মোহাম্মদ আবু তাহের : হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, দেশকে ভালোবাসা ঈমানের দাবি। দেশপ্রেমের কারণেই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের অনেক মানুষ জীবন দান করেছে অকাতরে। মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। স্বদেশপ্রেমই মুক্তিযোদ্ধাদের অমর করে রেখেছে। তাদের শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও দেশবাসীর অন্তরে তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবজনক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছি। দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম সর্বোপরি নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি মহান স্বাধীনতার লাল সূর্য, পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ ও পতাকা। অসাধারণ ও অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কারণেই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ম্যাকব্রাইড বলেছেন, Bangabandu sheik mujib was the soul of his nation. ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাইরিতে লিখেছেন As a man what concern mankind concerns me, As a Bengali I am deeply involved in all that concerns Bengalis . The abiding involvement is born of nourished by love enduring love, which gives meaning to my politics and to my very being.. একজন মানুষ হিসেবে আমি সমগ্র মানব জাতি নিয়ে ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালির সাথে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ডায়েরির এ লেখায় তার মানবতাবোধ ও গভীর দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বিবিসির জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। একাত্তরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে অভিনন্দন জানাতে তার ধানমন্ডির বাসভবন অভিমুখে ছিল জনতার ঢল। বিকালে জনতার উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, এ দেশের মানুষ সত্য ও ইনসাফের পক্ষে সংগ্রাম করছে। তাদের দাবির প্রশ্নে কোনো আপস হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর এসব বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে, অসহযোগ আন্দোলনের গন্তব্য। বর্তমানে বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সুনাম অর্জন করছে তার সব কিছুর পেছনে আছে স্বাধীনতা। এখন সামাজিক খাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি বিশ্ববাসীর মুখে মুখে। আন্তÍর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ চীনের সমপর্যায়ে চলে যেতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে সাধারণ মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিক তেমনি দেশের উন্নয়নের কারিগর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে এদেশের সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত উদ্যোগ ও দেশকে দ্রæতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের যে অর্জন যে অগ্রগতি তার কিছুই হয়তো সম্ভব হতো না যদি না বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি তৈরি হতো। লক্ষ লক্ষ শহীদ ও অগণিত মা-বোনের জীবন-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা সত্যিকার অর্থে তখনই সার্থক হবে যখন দেশের প্রতিটি মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে মৌলিক অধিকারগুলো যথাযথভাবে ভোগ করতে পারবে। স্বাধীনতার প্রধান আকাক্সক্ষা ছিল, সব ধরনের অধীনতা থেকে মুক্তি, গণতন্ত্র, ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা। সহজ কথায় মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। সমতা, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার- এই তিনটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল, যা পরে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেই কাক্সিক্ষত সমাজ যদিও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি তারপরও বাংলাদেশের অর্জন অনেক। ধানের উৎপাদন চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। মঙ্গা হয়েছে ইতিহাস। মানুষের জীবনাচরণে পরিবর্তন এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আজকের এ অবস্থায় উন্নীত হতে দেশের কৃষক-শ্রমিক উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষ কঠোর পরিশ্রম করছে। এদের স্বীকৃতি দিতে হবে। এদের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। মানুষের মানবাধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। আমাদের অর্থনীতির মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে আমাদের প্রবাসীদেরও রয়েছে বিরাট ভূমিকা। তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সকলের প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিকে টেকসই রূপ দিতে হলে নৈতিক চর্চাও বাড়াতে হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতার চর্চা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আসলে স্বাধীনতা হলো মানুষের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। স্বাধীনতার মানেই হলো নিজের মানসম্মান ও ধন-সম্পদ ইত্যাদি নিয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের সেই নিশ্চয়তার ওপরে বাধা সৃষ্টি করেছিল। বাংলা সাহিত্যের যুগ সন্ধিক্ষণের কবি নবীন চন্দ্র সেন স্বাধীনতার মূল্য সম্পর্কে তার এক কবিতায় লিখেছেন- “চাহি না স্বর্গের সুখ নন্দন কানন, মুহূর্তে পাই যদি স্বাধীনতা ধন।” ২৬ শে মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। এটি বাঙালির অসাধারণ অর্জন। বাংলাদেশের মানুষের শৃঙ্খল মুক্তির দিন। বহু বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির দিন। বহু বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বিশ্বের বুকে স্বাধীনতার অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল এদেশের মুক্তিকামী মানুষ। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহংকার ২৬ শে মার্চ। ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপরে। পরিকল্পিত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে শুরু হয় ভয়াবহ গণহত্যা। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে দখলদার বাহিনী। বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে যারা নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন তাদের সিংহভাগই ছিলেন তরুণ। আজকে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই তরুণ প্রজন্মের ওপর। তরুণরাই পারে স্বাধীনতার শহীদের ঋণ পরিশোধ করতে। গভীর কৃতজ্ঞতা ও বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ শহীদকে।
লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
এবং সভাপতি ব্যাংক অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন
মৌলভীবাজার জেলা কমিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন