শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

নিরাপদ খাদ্য আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন

| প্রকাশের সময় : ২১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু তাহের : সাধারণভাবে বলতে গেলে সকল মানুষই ভোক্তা। যে খাদ্য গ্রহণ করে মানুষ জীবনধারণ করে তাতে ভেজাল মিশিয়ে ভোক্তাদের চরম সর্বনাশ করা হচ্ছে। ভেজাল এখন সর্বত্র,  ফলমূল, মাছ, মুড়ি, মসলা ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ মানুষের জীবনধারণের জন্য যা প্রয়োজন সর্বত্রই ভেজাল আর ভেজাল। তাছাড়া ভোক্তাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে পণ্যের গুণগতমান এবং পণ্যের মূল্য সংক্রান্ত। বাংলাদেশের বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে লাগে উপলক্ষ আর অজুহাত। সুতরাং মানুষ একদিকে ভেজাল দ্বারা আক্রান্ত অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাজারও স্থিতিশীল নয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাবারের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারে রঙ ব্যবহার করে থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জীবন রক্ষাকারী ঔষধও ভেজাল থেকে শতভাগ মুক্ত নয়। প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানির নকল ও নিম্নমানের ঔষধ সম্পর্কিত খবর পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁ সম্পর্কে একটি কথা সবারই জানা। অনেক হোটেলের কড়াই-এর তেল কখনো নতুন হয় না শুধু রিসাইকেল হতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাবারে ব্যবহৃত রঙ ক্যানসার সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে এবং ভেজালযুক্ত ও ব্যবহৃত পুরোনো তেল ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।
খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানুষের লোভী মনোবৃত্তিই এর প্রধান কারণ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সচেতনতা ও সতর্কতার সাথে সচেষ্ট থাকা সত্তে¡ও ভেজালমুক্ত জীবনযাপন করা বা ভেজালমুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর অনেক কারণ রয়েছে, নাগরিক সচেতনতা এখানে মূল বিষয় নয়। হীন ব্যবসায়িক স্বার্থ অর্থাৎ যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের মানসিকতাই বেশি কাজ করে। খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষকে ঠকানো পবিত্র ইসলাম ধর্মে বড় ধরনের গুনাহ্ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরাহ্ বাকারায় ৪২নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করেছেন, তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলনা এবং জেনে-বুঝে সত্য গোপন করো না। রসুল (সা.) বলেছেন, যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়। ওজনে কম দেয়ার ব্যাপারে পবিত্র ইসলাম ধর্মে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। যারা ওজনে কম দেয়ার মতো মহা অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের ধ্বংসের হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে মহান আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন, যারা ওজনে কিংবা মাপে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা মানুষের কাছ থেকে পুরোপুরি মেপে নেয়। কিন্তু মানুষকে যখন মেপে দেয় তখন প্রাপ্যের চেয়েও কম দেয়। সুরা মুতাফফিফিন আয়াত ১-৩। ওজনে কম দেয়ার মানেই হলো মানুষের হক নষ্ট করা। ওজনে কম নেয়া ব্যক্তি যদি মাফ না করেন আল্লাহ্ তা’আলাও মাফ করেন না এটাই ইসলামী বিধান। তাই এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।
একথা সত্য যে, শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগে ভেজাল প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে মূল এবং শক্ত ভূমিকা সরকারকেই নিতে হবে। আমাদের দেশে কার্যকর রয়েছে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩। এ আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনটির ৯০ ধারা অনুসারে পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯ রহিত হয়েছে। বাংলাদেশে খাদ্যে ভেজাল রোধ কার্যক্রমের সঙ্গে বেশকিছু আইন সম্পৃক্ত থাকলেও মূল আইনটি ছিল পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯। আইনের বাস্তবায়নের পাশাপাশি নাগরিক উদ্যোগে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা নাগরিক সমাজের দায়িত্ব। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্য ভেজালমুক্ত করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সেতুবন্ধন জরুরি। পচাবাসী এবং পুরোনো খাবার বিক্রি করা আমাদের দেশের অনেক ব্যবসায়ীর প্রবণতা, যা একটি মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবেও কাম্য হতে পারে না। মুসলিম জাতির জন্য এটা চরম লজ্জাজনক। তাছাড়া কোনো ধর্মই ভেজালকে প্রশ্রয় দেয় না। ধর্মীয় মূল্যবোধ মানুষের কাছে গৌরবের ও মর্যাদার বিষয়, তা যে ধর্মেরই হোক। ভেজাল প্রতিরোধে বিএসটিআই বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন(পণ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান)-এর কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনকে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তাছাড়া জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে নকল ও ভেজালসহ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ধারায় অভিযান জোরদার করে জরিমানা কার্যক্রম আরো কঠোর করতে হবে। টিসিবি (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ)-কে আরো শক্তিশালী করলে ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করা যেতে পারে। জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটির কার্যক্রম আরো জোরদার এবং জেলায় নিয়োজিত জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তর কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে গণসচেতনতা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা গেলে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব।
জাতিসংঘের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহৃত জিনিসপত্রে থাকা রাসায়নিকের কারণে সৃষ্টি হতে পারে হরমোন সংক্রান্ত ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, শিশুর ত্রুটিপূর্ণ জন্ম ও মানসিক বিকারগস্ততাসহ বেশকিছু রোগ। সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায় শুঁটকি তৈরিতে ডিডিটি ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। অথচ এটি নিষিদ্ধ। মাছ, মাংস, ফলমূলে ব্যবহৃত হয় ক্ষতিকর ফরমালিন। রঙিন খাবার তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকর কাপড়ের রং যা ক্যান্সারও সৃষ্টি করতে পারে। মুড়ি ভাজতে ইউরিয়া, কলা পাকাতে কার্বাইড, মুরগি ব্যবসায়ীদের মরা মুরগি সরবরাহ করা হয় অনেক হোটেলে। এ জাতীয় খবর প্রায়ই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হয় সেমাই, চানাচুরসহ বেকারিতে অনেক খাদ্যদ্রব্য। তেল, ময়দা, মসলা, আটাসহ প্রায় প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যেই ভেজালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নিরাপদ খাদ্য আইনের অধীনে ২৩ ধরনের অপরাধে এক থেকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড ও চার লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। পৃথিবীর কোন কোন দেশে এধরনের অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এমনকি মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে।
স¤প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নকল দুধের কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শিহিপুর মধ্যপাড়া গ্রামে। দুই বছরে বাজার ও বাসাবাড়িতে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার লিটার নকল দুধ বিক্রি করে অসংখ্য মানুষকে দুরারোগ্য ব্যাধির ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। অর্থের লোভে এ সমস্ত মানুষ যেন পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ খাদ্যে ভেজালকারীদের প্রতিরোধে ক্রেতাসহ সাধারণ মানুষকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, খাদ্যে ভেজাল করার অপরাধে চীনে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বেশকিছু মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। আমাদের দেশে গুরুপাপে লঘু শাস্তির কারণে এমন জঘন্য অপরাধ না কমে বরং বাড়তেই থাকে। তবুও স্বাধীনতার পর চার দশকেরও বেশি সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে এক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ আইনের। এখন এ আইন বাস্তবায়ন দরকার।
নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩-এ বেশকিছু নতুন বৈশিষ্ট্যের সন্নিবেশ ঘটেছে। নিরাপদ খাদ্য আইন অনুযায়ী ভেজাল খাদ্যের অর্থ- ক. কোনো খাদ্য বা খাদ্যদ্রব্যের অংশ, যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বা জীবনহানির কোনো রাসায়নিক বা ভারী ধাতু বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়; বা খ. মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো খাদ্যদ্রব্য অথবা কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এমন কোনো উপাদন মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য; বা গ. খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ ভিন্ন কোনো উপাদান মেশানো, রঞ্জিত করা, আবরণ দেয়া বা আকার পরিবর্তন করা। যার ফলে খাদ্যের গুণাগুণ বা পুষ্টিমান কমে যায়; ঘ. খাদ্যদ্রব্যে বিকিরণসহ কোনো দূষক বা বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতি, যা খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতকারী, ক্রেতা বা গ্রহণকারীর স্বাস্থ্যহানির কারণ হতে পারে।   
একটি কথা আছে হাজার মাইলের পথ চলা একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে শুরু করতে হয়। সুতরাং পণ্যে ভেজাল প্রতিরোধ করতে হলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র আইন দিয়ে ভেজাল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা যাবে না। দার্শনিক ও রাষ্ট্র চিন্তাবিদ মহামতি প্লেটো বলেছেন, শাসক যেখানে ন্যায়পরায়ণ আইন সেখানে অনাবশ্যক, শাসক যেখানে দুর্নীতি পরায়ণ আইন সেখানে নিরর্থক। ভেজাল সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে হলে মানুষের নৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে হবে। ভেজালের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ করার সময় এখন। কার্যকর একটা উদ্যোগ গ্রহণ করার সময় এখনই। প্রতিটি নাগরিককেই যার যার অবস্থান থেকে ভেজালের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে তা না হলে আগামী প্রজন্মকে ভেজালের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
পন্যের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের আস্থার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতেু যে কোনো মানুষই কোনো না কোনো পণ্য কিনে থাকে। সে অর্থে সব মানুষই ভোক্তা। তাই তাদের অধিকার সংরক্ষণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই।
জাতিসংঘ কর্তৃক ক্রেতা ভোক্তাদের অধিকার ও দায়িত্ব নিম্নরূপ :
৮টি অধিকার :
১।    অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক     চাহিদা পূরণের অধিকার।
২।    নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার।
৩।    পণ্য উৎপাদন, ব্যবহার বিধি, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার।
৪।    যাচাই-বাছাই ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাবার অধিকার।
৫।    অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার।
৬।    কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার।
৭।    ক্রেতা ভোক্তা হিসেবে অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার।
৮।    স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার।
৫টি দায়িত্ব :
১।    পণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হোন।
২।    দরদাম করে সঠিক পণ্য বাছাই করুন।
৩।    আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন।
৪।    পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হোন।
৫।    ক্রেতা ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংগঠিত হোন।
ভেজাল নামক মারাত্মক ব্যাধি সমগ্র জাতিকে গ্রাস করতে চলেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে যে কোনো মূল্যে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত অধিকারসমূহ সংরক্ষণে মানুষকে সংগঠিত হতে হবে। আমাদের সামনে রয়েছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)। এটি অর্জন করতে হলেও ভোক্তাদের আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সভাপতি, কনজুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, মৌলভীবাজার জেলা শাখা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন