মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

নিবন্ধ

নামের মিল থাকায়

| প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : বয়স, পিতার নাম ও গ্রামের মিল না থাকার পরও শুধু নামের মিল থাকায় পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার হেতালিয়া গ্রামের মৃত আবুল হাসেম উকিলের ছেলে চা বিক্রেতা কাওছার উকিলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে চরখালী ফেরিঘাটে চায়ের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিল।
মানুষ বিপদে পুলিশের কাছে যাবে, অথচ এখন ঘটছে উল্টো ঘটনা। পরিস্থিতি এমন যে, মানুষ পুলিশকেই ‘বিপদ’ মনে করে থাকে। পুলিশের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু কর্মকর্তা ও সদস্যের অতি বাড়াবাড়ি যেমন লক্ষণীয়, তেমনি তাদের একের পর এক অনৈতিক ও অপ্রীতিকর কর্মকান্ডে গোটা বাহিনীকে বিতর্কের মুখে পড়তে হয়। কাওসারের ছোট ভাই জাকারিয়া জানান, ‘গ্রেপ্তারের সময় আমার ভাই বলেছিল তার নামে কোনো মামলা নেই। তারপরও বিষয়টি আমলে না নিয়ে যাচাই-বাছাই না করে তাকে গ্রেপ্তার করে। আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। ভাইয়ের পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে চা বিক্রি করে। এনজিও ব্র্যাক থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়া আমার ভাই চরখালী ফেরিঘাটে চা বেচে সংসার চালাত। ভাই জেলে থাকায় অনাহারে দিন কাটছে তার পরিবারের সদস্যদের। কিস্তির টাকা দিতে পারছে না। ‘তিনি আরও বলেন, ভাইরে গ্রেপ্তার কইরা থানায় নেওয়ার পর আমি কইছি ভাই নির্দোষ। কিন্তু পুলিশ আমার কথায় কোনো সায় দেয়নি’। খুলনায় দায়ের করা একটি মামলায় অভিযুক্ত এক আসামির সঙ্গে নামের মিল থাকায় গত ২৩ মার্চ ভান্ডারিয়া থানার এসআই সুজন চক্রবর্তী কাওসারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করেন। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বিনা অপরাধে দিনের পর দিন জেলে আছেন কাওসার।
জানা যায়, খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার নবীনগর গজালমারী গ্রামের আবুল কালামের মেয়ে শিমু আক্তার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তার স্বামী মিঠু উকিল, শ্বশুর কাওছার উকিল, শাশুড়ি এবং ননদসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। আসামিদের স্থায়ী ঠিকানা ভান্ডারিয়া উপজেলার চরখালী গ্রামে। আসামি আদালতে হাজির না হলে আদালত ভান্ডারিয়া থানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠায়। আর পুলিশ কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই না করেই নামের মিল থাকায় হেতালিয়া গ্রামের বাসিন্দা চা বিক্রেতা কাওসার উকিলকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়ে দেয়। ভাÐারিয়া থানার এসআই সুজন চক্রবর্তী ভুলের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, অভিযুক্ত আসামির পিতার নাম হাকিম উকিল। তবে যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার পিতার নাম হাসেম উকিল। গ্রেপ্তারের সময় পিতার নাম ভুল হয়েছে।
ইতোপূর্বে বিনা বিচারে ২৫ বছর কারাভোগের পর বেকসুর খালাস পেয়ে ‘কেউ কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে’, একথা বলেছিলেন কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরের বাহারনগর গ্রামের মো. বাবুল। শুধু পিরোজপুরের কাওছার আর কুমিল্লার বাবুল নয়, খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এভাবে অনেকেই জেলের প্রকোষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। নিছক কারণ দেখিয়ে কিংবা পুলিশের ভুল গ্রেফতারের স্বীকার হয়ে। এমনকি অনেক আছে, হয়ত যাদের পরিবারও জানে না, তাদের সন্তান জেলে বন্দি।
২.
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার রহিমপুর গ্রামের নিরীহ ৯ ব্যক্তিকে পুলিশ মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা যায়, আশরাফ মেম্বারের ভাই আবুল কালাম অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগিয়ে গ্যারেজে অটোরিকশা চার্জ দিয়ে আসছিল। এতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ আশরাফ মেম্বার ও তার ভাই আবুল কালামসহ অজ্ঞাত ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। এতে নিরীহ ৯ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। উক্ত মামলায় জামিনে মুক্তি পাওয়া নজরুল ইসলাম ও আবু জাহের জানান, ‘আমরা উক্ত ঘটনা না জেনেও এক মাসের ওপরে বিনাদোষে জেল খাটলাম। আমাদের যারা ফাঁসিয়ে দিয়েছে, তাদের বিচার একদিন আল্লাহ করবে’। নবীপুর পশ্চিম ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন জানান, ‘প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে অপরাধীদের বাদ দিয়ে এলাকার নিরাপরাধ ও নিরীহ লোকজনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলার চার্জশিট দিয়ে একটি কলঙ্কজনক ইতিহাস রচনা করে গেছে। এ ধরনের আরও বহু ঘটনায় পুলিশ বিতর্কিত হচ্ছে। নিরীহ ও অসহায় লোকজনকে পুলিশ ফাঁসিয়ে দেবে এটা কখনো ভাবতেও পারিনি। এ ধরনের ঘটনার জন্যই পুলিশ তিরস্কার পায়’। মুরাদনগর থানার ওসি এসএম বদিউজ্জামান জানান, ঘটনাটি আমার আসার আগের। বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবেলা করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই।
দেশে পুলিশের ভ‚মিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লেও পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায়। অনেক সময় তারা নির্যাতিত ও দুর্বলের পাশে না দাঁড়িয়ে চোর, ডাকাত থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, অপহরণকারীসহ অপতৎপরতার হাতকে শক্তিশালী করে। আমজনতার কথা বাদই দিলাম, ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীদেরও পুলিশের হাতে নাজেহাল হতে হয়। অপরাধ দমন করা যাদের দায়িত্ব, তারা নিজেরাই যখন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে, তখন আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হবে কীভাবে? সাধারণ মানুষ যখন নিরুপায় হয়ে পুলিশের কাছে আশ্রয় নেয়, তখন পুলিশ তাদের সহায়তায় এগিয়ে না এসে উল্টো হয়রানি করে। আইন, নীতি, নৈতিকতা এদের কাছে গুরুত্ব পায় না। অনেক পুলিশ সদস্য বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেয়ে পকেট ভারী করতে ব্যস্ত। তবে সব পুলিশই যে অন্যায় করে, তা বলা যাবে না। উপরের ঘটনাদৃষ্টে স্পষ্টতই প্রমাণ হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীর নিজস্ব নিয়মকানুন, শৃঙ্খলাবিধি, চেইন অব কমান্ড ও জবাবদিহির কাঠামোসহ অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। উপরের কর্মকর্তারা নৈতিক দায় এড়াবেন কীভাবে? অপরাধী না হয়েও নামের মিলে জেল ও নিরীহকে ফাঁসানোর ঘটনা ভবিষ্যতে যে আবারও ঘটবে না, তারই-বা নিশ্চয়তা কী!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন