মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : বখাটেদের দৌরাত্ম্য কিছুতেই থামছে না। দিন দিন বেড়েই চলেছে তাদের নিষ্ঠুর নির্মমতা। সমাজ বা রাষ্ট্রের এই কদার্য চেহারা ভাবিয়ে তুলছে সকলকে। নিষ্ঠুরতার যেন শেষ নেই। ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা ছড়িয়ে পড়ছে উদ্বেগজনকহারে। পাঁচ বছরের শিশুর দেহ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে যৌন সন্ত্রাসে। প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় রাস্তায় জনসম্মুখে চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য এখন আর কাউকে আলোড়িত করে না। সমাজ, রাষ্ট্র এবং মানবিকতার পচনের চিত্র নিত্যনতুন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। দেশে বখাটেদের দৌরাত্ম্য আগেও ছিল এবং ভবিষ্যতেও হয়তো তা পরিপূর্ণভাবে দূর করা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে এগুলো ভংয়কর রূপে বাড়ছে। একে মানবিকতার বিপর্য ছাড়া আর কি বলা যায়? এদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সামাজিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বখাটে ছেলেরা মনে করে জোর করেই যে কোন মেয়েকে বিয়ে করা যায় এবং তা না পারলে চাপাতি দিয়ে জীবন শেষ করে দেওয়া যায়। যে কারণে প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলেই একশ্রেণির দুশ্চরিত্র স্কুল-কলেজের ছাত্রীকে কুপিয়ে কখনো জখম, কখনো হত্যা করছে। বখাটেদের নির্মমতার শিকার শুধু যে একজন তরুণী তা কিন্তু নয়! প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে তরুণীদের বাবা, মা, ভাইবোনকে কুপিয়ে জখম করা হচ্ছে। সিলেটের বহুল আলোচিত কলেজছাত্রী খাদিজাকে ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের কোপানোর দৃশ্য যারা দেখেছেন তাদের মতে, খাদিজার বেঁচে থাকাটা অলৌকিক ঘটনা। মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ দয়ায় খাদিজা বেঁচে আছেন। দেশের আনাচেকানাচে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, খাদিজার মতো অনেকে নির্মমতার শিকার হয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্কুলছাত্রী কণিকা ঘোষ, কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু, ঢাকার সুরাইয়া আক্তার রিসা ও মাদারীপুরের নিতু মন্ডলের কথা নিশ্চয় আমরা ভুলে যায়নি। একের পর এক তনু, রিশো, খাদিজার সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এরপর কে? এই অন্ধকার সময়ের শেষ বা কোথায়? আর কত নির্মমতা দেখতে হবে? কবে আসবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা? নাকি কোনোদিনই আর দেখা মিলবে না সেই আলোর। এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর আজ অজানা।
বখাটেদের কারণে অনেক পরিবার তাদের কন্যাদের পড়ালেখা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে বিয়ে দিয়েও বখাটেদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না অনেক মা-বাবা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার চিত্র তুলে ধরা হলো। গত ২৪ আগস্ট কাকরাইলে প্রকাশ্য দিবালোকে জনাকীর্ণ সড়কের ওভারব্রিজে বখাটের ছুরিকাঘাতে আহত হয় সুরাইয়া আক্তার রিশা। সে রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারদিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ঘাতক ওবায়দুল তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। গত ২ নভেম্বর রাতে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার মাচাইন গ্রামে বখাটে সুমন মিয়ার হাতে খুন হয় বিল্লাল হোসেন। সুমন বিল্লাল হোসেনের দশম শ্রেণি পড়–য়া মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু সাড়া না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে খুন করে বিল্লালকে। গত বছর ২ নভেম্বর ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরে এক বখাটের ছুরিকাঘাতে পোশাক শ্রমিক কল্পনা খাতুন খুন হয়। ছুরিকাঘাতকারী লেন্টু মোল্লাকে জনতা পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে । মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার আইসারকান্দি গ্রামের মিলন মন্ডল গত ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে নবগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী নিতুকে হত্যা করে। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করাতেই অকালে জীবন দিতে হয় নিতুকে। মিজান নামে এক বখাটের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় গত ৩ জুলাই ভোলার চরফ্যাসনে বাবাকে কুপিয়ে মাদরাসা ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। গত ৫ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার কোনাখালী হেদায়াতুল উলুম দাখিল মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী বিলকিছকে কুপিয়ে জখম করে বখাটে মিনহাজ উদ্দিন। গত ১৮ অক্টোবর মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে দুর্বৃত্তদের অস্ত্রের আঘাতে আহত হয় তাহমিনা আক্তার আঁখি নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী। গত বছর ২৫ আগস্ট মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী বালিগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী সাদিয়া আক্তার ও মুক্তাকে কুপিয়ে আহত করে কয়েক বখাটে প্রতিবেশী। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মুন্নি আক্তার স্থানীয় মিটাছড়া উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। স্কুলে যাতায়াতের সময় বখাটে মোজাম্মেল হোসেন তাকে উত্ত্যক্ত করতো। সে কারণে মুন্নির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বখাটে মোজাম্মেলের লালসার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মুন্নিকে বিয়ে দেয় তার পরিবার। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি মুন্নির। বখাটে মোজাম্মেল চায়নিজ কুড়াল দিয়ে মুন্নিকে কোপায়। প্রথমে তাকে স্থানীয় থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা শেষে ৪ নভেম্বর সাভারের সিআরপিতে ভর্তি করা হয়। ডাক্তারদের মতে, মুন্নি কখনো আর স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারবে না। সারা জীবন হুইল চেয়ারে থাকতে হবে তাকে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ার আদর্শ দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী নাহিদা আক্তারকে কুপিয়ে আহত করে বখাটে জাহেদুল ইসলাম। গত ১৫ জানুয়ারি জকিগঞ্জ উপজেলার রসুলপুর গ্রামের ইচ্ছামতি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী ঝুমা বেগমকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে আহত করে একই কলেজের শিক্ষার্থী বাহার উদ্দিন। ঝুমাকে বাঁচাতে তার মা এগিয়ে এলে ঘাতক তাকেও কুপিয়ে আহত করে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কথিত বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এক নার্সকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে আতাউর নামে এক বখাটে। এরকম হাজারো ঘটনা একের পর এক লাগামহীনভাবে ঘটে চলেছে যা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না।
এগুলো কেন হচ্ছে তার মূল কারণগুলো আমাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এর অনেক কারণ রয়েছে-কিছু বড়, কিছু ছোট। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, আকাশ সংস্কৃতির সয়লাব। আকাশ সংস্কৃতি পারমাণবিক বোমার চেয়ে শক্তিশালী ভ‚মিকা পালন করছে। এর মাধ্যমে মারাত্মক ধরনের অশ্লীলতা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সমাজ বা রাষ্ট্রের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে বখাটেদের হাত থেকে নারীদের রক্ষা করার প্রয়াসে। শুধু আইন করে মানুষের চরিত্র সংশোধন করা যদি সম্ভব হতো তাহলে সমাজে এত বিশৃঙ্খলা বিরাজ করতো না। মানুষের মানবিকতার উন্নয়নের জন্য আইনের পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি জোর তাগিদ দিতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে । নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি বিষাক্ত, দাহ্য বা দেহের ক্ষয়সাধনকারী কোনো বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটায়, তবে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করার বিধান রয়েছে। এ আইনে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণের শাস্তিস্বরূপ অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। তবে ধর্ষণের কারণে যদি কোনো নারী কিংবা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তবে সেক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড। গণধর্ষণের কারণে কোনো নারী কিংবা শিশুর মৃত্যু হলে অপরাধীদের মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। এ আইনে ধর্ষণের মাধ্যমে কোনো নারী বা শিশুকে হত্যা কিংবা তার শারীরিক ক্ষতি সাধনের প্রচেষ্টা চালানোর শাস্তিও হচ্ছে মৃত্যুদন্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড। নারীর নিরাপত্তার জন্য বিদ্যমান আইন থাকা সত্তে¡ও নারীর নিরাপত্তা হুমকির মুখে।
সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা, যা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। তারপরেও আশার আলো জাগিয়েছে সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালত আসামি ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। রায়টি এমন দিনে দেয়া হয়েছে যেদিন বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। ওই রায়ে বিচারক মন্তব্য করেন যে, এই রায়টি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ঘোষিত হলো। ফলে এই রায় নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে। খাদিজা হত্যাচেষ্টার মামলার রায় জনগণের মাঝে প্রশংসিত হয়েছে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে আদালত একটি বার্তা পৌঁছে দিল যে, যারা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করবে তাদের জন্য কোনো অনুকম্পা নয়।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক হিসাব অনুযায়ী গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত, সারাদেশে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১৪৮ জন। এরমধ্যে ইভটিজিংয়ের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৫৭ জন আহত হয়েছে। একশ্রেণির নারীবাদী নেত্রী আছেন যারা নারীদের অধিকারের কথা বলে নারীদেরকে ইসলাম বিদ্বেষী করে তোলেন। তারা এখন কোথায়? তাদের চেতনা আর কত রিশা হত্যার পর জাগ্রত হবে? ইসলাম নারীর যে অধিকার দিয়েছে তা যদি আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকতো তাহলে নারীর ইজ্জত ও জীবন এভাবে ভ‚লণ্ঠিত হতো না। প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় চোখ বোলালে ধর্ষণ থেকে শুরু করে হাজারো রকমের নারী নির্যাতনের খবর দেখতে হয়। গ্রামের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ ও করুন। গ্রামের হাজারো মেয়ে রিশার মতো বখাটেদের ভয়ে স্কুলে যেতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ এ ধরনের অপরাধের অধিকাংশের-ই সঠিক বিচার হচ্ছে না ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন