কে এস সিদ্দিকী : কোরআন শরিফে হজরত মূসা (আ.) ও হজরত খিজির (আ.)-এর সাক্ষাতের ঘটনার বিবরণ রয়েছে। বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থ তথা বোখারী, মুসলিম, নাসায়ী এবং তিরমিজিতে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। হজরত ওবাই ইবনে কাব এবং হজরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর এই হাদিস বর্ণিত যে, রাসূূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মূসা (আ.) বনি ইসরাইলের সামনে খুতবা প্রদানের জন্য দাঁড়ান। তখন তাকে প্রশ্ন করা হয় যে, লোকদের মধ্যে সব চেয়ে বড় আলেম কে? হজরত মূসা (আ.) জবাবে বলেন যে, আমি সর্বাধিক বড় আলেম। তার এ জবাবে আল্লাহতায়ালা অসন্তুষ্ট হন। হজরত মূসা (আ.)-এর নিকট ওহী নাজেল হয় যে, আমার এক বান্দা ‘মাজমাউল বাহবাঈনে’ থাকে, সে তোমার চেয়েও বড় আলেম।
একটি বর্ণনা এভাবে আছে যে, হজরত মূসা (আ.)-এর নিকট প্রশ্ন করা হয় যে, আপনি কি জানেন, সবচেয়ে বড় আলেম কে? হজরত মূসা (আ.) তার অজ্ঞতা প্রকাশ করেন, তখন আল্লাহতায়ালা ওহীর মাধ্যমে মূসা (আ.)-কে জানান যে, আমার বান্দা খিজির (আ.) সবচেয়ে বড় আলেম। হজরত মূসা (আ.) জানতে চান যে, তার সাথে কীভাবে এবং কোথায় সাক্ষাৎ হতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমার খাদ্যের থলিতে একটি মাছ রাখো, তা যেখান থেকে গায়েব হয়ে যাবে, সেখানে খিজিরের সাক্ষাৎ পাবে। তাই তিনি নির্দেশ অনুযায়ী খাদ্যের থলিতে মাছ নিয়ে রওয়ানা হয়ে পড়েন এবং তার সহযাত্রী হন ইউশা (আ.)।
তারা একখানা পাথরের পৌঁছান এবং তাতে মস্তক রেখে উভয়ে শুয়ে পড়েন। মাছটি থলে থেকে বের হয়ে সাগরের দিকে পাড়ি জমায়। দৃশ্যটি হজরত ইউশা (আ.) প্রত্যক্ষ করেন, কিন্তু মাছটির এ বিস্ময়কর গতিবিধি হজরত মূসা (আ.)-কে জানাতে পারেননি। কেননা, যে সময় মাছটি সাগরের পথ ধরে চলছিল সে সময় হজরত মূসা (আ.) এবাদতে নিমগ্ন ছিলেন এবং এরপর হজরত ইউশা ঘটনাটি ভুলে যান। অতঃপর তারা দুজনই আবার সফর শুরু করেন হঠাৎ হজরত মূসা (আ.)-এর ক্লান্তি অনুভ‚ত হতে লাগল। তিনি সঙ্গী হজরত ইউশাকে বললেন, আমাদের নাস্তা বের কর, এ সফরে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তখন হজরত ইউশা বললেন, বিস্ময়ের কথা যে, আমি আপনাকে মাছের ঘটনাটি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম এবং মাছটি তো তখনই অদৃশ্য হয়ে যায়, যখন আমরা পাথরের নিকট শুয়ে পড়েছিলাম। এ কথা শুনে হজরত মূসা (আ.) বললেন, এটাই তো সে স্থান আমরা যার সন্ধান করছি। সুতরাং তারা দুজন নিজেদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে সে স্থানে প্রত্যাবর্তন করেন এবং যখন পাথরখানার নিকটবর্তী হন, তখন সেখানে চাদর ঢেকে শায়িত এক বৃদ্ধকে দেখতে পান। হজরত মূসা (আ.) তাকে সালাম জানান এবং নিজের পরিচয় দেন, আমি মূসা। হজরত খিজির (আ.) জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি বনি ইসরাইলের মূসা? জবাবে তিনি বলেন, জি। আমি ইসরাইলের নবী মূসা। অতঃপর মূসা (আ.) জিজ্ঞাসা করেন, আমি কি আপনার সাথে থাকতে পারি? যেন আপনি আমাকে সে ‘ইলম’ শিক্ষা দেন, যা আপনাকে আল্লাহর পক্ষ হতে শেখানো হয়েছে। হজরত খিজির (আ.) জবাবে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে থেকে আমার কার্যকলাপগুলো দেখে ছবর (ধৈর্যধারণ) করতে পারবেন না। হজরত মূসা (আ.) বললেন, আপনি আমাকে ইনশাল্লাহ ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি কোনো ব্যাপারে আপনার অবাধ্য থাকব না।
এ কথাবার্তা ও অঙ্গীকারের পর তারা উভয়ে সমুদ্রের ধরে ধরে চলতে থাকেন। চলার পথে তারা একটি নৌকা দেখেন এবং তারা নৌযান পরিচালকদের সাথে তাতে আরোহণের কথাবার্তা চালান। নৌযান চালকরা হজরত খিজির (আ.)-কে চিনে ফেলেন এবং ভাড়া ছাড়াই তাদের নৌকায় তুলে নেন। কিছুক্ষণ পর একটি চিড়িয়া (পাখি) নৌকার ধারে (কিনারে) এসে বসে পড়ে এবং পাখিটি পানি পান করার জন্য সমুদ্রে একটি বা দুটি ঠোঁটে চুমুক সারে। হজরত খিজির (আ.) বললেন, হে মূসা! আমার ও আপনার ইলম (জ্ঞান) আল্লাহতায়ালা তার ইলম হতে কেবল এ পরিমাণ কম করেছে, যতটুকু এ পাখিটি সমুদ্র হতে পানি কম করেছে। অতঃপর হজরত খিজির (আ.) নৌকাটির একাংশ উপড়ে ফেলেন। এতে হজরত মূসা (আ.) বিস্মিত হয়ে বললেন, ওই নৌকা চালকরা আমাদের ভাড়া ছাড়াই নৌকায় উঠিয়েছে এবং আপনি তাদের নৌকাটাই ছিদ্র করে দিলেন, তারা তো ডুবে যাবে! হজরত খিজির (আ.) বললেন, আমি তো আগেই বলেছিলাম যে, আপনি আমার সঙ্গে থেকে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। হজরত মূসা (আ.) বললেন, আমার স্মরণ ছিল না। আমার ত্রæটি আপনি ক্ষমা করে দিন এবং এ ব্যাপারে আমাকে অধিক কষ্ট দেবেন না।
শর্তের প্রথম বিরুদ্ধাচরণ মূসা (আ.)-এর পক্ষ হতে ভুলবশত হয়েছে। অতঃপর তারা দুজনই নৌকা হতে অবতরণ করে চলতে থাকেন। এক স্থানে দেখতে পান যে, একটি ছেলে বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলায় ব্যস্ত। হজরত খিজির (আ.) ওই ছেলেটির মস্তক ওপর হতে বিচ্ছিন্ন করে দেন। হজরত মূসা (আ.) বিচলিত হয়ে বলতে লাগলেন, আপনি একটি নিরপরাধ প্রাণ হরণ করলেন এবং তাও কোনো কারণ ছাড়া, আপনার এটি বড় অন্যায় কাজ হয়েছে। হজরত খিজির (আ.) বললেন, আমি প্রথমেই বলেছিলাম আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। অতঃপর দুজনই আবার সামনে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং একটি জনপদে পৌঁছন। সেখানকার লোকদের কাছে খাবার চান। কিন্তু গ্রামবাসী তাদের মেহমানদারি করতে অস্বীকৃতি জানায়। ওই জনপদে চলার সময় তারা একটি এমন প্রাচীর দেখতে পান, যাতে কোনো মুহূর্তে তা ভেঙে যেতে পারে। হজরত খিজির (আ.) তা স্বহস্তে সোজা করে দেন। হজরত মূসা (আ.) বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে তো এ কাজের বিনিময়ে কিছু পারিশ্রমিক নিতে পারতেন। হজরত খিজির (আ.) বললেন, এটি আপনার ও আমার মধ্যে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়। এখন আমি ওই কাজগুলোর আসল রহস্য বলে দিতে চাই, যেগুলো দেখে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারলেন না। রাসূলূল্লাহ (সা.) বলেন, আমার ভাই মুসা (আ.)-এর প্রতি আল্লাহ রহম করুন, তিনি যদি ধৈর্যধারণ করতেন, আল্লাহই সব রহস্য বলে দিতেন (হায়াতুল হায়ওয়ান)। কোরআনে সূরা কাহফে হজরত মূসা (আ.) ও হজরত খিজির (আ.)-এর ঘটনার পূর্ণ বিবরণ রয়েছে এবং হজরত খিজির (আ.) কর্তৃক যে তিনটি রহস্যজনক ঘটনা সংঘটিত হয়, সেগুলোর রহস্যাবলীও খিজির (আ.) মূসা (আ.)-এর বিদায়কালে বলেন। তফসির ও আম্বিয়া চরিত গ্রন্থগুলোতে মূসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর এ বিস্ময়কর ঘটনার নানাদিক তুলে ধরা হয়েছে এবং খিজির (আ:) এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে নানা তথ্য ও মতের উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি নবী ছিলেন, নাকি আল্লাহর অলী ছিলেন, এ নিয়েও মতভেদ রয়েছে। তিনি নবী ছিলেন বলে কেউ কেউ দৃঢ়মত ব্যক্ত করেছেন। তার নাম ও বংশ সম্বন্ধেও যথেষ্ট মতবিরোধ বিদ্যমান। অনুরূপভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন, দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন অথবা এখনো জীবিত আছেন, এসব নানা প্রশ্ন ও মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু তার সম্পর্কে নানামত ও জল্পনা-কল্পনা যেমন রয়েছে, কৌত‚হলোদ্দীপ্ত বিষয়ও রয়েছে। হজরত খিজির (আ.)-এর নাম ‘ইলিয়া’ বলেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে এবং বলা হয় তিনি হজরত নূহ (আ.)-এর পুত্র ‘সাম’-এর বংশধর। তিনি যেখানে বসতেন সে স্থান সবুজ আকার ধারণ করত এবং খিজিরের অর্থও সবুজ। তার পিতা মালকান হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি হজরত ইউসুফ (আ.)-এর বংশধর এবং বংশ তালিকা নিম্নরূপ :
খিজির ইবনে মিশা ইবনে ইবরাহীম ইবনে ইউসুফ (আ.)। কারো কারো মতে, তিনি সেকান্দার জুলকার নাইননের খালাতো ভাই এবং সৈন্যবাহিনীর প্রধান ছিলেন। তার বংশ সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। তার সম্পর্কে বহু অদ্ভুত ও বিস্ময়কর কাহিনী প্রচলিত আছে।
(আগামীবারে সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন