কে এস সিদ্দিকী
(১০ মার্চ প্রকাশিতের পর)
সংশয়বাদীদের একটি প্রশ্ন
কোরআনুল কারিমে হজরত মূসা (আ.) ও হজরত খিজির (আ.)-এর যে ঘটনার বিবরণ প্রদান করা হয়েছে, তাতে মূসা বলতে কোন মূসাকে বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। তখন মূসা নামে দুই ব্যক্তি ছিলেন। একজন মূসা ইবনে ইমরান লাভা ইবনে ইয়াকুবের বংশধর যিনি বহু মোজেযা বা অলৌকিক ঘটনার অধিকারী এবং আসমানী তওরাত প্রাপ্ত ছিলেন। ইনি বিখ্যাত নবী হজরত মূসা (আ.)। অপরজন কাবুল আহবারের বর্ণনা অনুযায়ী, মূসা ইবনে মীশা- ইবনে ইয়াকুবের বংশধর, যিনি উল্লেখিত মূসার পূর্বে নবী হয়েছিলেন, হজরত খিজিরের সাথে তারই সাক্ষাতের কথা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।
আবু ইসহাক ইবনে সাতে ইতিহাসে কাবুল আহবার নামে খ্যাত। তার মৃত্যু হিজরী ৩২ হিজরিতে। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের একজন ইহুদী আলেম। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর খলিফা হজরত উমর (রা.) এর আমলে মদীনায় চলে আসেন। অতঃপর তিনি সিরিয়ায় চলে যান এবং হজরত আমির মোআবিয়া (রা.)-এর দরবারে আস্থভাজন হন এবং তিনি মুয়াবিয়া (রা)-এর উপদেষ্টা হন। তিনি সাহাবী ছিলেন না, তাবেঈ ছিলেন। তাকে প্রাচীন হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য করা হয়। তার বর্ণিত বহু হাদীস রয়েছে। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেও তার মধ্যে ইহুদী চিন্তা ধারার প্রভাব বিদ্যমান ছিল বলে অনেকে মনে করেন। তার মতাদর্শের বহু তথ্য-কাহিনী ইসলামের ইতিহাস ও বহুতফসীর গ্রন্থে প্রবেশ করে “ইসরাইলিয়াতি” পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়। হজরত ইসমাঈল (আঃ)-এর স্থলে হজরত ইসহাক (আ.)কে তাঁর মতাদর্শীরাই ‘জাবীহ উল্লাহ’ বানিয়ে ছেড়ে দেন। সুতরাং কাবুল আহবার যদি বলেন যে, খিজির (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে ছিলেন মুসা ঈবনে সীশা, তাতে অবাক হবার কিছু নেই।
মূসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর আলোড়ন সৃষ্টিকারী রহস্যময় ঘটনাবলীর নানাদিকের ওপর তফসীরবিদগণ এতো ব্যাপক আলোচনা করেছেন যে, তা লিখে শেষ করা যাবে না তবে এখানে আমরা দুয়েকটি মাত্র রহস্যজনক ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
প্রথমত মূসা (আ.) ও খিজির (আ.) যে নৌকা যোগে যাচ্ছিলেন, কিছু দূর যাওয়ার পর খিজির (আ.) তা ছিদ্র করে দেন। নৌকাটি ছিল দশ ভাইয়ের, পাঁচ জন সাধারণ কাজ-কর্ম করতো, বাকি পাঁচজন সাগরে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। আর যে অত্যাচারী বাদশাহ ভালো নৌকা দেখলে তা জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিতো, তার নাম আল জলন্দি আল ইজদি। সে কাফের ছিল। বলা হয়ে থাকে, এ বিপজ্জনক নৌপথ অতিক্রম করার পর খিজির (আ.) নৌকা আবার ঠিক করে দিয়েছিলেন। নৌকার মালিকরা তাতে উপকৃত হয়। খিজির (আ.) তাঁর এ কাজের জন্য ঐ জাতির কাছে দোষ স্বীকার করেন এবং অত্যাচারী রাজার অবস্থা ব্যক্ত করেন, অথচ তারা এ খবরই অবগত ছিল না।
দ্বিতীয়ত খেলাধুলায় রত যে ছেলেটিকে খিজির (আ.) হত্যা করেছিলেন। সে ছেলে সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, মাতা-পিতার অবাধ্য এ কাফের ছেলের পরিবর্তে আল্লাহতায়ালা তাঁর মোমেন মাতা-পিতাকে যে সন্তান দান করেন তার সম্পর্কে বিভিন্ন মত থাকলেও একটি মত হচ্ছে, ঐ মাতা-পিতার একটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে এবং তার বিয়ে হয় এক নবীর সাথে এবং মহিলা একজন নবীকে জন্ম দেন যিনি এক উম্মতকে হেদায়েত করেন। কারো কারো মতে, এ মহিলার বংশে সত্তর জন নবী জন্ম গ্রহণ করেন।
তৃতীয়ত খিজির (আ.) দুই এতীমের ধ্বংসান্মুখ প্রাচীর মেরামত করে দিয়েছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে। এ এতীমদ্বয়ের নাম ছিল ‘আদরাম’ ও ‘দারীম’। তাদের পিতার নাম ‘কাশেহ’। তিনি একজন মোত্তাকী পরহেজগার ছিলেন। বর্ণিত আছে যে প্রাচীর ঢাকা সিন্দুক বা ফলকে সোনা ও রূপার অদ্ভুত সব বাক্য লেখা ছিল। ফলকের একদিকে আরো লেখা ছিল লা ‘ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ অপরদিকে লেখা ছিল ‘আনাল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা আনা ওয়াহদি ..........’।
হজরত খিজির (আ.)-এর যে তিনটি কাজ হজরত মূসা (আ.)-এর পছন্দ হয়নি সেগুলো ছিল বাতেনি গোপন, ইলম, যা মূসা (আ.)-এর জানা ছিল না। তিনটি ঘটনার রহস্য হজরত খিজির কর্তৃক বলে দেয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর ছিল অজানা। ছিল না ইলমে শরীয়ত ও ইলমে বাতেন এক নয়, আল্লাহতায়ালা হজরত মূসা (আ.)কে এ পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছিলেন, যার বর্ণনা কোরআনে রয়েছে। খিজির (আ.) বলেছেন, কাজগুলো তিনি আল্লাহর নির্দেশেই করেছেন।
হজরত খিজির (আ.) আমাদের দেশে সাধারণভাবে খোওয়াজ খিজির নামে পরিচিত এবং তাঁর সম্পর্কে বহু অদ্ভুত ও বিস্ময়কর নানা কাহিনী প্রচলিত। সাগর-সমুদ্রের পাহারাদার বা রক্ষক বলে অনেকের বিশ্বাস। যেহেতু খিজির (আ.) জীবিত বলে অনেকের অভিমত তাই অনেক সাধক পুরুষ তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করে থাকেন বলেও পুস্তকাদিতে লেখা হয়ে থাকে। আরো বর্ণিত আছে যে, হজরত ইলিয়াস (আ.) ও হজরত খিজির (আ.) জীবিত, প্রতিবছর বিশেষ মওসুমে তাদের দেখা সাক্ষাত হয়ে থাকে। হজরত ইলিয়াস (আ.) কে আল্লাহতায়ালা আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন বলে মনে করা হয়।
হজরত খিজির (আ.) জীবিত এ ধারণার সূত্রপাত কিভাবে তার একটি চমৎকার কাহিনী কোনো কোনো তফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এবং সে কাহিনীর ভিত্তিতে বহু কাহিনী রচিত হয়েছে। সকলের নিকট সুপরিচিত সেই ‘আবে হায়াতে’র কাহিনী তফসিরী ভাষ্যানুযায়ী, নি¤œরূপ :
আবে হায়াত
যে পানি পান করলে মৃত্যু হয় না, অমরত্ব লাভ করা যায় তার নাম আবে হায়াত। যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকগণ আবে হায়াত নিয়ে নানা কাহিনী-প্রবাদ রচনা করেছেন। হজরত খিজির (আ.) কে এ কাহিনীর নায়ক মনে করা হয়। অর্থাৎ তিনি এমন এক অমর, চিরঞ্জীব ব্যক্তিত্ব আবে হায়াত পান করে তিনি এ শক্তির অধিকারী হয়ে দুনিয়ায় জীবিত আছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত অমরত্ব লাভ করেছেন আল্লাহতায়ালা তাকে সমুদ্র জগতের পাহারায় নিয়োজিত রেখেছেন এবং সাধক ব্যক্তিরা তাকে দেখতে পান বা তাদের সাথে খিজির (আ.) দেখা সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁরা তাঁর কাছ থেকে মূল্যবান উপদেশ গ্রহণ করে থাকেন তিনি আধ্যাত্মিক জগতের বাদশাহ এবং আধ্যাত্মিক সাধন জগতের শীর্ষ নেতৃত্বের অধিকারী এবং তিনি মানুষের নানা বিপদাপদে উপকার করে থাকেন, এরূপ নানা ধারণা প্রচলিত।
বর্ণিত আছে যে, হজরত মূসা (আ.) কে আল্লাহতায়ালা ‘মাজমাউল বাহরাইন’ নামক স্থানে গমন করে খিজির (আ.)-এর সাথে দেখা করতে ওহীর মাধ্যমে বলে ছিলেন এবং মূসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গী ইউশা এর রান্না করা মাছ জীবিত হয়ে সাগরের দিকে ধাবিত হবে সেখানেই খিজিরের সাক্ষাৎ মিলবে ঐ স্থানে একটি পাথর থাকবে মূলত সেটি হবে একটি বর্ণনা যার নাম হায়াত জীবন এ ঝর্ণার পানি পান করলে পিয়াস, তৃষ্ণা থাকবে না অমরত্ব-লাভ হবে। এ পানির নাম ‘মাউল হায়াত’। বলা হয়ে থাকে মূসা (আ.) ও ইউশা এর রান্না করা মাছ উল্লেখিত ঝরনার পানির ছোওয়া পেয়ে জীবিত হয়ে সাগরে পথ ধরেছিল ভান্ড থেকে বের হয়ে সাগরে প্রবেশ করে। মাজমাউল বাহরাইনের কোথায় পাথর তথা পানির ঝর্ণার অবস্থান হজরত খিজির তা অবগত ছিলেন। আবে হায়াত সম্পর্কে এটিই প্রাচীন ধারণা।
জুলকার নাইন ও আবে হায়াত
কেউ কেউ বলেন খিজির (আ.) ছিলেন জুলকার নাইনের খালাতো ভাই। কোরআনে খিজির ও মূসার কাহিনীর পর পরই জুলকার নাইনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। খিজিরের অমরত্ব লাভ করার কারণ আবে হায়াত পান করার ঘটনা বলে মনে করা হয়, ঘটনাটি ছিল এই যে, জুলকার নাইন পানির ঝর্ণা বা আবে হায়াত পর্যন্ত পৌঁছার জন্য বের হয়েছিলেন যাতে অমরত্ব লাভ করা যায়। কিন্তু সেখান পর্যন্ত পৌঁছতে ব্যর্থ হন, তিনি পথ ভুলে অন্ধকারে চলে যান এবং আবে হায়াত পান করতে ব্যর্থ হন। এ সফরে হজরত খিজির ছিলেন অগ্রভাগে। তিনি সঠিকভাবে আবে হায়াত ঝর্ণনায় পৌঁছে যান এবং সেখানে গোসল করেন এবং তার পানি পান করেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর শোকরিয়া স্বরূপ নামাজ আদায় করেন। ভাগ্য কি বিচিত্র। একজন অমরত্ব লাভ করেন আবে হায়াত পান করে এবং আরেকজন আবে-হায়াত থেকে বঞ্চিত হন। (সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন