ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
[পূর্ব প্রকাশের পর]
ইসলামী দন্ডবিধির শাস্তিগুলো দৃশ্যত অনেক কঠোর মনে হলেও প্রয়োগ করার শর্তাবলী অনেক জটিল। উদাহরণস্বরূপ চুরির ক্ষেত্রে আগে নিশ্চিত হতে হবে, কেউ অভাবের তাড়নায় চুরি করেছে কিনা? অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ও শাস্তি কার্যকর করার পর দন্ডিত ব্যক্তির ছেলেমেয়ে ও পরিবার-পরিজনের জীবিকা নির্বাহ ও পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে হবে। নচেৎ এক চোরের হাত কেটে অনেক চোরকে সমাজে ছেড়ে দেয়া বা ভিক্ষার জন্য পথে বসিয়ে দেয়ার নামান্তর হবে। এ কাজ প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থা ও সরকারের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করা ছাড়া সম্ভবপর নয়। এ জন্য এখানকার আলেম সমাজ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থার বাইরে চুরির কোরআন নির্দেশিত শাস্তি প্রয়োগের কথা বলেন না। ব্যভিচারের শাস্তির বেলায়ও দোষী ব্যক্তিদ্বয়কে চারজন লোক একত্রে চাক্ষুষ দেখা ও আদালতে এসে সাক্ষ্য দেয়ার শর্ত জড়িত, যা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব। আসলে মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখাই আল্লাহর উদ্দেশ্য। আপন বান্দাদের শাস্তি দেয়া আল্লাহর উদ্দেশ্য হতে পারে না। এই দন্ডবিধির বাইরে যত প্রকার শাস্তি হতে পারে তা কোরআন-হাদিস ও ফিকাহশাস্ত্রকে সামনে রেখে সংসদে বা বিচার বিভাগীয় আইনের মাধ্যমে নির্ধারণ করা যাবে।
আমার বিশ্বাস, এভাবে কাক্সিক্ষত ইসলামী বিচার ব্যবস্থার লক্ষ অর্জন করা যাবে এবং জনগণের মনে ইসলামী বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে বিদ্বেষীদের সৃষ্ট ভীতি দূর হয়ে যাবে। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় মুসলিম পারিবারিক আইন ও উত্তরাধিকার স্বত্ব আইনের যে বিধানাবলী চালু রয়েছে সেগুলোও উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং বিচার বিভাগে সামান্য সংস্কার করলেই তাকে পূর্ণ ইসলামী বিচার ব্যবস্থার আদলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। কাজেই একে গ্রিক আইন থেকে উৎসারিত দেবির আশীর্বাদপুষ্ট বলে প্রচার করার কোনো সুযোগ নেই। একজন গবেষক তো প্রমাণ করেছেন যে, আদালতে শুনানির সময় উকিলগণ যে গাউন পরেন এবং শপথ নেয়ার সময় বিচারপতিগণ মাথায় যে টুপি পরেন, তাও ইসলামী ঐতিহ্যের স্মারক। বিচারকের ঝুলানো টুপি ইসলামী আমলের পাগড়ির বৃটিশ সংস্করণ এবং উকিলদের গাউন জুমার খুতবার সময় খতিবের পাতলা আচকনের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়।
আমাদের ধারণা, দেশ থেকে ইসলামী ঐতিহ্য চেতনা মুছে দেয়ার দূরভিসন্ধি নিয়ে হাই কোর্টের মাজার সংলগ্ন স্থানে গ্রিক দেবির মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। আমরা হাজার বছরের বাঙালি বলে গর্ব করি, এই হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ইসলামের ঐতিহ্য ও পীর আউলিয়াদের সাধনা ছাড়া আর কি পাওয়া যায় ইতিহাসের ছাত্রদের খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানাই। তখন মূর্তিপূজার আবরণে সাধারণ মানুষকে ক্ষমতাসীনরা নিজের দাস বানিয়ে রাখার যে বর্ণবাদী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল, ওলী-দরবেশগণ তার নাগপাশ থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক হলো, বৃটিশরা মুসলিম সমাজকে পরাজিত, পদানত, অভাব-অনটনে জর্জরিত ও জ্ঞানচর্চা থেকে বঞ্চিত রাখে প্রায় দুইশ বছর। এর ফাঁকে ১৮৩৭ সালে ফারসির স্থলে ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করার কারণে আমরা নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে সম্পূূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। যদি আমাদের দেশে ঐতিহাসিক মসজিদসমূহ ও পীর-আউলিয়াদের কবরগুলো সংরক্ষিত না থাকত তাহলে বোধহয় আমরা এখানে ইসলামী ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাক্ষ্য হওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পেতাম না। দেখা যায়, মসজিদ ও মাজারের শিলালিপি খুঁজে বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়েছেন মরহুম ড. আবদুল করিম। হাই কোর্টের মাজারে শায়িত শেখ শরফুদ্দীন চিশতির মতো আরেকজন বুজুর্গ শায়িত আছেন ডিআইটি দালানের পাশে দিলকুশা মসজিদের পাশে। তার নাম হযরত নিয়ামতুল্লাহ বুতশেকান (র)। ফারসি ভাষায় বুত মানে মূর্তি, প্রতীমা আর শেকান মানে যিনি ভাঙেন। শাহ নেয়ামতুল্লাহ এই ভূখন্ডে তাওহীদের বাণী প্রচার করতে গিয়ে কীভাবে মূর্তিনাশী নামে ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন করলেন তা গবেষণার বিষয়। হাই কোর্টের পাশে শায়িত শাহ শরফুদ্দিন চিশতিও একই ধারার আল্লাহর ওলী। তার মাজারের কাছে কীভাবে একটি গ্রিক দেবির মূর্তি স্থাপিত হতে পারল, আমরা এদেশের আদালতের কাছে তা জানতে চাই।
কয়েকজন নাস্তিক বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে মূর্তির পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। তারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ^াস ও চেতনার বিরুদ্ধে মূর্তি সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানোর জন্যে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল। তারা কথায় কথায় অসাম্প্রদায়িকতার চেতনার কথা বলেন। এ দেশে জেলে আছে, তাঁতি আছে, মুসলমান আছে, হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী আছে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীই একেকটি সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। তাহলে কি তারা সবাইকে স্বতন্ত্র পরিচিতির কথা ভুলে যেতে বলেন? একমাত্র জ্ঞানপাপীরাই এমন অযৌক্তিক আবদার করতে পারেন। তাছাড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের ওপর আঘাত হেনে জাতীয় ঈদগাহের সমান্তরালে মূর্তি স্থাপন করে তারা কোন ধরনের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বানাতে চান, আমাদের জানার অধিকার অবশ্যই আছে। মুক্তিযুদ্ধ তো কেবল তারা করেননি; পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেন, সারা দেশের প্রায় সব বীর মুক্তিযোদ্ধা পাঁচওয়াক্ত নামাজি। দেশের আনাচে-কানাচে তারা বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন ও পরিচালনা করছেন। তাদের তুলনায় এসব টকেটিভ নাস্তিক মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন।
ইতোপূর্বে একাধিক বিবৃতির মাধ্যমে আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি যে, জাতীয় ঈদগাহের সমান্তরালে যে মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে তা সামনে নিয়ে মুসল্লিরা ঈদের নামাজ পড়বেন না। ইতোপূর্বে এয়ারপোর্টের সামনের সড়ক দ্বীপে লালনমূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। চারদিকে প্রতিবাদ শুরু হলে সে মূর্তি অপসারণ করা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছিলেন : হজে যাওয়ার সময় মূর্তি দেখে যেতে হবে, এ জন্যে লালনমূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। এখন তো হজের চেয়েও স্পর্শকাতর বিষয়। ঈদের নামাজের লাখ লাখ মুসল্লির তাওহীদি চেতনাকে পরীক্ষার সম্মুখীন করার জন্যই কি গ্রিক দেবিকে সরানো হচ্ছে না? বলা হয়, আওয়ামী লীগের ইচ্ছার বাইরে এ দেশে কিছুই হতে পারবে না। তার মানে কি সুপ্রিম কোর্টের সামনের বিতর্কিত মূর্তির দায় আপনারা নিতে চাচ্ছেন? আমরা তো জানি, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নবীন নেতাদের অনেকেই ধর্মীয় ঐতিহ্যের পারিবারিক আবহে বড় হয়েছেন। আপনারা কেন চুপ থাকবেন এবং গুটিকতক নাস্তিকের দায় মাথায় নিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনকে কালিমালিপ্ত করবেন? শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আস্ফালন যদি শুরুতে স্তব্দ করা হতো তাহলে শাপলা চত্বরের ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হতো না। এখনো কি সে ধরনের কোনো পরিস্থিতির দিকে জাতিকে ঠেলে দেয়া বিজ্ঞতার পরিচায়ক হবে? মনে রাখবেন, সুপ্রিম কোর্টের সামনে মূর্তি স্থাপন দেশের কপালে মূর্তির তিলক এঁটে দেয়ার সমান। সামনে রমজান ও ঈদ আসার আগেই যদি তা অপসারণ করা না হয়, তাহলে এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র নয়, যে অবস্থায় মানুষ কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় করবে না।
রচনা : ০৬-০৩-২০১৭
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন