সোমবার, ২৭ মে ২০২৪, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

মানসিকতার পরিবর্তন দরকার

প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
ভারত এক বিরাট দেশ। সে দেশে কোটি কোটি মানুষের বাস। এই কোটি কোটি মানুষ আবার বিভক্ত সম্প্রদায়ের। কারণ ধর্ম, ভাষা, জাতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ইত্যাদির বিভিন্নতার জন্য তৈরি হয়েছে মানুষে-মানুষে পার্থক্য। সত্যি কথা বলতে, সে দেশের ১২৫ কোটি মানুষের প্রত্যেকেই কোনো না-কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত। সম্প্রদায়গত সংকীর্ণ চিন্তাধারা থেকে আসে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, যা মানুষকে করে সংকীর্ণমনা। এক সম্প্রাদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্ম, ভাষা, কৃষ্টি সংস্কৃতি ইত্যাদিকে দেখে হেয় চোখে। ফলস্বরূপ, মানুষের প্রতি থাকা মানুষের যে সহানুভূতি, যাকে বলে মানবতা বা মানবধর্ম তা লোপ পেয়ে যায়। মানুষ মানুষকে যুক্তির, সত্যের, ন্যায়ের অর্থাৎ মানবতার তুলাদ-ে বিচার করতে ব্যর্থ হয়। তার মনুষ্যত্ব পশুত্বে পরিণত হয়। কেন না, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ চিন্তাধারা থেকে অনেকের মতিভ্রম ঘটে, মনে বাসা বাঁধে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি এবং মাঝে-মধ্যে ঘটে বিস্ফোরণ, ঘটায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মানবসমাজে নিয়ে আসে বিভীষিকা।
পৃথিবীতে ইতিবাচক ও নৈতিবাচক দুটি দিক আছে। যেমন সত্য-মিথ্যা, দোষ-গুণ, লাভ-ক্ষতি, আয়-ব্যয়, জীবন-মরণ, দোস্ত-দুশমন, ভুল-শুদ্ধ, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-অঠিক, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদি। ধর্ম যেভাবে মানুষকে জীবনে চলার জন্য সৎপথ প্রদর্শন করে, ঠিক সেভাবে ধর্মের নামে অধর্ম, ভ-ামি এবং ধর্মান্ধতা মানুষকে চরম বিপথে পরিচালিত করে। ধর্মের মুখোশ পরে চলে অধর্মের বাহাদুরি, মানুষ সাজে বকধার্মিক। ধর্মের নামে মানুষ-মানুষে সৃষ্টি করে বিভেদ, বপন করে সাম্প্রদায়িক বীজ, সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা, ছড়ায় সাম্প্রদায়িকতার বীজ, সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, রোপণ করে বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ।
মানবশিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সে থাকে আকাশের মেঘখ- থেকে ঝরে পড়া বারিধারার মতো নিষ্কলুষ ও পবিত্র। তখন এ ধরণীয় কলুষিত বায়ুর গন্ধও তার নাকে লাগেনি। তাই শিশুকাল, এমনকি বাল্যকালেও মানুষের মন থাকে শুভ্র মুক্তোর মতো পবিত্র, পরিষ্কার ঝকঝকে ও সবধরনের অন্যায় আচরণ, বিদ্বেষ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও বিভেদমূলক চিন্তাধারা থেকে মুক্ত। পবিত্র কোরআন বলে, সমগ্র মানবজাতি এক আত্মা থেকে সৃষ্ট। সবাই আদমের সন্তান, কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর সেরা সৃষ্টি মানুষের মধ্যে বিভিন্ন গোত্র বা বংশ সৃষ্টি করেছেন যাতে করে তারা একে অপরেকে চিনতে পারে। তবে মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণায় এ সুযোগের অসদ্ব্যবহার করে মানুষে-মানুষে বিভেদের প্রাচীর খাড়া করেছে। আজ ধর্ম, জাতি, ভাষা, বর্ণ ইত্যাদি ভেদাভেদ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছে হানাহানি, একাংশ মানুষ হয়েছে মানুষের শত্রু। ধর্মের নামে অধর্মের বাহাদুরি এখন যেন স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। মানুষে-মানুষে হিংসা বিদ্বেষ বোধহয় অনেক সময় হিং¯্র পশুদেরও লজ্জা দেয়। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা যখন তার বিষদাঁত বের করে, তখন মানবসমাজে নেমে আসে নরকের বিভীষিকা।
আজকাল অনেক লোককে বলতে শোনা যায় যে, মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলতে চললেও মনুষ্যত্ববোধের অপমৃত্যু এখনো ঘটেনি। মানে এ ধরণীতে মানবতা নামক গুণটি এখানো একেবারে লোপ পায়নি। আর লোপ পায়নি বলেই তো এ ধরায় মানবসমাজ টিকে আছে। তবে মানবতার অপমৃত্যু যেভাবে ঘনিয়ে আসছে, নিকট ভবিষ্যতে হয়তো মানবজগৎ আলোড়ন করে আসবে এক মহাপ্রলয়, যার ফলে মানবতাবাদবিরোধী শক্তিসমূহ এ ধরণী থেকে একেবারে মুছে যাবে অথবা এ ধরার আয়ু নিঃশেষ হয়ে আসবে। না, আমরা মানুষÑ আশাবাদী। আমাদের এ সুন্দর ভুবন এত তাড়াতাড়ি ধ্বংস হবে না। কারণ মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা এখানে হ্রাস পেলেও মানবতাবাদী মানুষের সংখ্যা এখানো একদম ফেলে দেওয়ার মতো নয়। শত শত কোটি মানুষের বাসস্থান এ গ্রহে এখনো কোটি কোটি মানুষ মানবতার পূজারি। তাদের কাছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই’।
অনেকদিন আগের কথা। আমি পরিবেশ সংক্রান্ত এক সেমিনারে যোগ দিতে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর থেকে বাসে করে করিমগঞ্জে যাচ্ছিলাম। জনৈক অমুসলিম ভদ্রলোক আমার পাশের সিটে বসা। তারাপুর রেলওয়ে গেট পার হতে না-হতে তার প্রতি আমার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষিত হলো। তিনি বারবার হাত তুলে রাস্তার এপাশে-ওপাশে ভক্তি দিতে থাকেন। পরে বুঝলাম বিভিন্ন স্থানে রাস্তার পাশে থাকা ছোট-বড়ো হিন্দু মন্দিরের প্রতি বারবার ভক্তি প্রদর্শন করছেন। তার এতো ভক্তিভীরুতা আমার কাছে নতুন মনে হলো। মনে হলো যে, আধুনিক যুগে মানুষ যখন মহাকাশে বাসস্থান নির্মাণের কথা ভাবছে, তখন ধর্মান্ধ ব্যক্তিটি রাস্তাঘাটকে যেন ঈশ্বর বানিয়ে ফেলছে। আমার মনে হলো, এরাই কট্টর সাম্প্রদায়িক, যারা মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে মানবসমাজে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তুলতে চায়। বাস চলছে আর লোকটি একটু পর পর কপালে হাত তুলে, বুকে ছুঁয়ে, আবার কখনো দু’হাত তুলে বিভিন্ন মন্দিরে ভক্তি দিয়ে চলেছেন। এমনকি, কোনো সময় নিছক মন্দিরসদৃশ কোনো ঘরের প্রতিও ভক্তি প্রদর্শন করছেন। তার এ অতিভক্তি দেখে আমার মনোরাজ্যে বিভিন্ন চিন্তার ঢেউ খেলে চলেছে। ইতোমধ্যে বাস এসে পড়েছে পাঁচগ্রামের নিকটস্থ ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সিদ্ধেশ্বরের শিববাড়ির পাশে। বাস থামল। আর অন্য অনেক যাত্রীর সাথে ওই ভদ্রলোকও দাঁড়িয়ে উঠে প্রাণ উজাড় করে ভক্তি প্রদর্শন করতে লাগলেন। আমার মনোরাজ্যে অবচেতনভাবে এক ধরনের সন্দেহভাব জাগরিত হলো এই ভেবে যে, এরাই কট্টর সাম্প্রদায়িক, যারা হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভেদ ছড়ায়। এদের মতো কট্টর সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধরা ভেঙেছে শত শত বছরের পুরনো বাবরি মসজিদসহ ভারতের অনেক মসজিদ। বাবরি মসজিদ কি আল্লাহর বা ঈশ্বরের উপাসনালয় ছিল না? ঈশ্বর কি কেবল মন্দিরে বাস করেন?
পবিত্র কোরআনসহ সকল ধর্মগ্রন্থ তো ঘোষণা করেছে, সৃষ্টিকর্তা নভোম-ল-ভূম-লের সর্বত্র বিরাজমান। ঈশ উপনিষদে বলা হয়েছে, অখিল ব্রহ্মা-ের যা কিছু জড় চেতনস্বরূপ জগৎ সমস্তই ঈশ্বরের দ্বারা পরিব্যাপ্ত। আবার কোরআন বলছে, ‘ওয়াছিয়াকুরছিইউহুছ সামওয়াতে ওয়াল আরধ্’ অর্থাৎ নভোম-ল-ভূম-লের সর্বত্র তাঁর আসন বিরাজিত। এসব ভাবতে ভাবতে মনে হলো, না না, এ হতে পারে না। যারা ধর্মের ঠিকাদার বলে নিজেদের জাহির করে তারা প্রকৃত ধার্মিক নয়। এরা হলো স্বার্থান্বেষী, বকধার্মিক। পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থই অন্য ধর্মের উপাসনালয় ভাঙার বা অপবিত্র করার নির্দেশ দেয়নি। পবিত্র কোরআন মানুষের প্রতি মানুষের সুব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা করেছেÑ ‘আর সদ্ব্যবহার কর মাতাপিতার সাথে, আত্মীয়স্বজনের সাথে, আমাদের সাথে, দরিদ্রদের সাথে, নিকট প্রতিবেশীদের সাথে, সঙ্গীসাথী ও পথচারীদের সাথে এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসদাসীদের সাথে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক আত্মগর্বিত কোনো ব্যক্তিকে।’ হায়, কী অনুপম শিক্ষা! স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগে া বিশ্বধর্ম সম্মেলনে বিশ্বের সকল মানুষকে ‘ভাই-বোন’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। তিনি সকল মানুষকে ‘অমৃতের সন্তান’ বলে ভাবতেন।
এসব বিষয় মাথার মধ্যে যখন তোলপাড় করছিল তখন বাস বদরপুর পেরিয়ে করিমগঞ্জের পথ ধরেছে। অল্প সময়ের মধ্যে এসে পৌঁছাল শাহ আদমখাকীর দরগায়। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিলেন। তখনই আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হলো সেই ভদ্রলোকের প্রতি। দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে প্রাণভরে অভিবাদন করছেন মাজার শরিফকে। আশ্চর্য হলাম, মনে বড়ো দোলা দিল। অন্যের ওপর ভুল ধারণার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হলো। অনুতাপে ভরে উঠল হৃদয়-মন। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলাম, ‘না, না, কখনো না। এ ধরনের লোক কোনদিন মসজিদ ভাঙতে পারে না।’
এবার মনোলোকে প্রশ্ন এল, তবে এ ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের? তিনি কি ভারতবর্ষের একশ’ পঁচিশ কোটি মানুষের অন্তর্ভুক্ত নন? অনেকক্ষণ ভেবে উত্তর পেলাম, এ ব্যক্তি আসলে মানুষ। কারণ তিনি ধর্মান্ধ নন, বরং ধর্মভীরু হলেও মানবতার পূজারি। কারণ তিনি ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে মুক্ত। অতএব, তার সম্প্রদায় হলো মানব সম্প্রদায়। এভাবে একাংশ মানুষ আছেন যারা মসজিদ-মন্দির, মাজার সর্বত্র শ্রদ্ধা-ভক্তি প্রদর্শন করেন। সিলেটের হজরত শাহজালালের দরগা বা আজমীরের হজরত খাজা মঈনুদ্দিন আউলিয়ার দরগাসহ আরো শত-শত দরগায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দেশ-মহাদেশ নির্বিশেষে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ভক্তিভরে দর্শনার্থে যান। এসব মানুষ হয়ে ওঠেন সব ধরনের গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে, হয়ে ওঠেন মানবতার পূজারি।
বর্তমানের ধর্ম ব্যবসায়ীরা যেভাবে বিভেদের খেলায় মেতে উঠে মানুষে-মানুষে বিভেদের রেখা গাঢ় করে তুলছেন তাতে মনোকষ্টে ভুগছেন মানবতার পূজারিরা। এই সেদিন, জনৈক বিশিষ্ট শিক্ষক আমাদের এতদঞ্চলের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে দুঃখপ্রকাশ করে বললেন যে, সারাজীবন ধরে শিক্ষকতা করে মনে হচ্ছে আমরা জীবনে ব্যর্থ হয়েছি। সত্যিই, পৃথিবীর একাংশ মানুষ যখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উন্নতির চরম শিখরে উঠতে চলেছে, তখন আমরা একাংশ মানুষ রাজনীতি ক্রীড়নক হয়ে ধর্মীয় হানাহানিতে ব্যস্ত। আর কতকাল আমরা এভাবে রাজনীতির ব্যবসায়ীদের শিকারে পরিণত হবে? কবে আমাদের বোধোদয় হবে? জেগে উঠবে অন্তরে ঘুমিয়ে থাকা মানবতা? আমরা হয়ে উঠব, এ ধূলির ধরায় মহান আল্লাহর প্রতিনিধি।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন