ এ প্রথা আমাদের মুসলিম সমাজেও সংক্রমিত হয়েছে। উত্তরাধিকারী ও মালিকানার ক্ষেত্রে আল কোরআনই সর্বপ্রথম নারীর অধিকার ঘোষণা দিয়েছে। প্রায় ১৫শ বছর আগে থেকেই ইসলাম নারীকে সম্পত্তির পূর্ণঅধিকার দিয়েছে। বিয়ের পর মোহরানা হলো স্ত্রীর অধিকার, কিন্তু আমাদের সমাজে অনেকেই তা আদায় করেন না। মনে করেন, মোহরানা না দিলেও চলে। আবার মনে করেন তালাক দিলেই মনে হয় মোহরানা দিতে হয়, অন্যথায় নয়। এসব চিন্তা একেবারেই ভুল। বরং মেলামেশার আগেই স্ত্রীকে মোহরানা পরিশোধ করতে হয়। তবে স্ত্রী মোহরানা পরিশোধে অবকাশ দিলে ভিন্ন কথা। আধুনিকতাবাদীরা বলে থাকেন, পাশ্চাত্যের ভগ্নিদের দ্বারা সর্বপ্রথম নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু হয়। যা মোটেই সত্য নয়। প্রকৃত নারীমুক্তি আন্দোলন শুরু হয়েছিল প্রায় ১৫শ বছর আগে মহানবী (সা.)-এর যুগে। ইসলামই নারীকে মর্যাদা ও সম্মানের আসনে আসীন করে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’
এখন নারীকে মডেল, ভোগ্যপণ্য কিংবা কলগার্ল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সমাজব্যবস্থায় নারীকে আজ শুধু পণ্য নয় ‘পণ্যের পণ্য’ করা হয়েছে নারী স্বাধীনতার নামে নারীকে আপনহারা-বাঁধনহারা করার প্রচেষ্টা চলছে। পুঁজিবাদীরা পণ্য বিক্রি ও ব্যবসায় জৌলস বৃদ্ধির জন্য নারীদের অনুগত পুতুল বানাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধনকে ধ্বংস করে দিয়ে তারা নারীদের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ক্রেতা আকৃষ্ট করার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলছে। নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়ে জাতিসংঘ কিংবা মানবাধিকার সনদের বহু আগে মানবতার ধর্ম ইসলাম নারী মুক্তির যে ঘোষণা দিয়েছে তা আধুনিক বিশ্বকে নতুন করে ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছে।
বিশেষত নারীকে পণ্য করে বাজারে তোলার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে এটাও নারী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপ, নারী ধর্ষণ, নারীর শ্লীতাহানির অন্যতম কারণ। দেখা যায় একটা টুথপেস্ট, গামছা বা লুঙ্গির বিজ্ঞাপনেও নারীকে খোলামেলাভাবে নাচানো হয়। পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীকে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে ব্যবহার, ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমে নারীকে যৌন আবেদনময়ী করে উপস্থাপন নারীর যৌন হয়রানিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
মাথার স্কার্ফ, ওড়না বা হিজাব নারীদের জন্য সম্মানের প্রতীক। ইসলামে শালীন পোশাক বা হিজাব নারীর মর্যাদাকে ক্ষুণœ করেনি। বরং এটা মুসলিম নারীর বিশ্বাস ও মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ। উপযুক্ত পোশাক বা হিজাব পরিধানের মাধ্যমে নারী লোলুপ পুরুষদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। পর্দা নারীর সৌন্দর্য এবং নারীর ইজ্জত সুরক্ষার ঢাল।
এখনকার উঠতি ছেলেমেয়েদের পোশাক হলো- প্যান্ট, ফতুয়া, নেটের জামা, টাইটস-সর্টস যা এমন টাইটফিট, আঁটসাঁট যাতে দেহের প্রতিটি অঙ্গের আকার, আকৃতি দেহের আকর্ষণীয় সৌষ্ঠব কাপড়ের উপরেও বুঝা যায়। যা কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক সুদৃঢ় ও মধুময় করার জন্যই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সমাজে ফিতনা ছড়ানোর জন্য নয়। পশ্চিমা সংস্কৃতি-সভ্যতায় নারীর বিন্দুমাত্র মর্যাদা নেই। সেখানে তো নারী নিছক ভোগের বস্তু। বিভিন্ন উপায়ে নারীকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে পুরুষের ভোগের চিতায় আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য। বারুদের নিকট আগুন রাখা হলে বিস্ফোরণ তো হতেই পারে। যেহেতু মানুষের মন স্বভাবতই কামপ্রবণ এবং অনিয়ন্ত্রিত-দুর্নিবার কামনা-বাসনা মানুষকে অন্ধ, বধির ও পশুতুল্য করে তোলে।
আজ শিক্ষাঙ্গনসহ শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে গোটা বিশ্ব যেন যৌন অপরাধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ইসলাম যাকে ‘যেনা’ বলে অভিহিত করেছে, ওরা তাকে ‘প্রেম-ভালোবাসা’ বলে উপভোগ করছে। ইউরোপ-আমেরিকার তথাকথিত সভ্যতা নামধারী বিভিন্ন দেশের স্কুলগুলোর ১৩ থেকে ১৬ বছরের শতকরা প্রায় ৪০ জনের মতো ছাত্রী গর্ভবতী হয়ে থাকে।
নারী নির্যাতনের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের লিঙ্গ সনাক্তকরণের পর বহু মেয়ে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে এই একবিংশ শতাব্দীতে এমন অসংখ্য মানুষ আছে, যারা গর্ভস্থ সন্তান মেয়ে হলে তাকে মায়ের পেটের মধ্যেই মেরে ফেলতেও কুণ্ঠিত হয় না। সাম্প্রতিককালে ভারতে এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়, যার কারণে ভারতের কোন কোন রাজ্যে নারী ও পুরুষের আনুপাতিক হারে সামঞ্জস্যহীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গর্ভধারিণী মায়ের অধিকার, কন্যা-জায়া-জননীর মর্যাদা ও মুক্তির দিশারী ইসলাম ধর্ম। এই পৃথিবীর মানবজীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই; যেখানে নারীদের মর্যাদার ব্যাপারে ইসলামের ন্যায়ানুগ ও বিবেচনাপ্রসূত নির্দেশনা অনুপস্থিত।
abunoman72@ymail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন