শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

বইমেলা : প্রতিবারই একই ভুল

প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফাহিম ফিরোজ : আগামীকাল শেষ হয়ে যাবে একুশের বইমেলা। থেমে যাবে মেলার উত্তেজনা। থেমে যাবে বইপ্রেমী মানুষের পদাচারণার শব্দ। এরপর বইমেলার ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা কম-বেশি চলতে থাকবে আরো কিছুদিন। বইমেলা নিয়ে প্রতিবার এরকমই হয়। একুশের বইমেলাকেন্দ্রিক নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই বইমেলার বহুরৈখিক বিষয় নিয়ে প্রতিবারই পত্র-পত্রিকা সরব হয়ে উঠে। মেলাকে যাতে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যায় এজন্য পত্র-পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রতিবারই কিছু পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু মেলা কর্তৃপক্ষ মনে হয় না এগুলোকে তেমন আমল দেয়। খুব বেশি নয়, গতবার মেলায় ঘটে যাওয়া একটি বিষয় নিয়েই বলি। ওই বছর মেলায় রোদেলা প্রকাশনীর ‘নবী মুহাম্মদের ২৩ বছর’ শীর্ষক গ্রন্থটি যখন আসে এবং জনরোষের মুখে পড়ে তখন বাংলা একাডেমির ডিজি এ লেখকের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সৃষ্টিকারী কোনো বই-ই মেলায় ঢুকতে পারবে না। এদের কাউকে স্টলও দেয়া হবে না। সেই ডিজি এখন নেই। একবছর পরই সেই পুরনো চিত্র আবার আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আবারও ইসলামধর্মবিরোধী বই মেলার স্টলে জায়গা পেল। পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল। প্রশ্ন হল, বাংলা একাডেমির নীতিমালায় এসব বিতর্কিত বই স্টলে রাখা যাবে, এরকম কোনো কথা আছে কি-না। যদি না থেকে থাকে তাহলে বিনা বাধায় এসব আপত্তিকর বই কিভাবে মেলা স্টলে ঠাঁই পায়? বইয়ের শিরোনাম পড়লেই তো বোঝা যায় এটি কোন শ্রেণীর বই। এ ধরনের বই যাতে মেলায় ঢুকতে না পারে সেজন্য মেলার ক’দিন আগে থেকেই বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। তাহলে দেখা যাবে, ওসব বই স্টলে ঢুকতে সাহস পাবে না। যতদূর জানা যায়, এসব আপত্তিকর বইয়ের লেখকরা (সবাই নয়) জনরোষে শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগ করেন এবং বিদেশে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
২.
প্রতি বইমেলায়ই মানসম্পন্ন বই নিয়ে পাঠকমহল থেকে প্রশ্ন উঠে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। ইতোমধ্যে প্রবীন গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ একুশেমেলায় মানসম্পন্ন বইয়ের বিষয়ে শক্ত বক্তব্য দিয়েছেন। অর্ধশিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিতরাই বেশির ভাগ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী। শুধুমাত্র টাকা পেলেই, পা-ুলিপি না পড়ে তারা বই প্রকাশ করেন। কেবল মনযোগ দেয়া হয় বইয়ের প্রচ্ছদের দিকে। প্রচ্ছদ সুন্দর হলে বই বিক্রি হবে এটা তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। হ্যাঁ, এভাবে বই বিক্রিও হয়। কিন্তু তাদের জানা নেই সব ক্রেতাই প্রচ্ছদের মোহে বই কেনে না। বিষয় এবং বইয়ের ভেতরটাও তারা যতটা পারেন উল্টে-পাল্টে দেখেন। মানহীন বই যাতে প্রকাশকরা বের না করতে পারেন সে বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে এবং একজন প্রকাশক হতে হলে কি কি গুণাবলী আবশ্যক নীতিমালায় এগুলো উল্লেখ থাকলে চট করে কেউ প্রকাশক হতে উৎসাহী হবে না। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিৎ। তা না হলে যাচ্ছেতাই ধরনের বইয়ের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে যাবে মানসম্পন্ন বই আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো জাতি।
৩.
একুশে বইমেলা দু’জায়গায় বিস্তৃত-সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমি চত্বরে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিমের রাস্তা ঘেঁষে বইমেলার স্টল বসালে হাঁটার যন্ত্রণা থেকে লেখক-পাঠক-প্রকাশক সবাই অনেক খানি স্বস্তি পেতেন। এখন সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে যেখানে মেলার স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, বাংলা একাডেমি থেকে তার দূরুত্ব একেবারে কম নয়। আশা করি, আগামীতে একাডেমি কর্তৃপক্ষ বিষয়টির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেবেন। এছাড়া এই উদ্যানটি চারশ বছরের অধিক পুরনো, যা শাহবাগের অন্তর্ভুক্ত। একাত্তরের স্বাধীনতার জ্বলন্ত স্মৃতিসহ জাতীয় তিন নেতার মাজার, মোঘল আমলে হাজী শাহবাজের মসজিদ এবং হাইকোর্ট রয়েছে। মেলা চলাকালীন এসব পবিত্র স্থান যাতে কোনো প্রকারে কলুষিত না হয় সে বিষয়েও একাডেমির নজর দিতে হবে।
৪.
প্রতিবারই একুশের বই মেলা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখা লেখি হয় এবং প্রকাশক সমিতি একাডেমি কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বইমেলা নিয়ে আয়োজক কর্তৃপক্ষ বাংলা একাডেমিকে ১২ দফার অভিযোগপত্র দিয়েছে প্রকাশনা সমিতি। এই অভিযোগপত্রে পাইরেটেড বই, ভারতীয় লেখকদের বই বেআইনিভাবে বিক্রি ও অপ্রকাশক বিভিন্ন এনজিওকে স্টল বরাদ্দ দেয়া, মেলার মধ্যে আলোর অভাব, পানির অব্যবস্থা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশকদের অভিযোগ সত্য। এসব অভিযোগের সুরাহা ভবিষ্যতে হবে কিনা, কেউ বলতে পারে না।
৫.
পাঁচমিশালী বাংলা ভাষা নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে কম-বেশি লেখা লেখি হচ্ছে। বাংলার মধ্যে ইংরেজির অনুপ্রবেশটা বেশ লক্ষণীয়। এটা ব্যাপকভাবে হয়েছে কোলকাতায়। ক্রমাগত হিন্দি সিরিয়াল এবং ভারতীয় বই পড়তে পড়তে আমাদের নিত্য ব্যবহৃত বাংলার মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত ইংরেজি শব্দও ঢুকে যাচ্ছে। এ প্রবণতা শিক্ষিত পরিবারগুলোতেই বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে, এদের সন্তানরা ক’জন বাংলা মিডিয়ামে পড়ে? ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলাও মুশকিল। ফলে ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলতে হয়। শুনতে লাগে বেমানান। এ সমস্যা দূর করতে সচেতন সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দেখা যায়, বাংলিশ নিয়ে যারা বেশি প্রতিবাদী তাদের সন্তানরাই বাংলিশে মশগুল। তাই বিনয়ের সঙ্গে বলছি, শিক্ষিতজনরা, আপনারা আগে তাদের ঘরের দিকে দৃষ্টি দিন।
সত্য হচ্ছে, আমরা যা বলি তা লিখি না, যা লিখি তা বলি না। মনে পড়ে কবি আল মাহমুদ সাহিত্যের একটি জটিল বিষয়ে হাসতে হাসতে আড্ডাচ্ছলে একবার একটি মন্তব্য করে বলেছিলেন, এদেশে যারা বড় কবি বলে নিজেদের দাবি করে এরা সারারাত কাউকে কল্পনা করে আর সকালে লেখে ‘তোমার গোলাপ ফুল ঘ্রাণ ছড়ালো দীর্ঘক্ষণ’। এ কেউ পড়বে? এ কবিতায় নারীর অমূল্য সৌন্দর্যের কোনো উল্লেখ নেই, প্রেম নেই। চিরন্তন সত্যকে আড়াল করে রচিত এসব মিথ্যা কবিতা কখনো সাহিত্যে টিকবে না। বিশ্বসাহিত্য এসব থেকে মুক্ত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন