শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

২৩ মার্চের স্মৃতি

| প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব : ’৬০-এর দশকের শুরুতে বাংলা ও বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দিই। ’৬২ সালে কুখ্যাত হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল করতে হবে, ছাত্রহত্যার বিচার চাই, আয়ুব শাহীর পতন হোক শ্লোগান দিয়ে মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। জীবন সায়াহ্নে এসেও সেই মিছিলের প্রতি একটি টান অনুভব করি। ওই দশকে মৌলভীবাজার মহাবিদ্যালয় শাখা অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম। ছাত্রলীগের সম্মেলন, সভা-সমাবেশ এবং রাজনৈতিক কারণে রাজধানী ঢাকায় আসা-যাওয়ার কারণে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচয়, সম্পর্ক ও সখ্য গড়ে ওঠে। তখন থেকে আমার লেখালেখি এবং বক্তৃতা ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের স্নেহ-মমতা পাই, সুদৃষ্টি লাভ করি। ’৬৮ সালে গ্রাজুয়েশন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার পর আরও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে যাওয়ার, তাদের নেতৃত্বে কাজ করার সুযোগ পাই।
’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনকে ‘ছয় দফার রেফারেন্ডাম’ বলে ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির মুক্তি সনদ ছয় দফা কর্মসূচিকে সিআইএর চক্রান্ত এবং বঙ্গবন্ধুকে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের চর বলে অভিহিত করেছিলেন তৎকালীন ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ। অবশ্য পরবর্তীকালে অনেক ভ্রষ্টবামের বিভ্রান্তি কেটেছে। অনেকে বাম ধারা পরিহার করে আওয়ামী লীগের নৌকায় সওয়ারী হয়ে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী হয়েছেন। দলেরও পদ-পদবি পেয়েছেন।
’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। বৃহত্তর সিলেটে মৌলভীবাজার জেলায় সবকটি আসনে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীগণ। প্রতিপক্ষের প্রার্থীগণের কোথাও কোথাও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে দেশে-বিদেশে অভিনন্দিত হন।
’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ফৌজি প্রেসিডেন্ট লে. জে. এ এম ইয়াহিয়া খান, নাটেরগুরু লারকানার নবাব জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাঞ্জাবি সেনাচক্রের চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যায়। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে সামরিক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলায় সেনা মোতায়েন শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হয় অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন। ’৭১-র অগ্নিঝরা মার্চ মাস। উত্তাল পূর্ববাংলা। ২ মার্চ ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন ডাকর ভিপি আ স ম আবদুর রব। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সেক্রেটারি শাজাহান সিরাজ। উত্তাল মার্চের এসব ঐতিহাসিক কর্মসূচির নেপথ্যে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তার মূল উদ্দেশ্য ও দাবি ছিল বাংলা থেকে সেনা শাসনের অবসান, জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। পাকিস্তানি সামরিক শাসক গোষ্ঠীকে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া এবং মনস্তাত্বিক ভাবে দুর্বল করাই ছিল আন্দোলনকারী নেতৃত্বের পরিকল্পনা। ৭ মার্চ ’৭১ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ এবং ঐতিহাসিক ভাষণ। আন্দোলন-সংগ্রামের টানটান উত্তেজনার মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে পাক প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করত থাকেন। দেশব্যাপী চূড়ান্ত উত্তেজনা বিরাজমান থাকা অবস্থায় এলো ২৩ মার্চ ’৭১।
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের রিপাবলিক ডে বা প্রজাতন্ত্র দিবস। ’৭১-এর ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসকে প্রটেস্ট ডে বা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে দেশব্যাপী একযোগে কর্মসূচি ঘোষণা করে। ’৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার্থী ছিলাম, হাজী মুহম্মদ মহসীন হলের আবাসিক ছাত্র হলেও তৎকালীন ইকবাল হলেই থাকতাম। কারণ, এই হল ছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের আস্তানা। নেতারা নির্দেশ দিলেন চ‚ড়ান্ত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে নিজ নিজ এলাকায় চলে যাওয়ার জন্য। বিশেষত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ঢাকায় থাকার আর কোনো কারণ নেই। নেতাদের নির্দেশে আমি এলাকায় চলে আসি। আমি তখন মহকুমা ছাত্রলীগের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি। এলাকায় এসে মহকুমা ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত সভাপতি দেওয়ান আবদুল ওয়াহাব চৌধুরী এবং সেক্রেটারি (ভাঃ প্রাঃ) নুরুল ইসলাম মুকিতকে নিয়ে স্থানীয় আন্দোলন-সংগ্রামে শরিক হই। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ২৩ মার্চ  বিকাল বেলা চৌমুহনা চত্বরে ছাত্র গণজমায়েতের কর্মসূচি ঘোষনা করা হয়। ছাত্র-জনতার মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়। আমরা উৎসাহের সঙ্গে পূর্ববাংলার মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করি।
২৩ মার্চ পড়ন্ত বিকাল। চৌমুহনা চত্বর লোকে লোকারণ্য। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। গগনবিদারী মুহুর্মুহু জয় বাংলা শ্লোগানের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সভার কাজ। ছাত্রলীগের নব নির্বাচিত সভাপতি দেওয়ান আবদুল ওয়াহাব চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সভায় আমাকে প্রধান অতিথি করা হয়। সভাটি পরিচালনা করেন ছাত্রলীগ নেতা নূরুল ইসলাম মুকিত। আমি তখন স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খুব কড়া বক্তৃতা ও গরম গরম শ্লোগান দিতাম। তখনকার জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল : জিন্নাহ মিয়ার পাকিস্তান, আজিমপুর গোরস্থান, দুই চারটা মারুয়া ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা, তোমার নেতা-আমার নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইত্যাদি। ইতিপূর্বে কড়া শ্লোগান দেয়ার কারণে আমার নাকে-মুখে রক্তপাত হয়ে অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলাম। সুস্থ হয়ে আবার সেই ভাষণ-শ্লোগান শুরু করি। সেই সভায়ও উত্তেজিত ভাষণের পর আমি মুহুর্মুহু জয় বাংলা শ্লোগােনের মাধ্যমে প্রথমে চাঁদতারা খচিত পাকিস্তানি পতাকা এবং জিন্নাহর ছবিতে অগ্নিসংযোগ করি। তার স্থলে স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা এবং জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছবি উত্তোলন করি।
পতাকা ও ছবি পোড়ানোর আলোকচিত্র পাকসেনা ও গোয়েন্দা বিভাগের হাতে যায়। স্বাধীনতার পর আমি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বাবু বিমলকান্তি ঘোষ সুজন বাবুর মুখে অনেক দিন শুনেছি, খান সেনারা এবং ডিবি পুলিশ এই ছবি দেখিয়ে গুন্ডা মুজিব কাহ্যা হ্যায় বলে তাকেসহ অনেককেই মারপিট করে। আমার বিশাল চুল-গোপ এবং ছ’ফুটি ফিগারে আমাকে দৃশ্যত গুন্ডাপান্ডাই লাগত। তারাও আমাকে তাই মনে করত। খানসেনাদের হাতে ধরা পড়লে সেদিন আমাকে কচু কাটা হতে হতো। আমি আমার নিছক স্বদেশ প্রেম ও স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নেতাদের নির্দেশে কাজ করেছি। কোনো লোভ-লালসা অর্থের বিনিময়ে নয়। তখন আমরা নেতাদের ওয়ার্কার ছিলাম, কেডার ছিলাম না, নেতারাও আমাদের গডফাদার ছিলেন না, ছিলেন লিডার।
লেখক : সেক্রেটারি, মৌলভীবাজার জেলা জামে মসজিদ। সিনিয়র অ্যাডভোকেট, হাইকোর্ট। সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন