কামরুল হাসান দর্পণ
আমাদের দেশের রাজনীতির ট্র্যাডিশন হচ্ছে রাজনীতিবিদরা মাঠে-ময়দানের জনসভায় যেসব বক্তব্য রাখেন সেগুলোকে পলিটিক্যাল রেটরিক হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়, বাত কি বাত বা কথার কথা। আবার বলা হয়, মাঠে-ময়দানের এসব বক্তব্য ধর্তব্যের মধ্যে নয়। এর অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক বক্তব্য বা বিবৃতির কোনো ভিত্তি নেই। কী সাংঘাতিক কথা! যারা দেশ পরিচালনা করেন বা যারা ক্ষমতায় যাবেন মাঠে-ময়দানের কথার কোনো মূল্য নেই! তারা জনগণের সামনে ‘কথার কথা’ বলেন! তাদের কথা ও কাজে কোনো মিল নেই? এটা কেমন কথা? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায় না। কারণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক ধারাটাই এমন হয়ে গেছে যে, নেতা-নেত্রীদের কথার দাম সাধারণ মানুষের কাছেও কম। সাধারণ মানুষও জানে এসব ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অসত্য, অর্ধসত্য কথা বলা হয়। তবে একেবারে যে সত্য কথা বলা হয় নাÑ তা নয়। এর পরিমাণ খুবই কম যা সত্য হলেও ‘রাজনৈতিক কথা’ বলে উড়িয়ে দেয়া হয়। এ ধরনের অধিক বিভ্রাট ও বিভ্রম সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক কথাবার্তা বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। সাধারণত বড় দলগুলোর কথা তাদের সমর্থকরা মন দিয়ে শোনে। তারা এসব কথায় উল্লসিত হয়। সাধারণ মানুষও শোনে। তবে তাদের শোনা ও বোঝাটা সমর্থকদের চেয়ে আলাদা। তাদের কাছে যেটা সঠিক বলে প্রতীয়মান হয় সেটা গ্রহণ করে। যেটা মনে করে একেবারে ঢাহা অসত্য তা বর্জন করে এবং বিরক্ত হয়। ফলে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিশ্বাস খুব কম জন্মায়। রাজনৈতিক সচেতনতাও সৃষ্টি হয় না। কেবল ভোট দেয়ার সময় ভোট দিয়ে আসে। তাদের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে যেমন একটা উন্নাসিকতার সৃষ্টি হয় তেমনি রাজনৈতিক সচেতনতাও গড়ে উঠে না।
আমাদের দেশে পলিটিক্যাল এনিহিলেশন বা রাজনৈতিক নিশ্চিহ্নকরণ অপসংস্কৃতি বহু বছর ধরেই চলছে। রাজনৈতিক আদর্শ সেটা ভাল বা মন্দ হোক না কেন তা রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে মোকাবেলা করার পরিবর্তে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মোকাবেলা করা হচ্ছে। তোমাকে আমার পছন্দ না, কাজেই তোমার অস্তিত্বই আমি রাখব নাÑ এমন একটা মনোভাব কাজ করে। এর নমুনা আমরা যেমন বিগত সরকারগুলোর শাসনামলে দেখেছি, এখনও দেখছি। নিশ্চিহ্নকরণের অপসংস্কৃতিটি এখন সবচেয়ে বেশি প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমরা দেখেছি, সংসদের বাইরে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর কীভাবে নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। সরকারের মধ্যে এমন মনোভাবÑ যেসব রাজনৈতিক দল তার সঙ্গে আছে, তার বাইরে আর কোনো রাজনৈতিক দল থাকতে পারবে না। যারা রয়ে গেছে, শক্তি প্রয়োগ এবং নানা ধরনের অপবাদ দিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। কিছুদিন আগে সরকারি দলের প্রথম সারির এক নেতা স্পষ্ট করেই দেশের বৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি সম্পর্কে বলেছেন, সাংগঠনিকভাবে বিএনপি দুর্বল হলেও তাদের এখনও কিছু সমর্থন রয়েছে। তার এ কথা থেকেই প্রতীয়মান হয়, যে দলটি তিন তিনবার ক্ষমতায় ছিল এবং তৃণমূল পর্যন্ত যার সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে তা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। তা নাহলে সাংগঠনিক দুর্বলতার প্রশ্ন আসবে কেন? একটি দল একটি জাতীয় নির্বাচন না করলেই সাংগঠনিকভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। অতীতে আমরা দেখেছি, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলও একুশ বছর ক্ষমতায় ছিল না, তার মানে কি তার সাংগঠনিক ভিত উড়ে বা ক্ষয়ে গিয়েছিল? তাহলে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা যে কথা বলেছেন তা কি করে সত্য বলে ধরে নেয়া যায়? এর আরেকটা অর্থ হতে পারে, সরকার মনে করেছে প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে বিএনপির উপর নিশ্চিহ্নকরণের যে প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে তাতে দলটি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটাও হতে পারে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা হয়তো নিজ দলের নেতাকর্মীদের সাহস দেয়ার জন্য এ কথা বলেছেন। কারণ আগামী জাতীয় নির্বাচন খুব বেশি দূরে নয়। দেখতে দেখতে চলে আসবে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের যেসব কর্মকাÐ বহুল সমালোচিত হয়েছে এবং নিশ্চিহ্নকরণ রাজনীতির পথ অবলম্বন করা হয়েছে, যদি ক্ষমতা থেকে কোনোভাবে ফসকে যায়, তবে তাকে পেব্যাকের শিকার হতে হবে, এ আশঙ্কা থেকে হয়তো নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এ কথা বলা হয়েছে।
দুই.
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বিজয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে ১১০৮৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে কি প্রমাণিত হয়েছে, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এবং কিছু জনসমর্থন রয়েছে? যদি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল এবং কিছু জনসমর্থন থাকত তাহলে কি বিজয় অর্জন সম্ভব হতো? বিএনপি প্রার্থী তো ধুলোয় লুটিয়ে পড়তেন। পাত্তাই থাকত না। অথচ ক্ষমতাসীন দলের নেতার কথার বিপরীতে বিএনপি প্রার্থী বেশ ভালভাবেই পাস করে গেছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কথাই যদি ধরা হয় তবে সেখানে বিএনপি প্রার্থী হারলেও প্রায় এক লাখ ভোট পেয়েছে। আবার কাউন্সিলর পদে ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে বেশি সংখ্যায় জিতেছে। এখন এক লাখ ভোটকে যদি কিছু সমর্থন বলা হয়, তবে তা কি পলিটিক্যাল রেটরিক বা বাত কি বাত বলা হবে? এমনকি নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা পর্যন্ত বলেছেন, নির্বাচনে হারলেও বিএনপি যে ভোট পেয়েছে, তাতে এটাই প্রমাণিত হয়, ক্ষমতাসীন দলের একমাত্র প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপি। অথচ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এমনভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন যেন, বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অবশ্য তারা এ কথা বলেন, এ কারণে যে তারা ভাল করেই জানেন বিএনপির উপর দিয়ে বিগত বছরগুলোতে যেভাবে স্টিমরোলার চালানো হয়েছে, তাতে দলটির অস্তিত্ব হয়তো বিলীন না হলেও, সামান্য বাকি আছে। আরেকটু রোলার চালালেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এটা অনেকটা জোর করে সান্ত¡না পাওয়ার মতো। এ ধরনের প্রবণতার কারণ, নিজ নেতাকর্মীদের উৎসাহ দিতে কথার কথা বলা বা বিএনপি নামে যে একটি দল আছে তা ভুলে থাকার চেষ্টা করা। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এমন আচরণ দেখা দেয় তখনই, যখন তার ভেতরে প্রবল দুর্বলতা থাকে। সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা, শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা, অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন না হওয়া ইত্যাদি কারণ যখন ক্ষমতাসীন দলের মননে জায়গা করে নেয়, তখন তা ঢাকতে নানা কৌশল অবলম্বন করা স্বাভাবিক। এসব কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে যখন প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার নীতি অবলম্বন করা হয়, তখন একের পর এক ভুল হতে থাকে। ভুল থেকে ভয়েরও জন্ম হয়। বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন দলের ভেতর ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা ততই জেগে উঠছে। এর কারণ হচ্ছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন যেনতেনভাবে করে ক্ষমতাসীন হলেও, আগামী নির্বাচনটি অনুরূপভাবে করার চ্যালেঞ্জ নেয়ার মতো পরিস্থিতি ক্ষমতাসীন দল মোকাবেলা করতে চাইবে, এমন ধারণা শুভবুদ্ধির কেউ করে না। করতে গেলে যে মহাসংকট দেখা দেবে তা দ্বিতীয়বার মোকাবেলা করা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সম্ভব হবে না। এর ফলে ক্ষমতাসীন দল ভেতরে ভেতরে এক ধরনের চাপ অনুভব করছে। এই চাপ একদিকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার অন্যদিকে ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কার। হ্যাঁ, ক্ষমতাসীন দল পুনরায় কীভাবে ক্ষমতায় আসা যায়, এ পরিকল্পনা নিশ্চয়ই করছে। ক্ষমতা অটুট রাখার যত ধরনের পন্থা আছে, তার সবই অবলম্বন করছে। তবে তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে বিএনপি প্রধানতম বাধা, এ বাস্তবতাও অস্বীকার করতে পারছে না। অর্থাৎ আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে হয় বিএনপিকে অংশগ্রহণ করাতে হবে, না হয় অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ক্ষমতাসীন দল বিএনপিকে হেয়প্রতিপন্ন করে যত কথাই বলুক না কেন, ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে এবং আসার ক্ষেত্রে যে এই দলটিই তাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ, তাতে সন্দেহ নেই। দল হিসেবে বিএনপিকে স্বীকার না করলেও ক্ষমতাসীন ও তার মিত্র দল ছাড়া বিশ্বের সব দেশ বিএনপিকেই কাউন্ট করে। বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তি বা প্রতিনিধি দল সফরে এলে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাথেই দেখা করেন। সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রধানের সাথে দেখা করেন না। বিএনপির প্রতি দেশের একটি বৃহৎ অংশের মানুষের এই সমর্থন এবং বিদেশিদের গ্রহণযোগ্যতাকে সরকারি দল কী করে উপেক্ষা করবে? এখন দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল জনসভা করে যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে, তার বক্তব্যেরও মূল সুর থাকে বিএনপিকে টার্গেট করে। বিএনপিকে যতভাবে অপবাদ দেয়া যায়, তাই দিচ্ছে। তবে এসব অপবাদ যে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারায় বাত কি বাত, তা জনসাধারণের বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে এই সংস্কৃতির ধারায় ক্ষমতাসীন দল যে পিছিয়ে থাকে এবং জনসাধারণ যে খুব কম আমলে নেয়, এটা অস্বীকার করা যায় না। কারণ ক্ষমতাসীন দলের কর্মকাÐ জনগণের সামনে জ্বলজ্বল হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বিরোধী দল যখন সরকারের বিরোধিতা করে কিছু বলে, তখন জনগণ তা মিলিয়ে দেখে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল পাওয়ায় তাদের মতামত বিরোধী দলের পক্ষেই যায়।
তিন.
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির বিজয় নিঃসন্দেহে দলটির জন্য প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। এ নির্বাচন তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সহায়ক হবে। তবে এতে আনন্দে ভেসে যাওয়ার কিছু নেই। এ বিজয় একটি টোপও হতে পারে। কারণ দেশের মানুষ রকিব কমিশনের শুরুর দিকের ভূমিকা বেশ ভালভাবেই দেখেছে। তার অধীনে পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি বিজয় লাভ করেছিল। এতে বিএনপি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল। জাতীয় নির্বাচনে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত, এমন একটা মনোভাবও দেখা গিয়েছিল। তবে তাদের এ উচ্ছ¡াস উবে যায় ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে। যে রকিব কমিশনের অধীনে বিএনপি পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন জিতেছিল, সেই রকিব কমিশনই জাতীয় নির্বাচনে কী খেলাটা দেখাল! এ নির্বাচনের পক্ষে যেসব টকশোজীবী ছিলেন, তারা অনবরত বলতে শুরু করলেন, বিএনপি যদি ক্ষমতাসীন দল ও রকিব কমিশনের অধীনে পাঁচ সিটি করপোরেশন জিততে পারে, তবে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেই তো পারত! কত সহজ ও সরল কথাবার্তা! তারা এটা বলেননি, পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির বিজয় ক্ষমতাসীন দলের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ওরকম নির্বাচন যদি জাতীয় নির্বাচনে হয়, তবে তাদের ক্ষমতা থেকে বিদায় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিএনপি জিতলেও তা যে সরকারি দলের জন্য আগাম সতর্ক বার্তা ছিল তা সে ভালভাবেই উপলব্ধি করে। জেনে, শুনে ও বুঝে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে অংশগ্রহণ করতে দিয়ে কি নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো বোকামি করা যায়? তারপরও রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু করে বিএনপিকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য একটি টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটা ছিল বিএনপিকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ। বিষয়টি অনেকটা এরকম ছিল যে বিএনপিকে কোনোভাবে জাতীয় নির্বাচনে এনে নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করে দেখানো তারা নির্বাচনের মাধ্যমে জিতেছে। বিএনপি যখন এ ফাঁদে পা না দিয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ক্ষমতাসীন দলও কৌশল পরিবর্তন করে বা অনেকটা জেদ করেই বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার সব ব্যবস্থা করে। বিএনপি ক্ষমতাসীন দলের জবরদস্তিমূলক ও একতরফা কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে, জাতীয় নির্বাচনের আগে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হতে পারে আগের কৌশলের প্রাথমিক ধাপ। নবগঠিত কে এম নুরুল হুদা কমিশনের যাত্রা শুভ করার একটি পদক্ষেপও হতে পারে। সরকার হয়তো চাচ্ছে না শুরুতেই হুদা কমিশন বিতর্কে পড়–ক। কারণ ইতোমধ্যে বিএনপি এই কমিশন নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এ প্রতিক্রিয়া ভুল প্রমাণ করার জন্যই হয়তো কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। আর নির্বাচন কমিশনকেও সুযোগ করে দিয়েছে বলতে, আমরা জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। তবে নির্বাচনটি যে পুরোপুরি সুষ্ঠু হয়েছে তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। যদি পুরোপুরি সুষ্ঠুই হতো, তবে দুটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হলো কেন? এছাড়া প্রায় দশটি কেন্দ্রে জোরজবরদস্তির ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন কেন এসব ঘটনার প্রতিকার করতে পারল না? এতে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এসব ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট দুর্বলতা ছিল। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কুমিল্লায় তাদের পরাজয়ের মূল কারণ অভ্যন্তরীণ কোন্দল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি এ কোন্দল না থাকত তবে ক্ষমতাসীন দল যে প্রভাব বিস্তার করত তা কি নির্বাচন কমিশন সামাল দিতে পারত? এসব বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি সফল, এ দাবি করা যুক্তিযুক্ত নয়। তারপরও নির্বাচনটিকে মন্দের ভাল হিসেবে সকলেই মেনে নিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন যেভাবে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেছে তা একটু বাড়াবাড়িই মনে হতে পারে। কারণ স্থানীয় একটি নির্বাচন সুষ্ঠু করার মাধ্যমে জনগণের পুরো আস্থা অর্জন করা হয়ে গেছে, এমন অতি উচ্ছ¡াস প্রকাশ করার সময় এখনও আসেনি। এখনও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তারা হয়নি। আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং তা এখনও তাদের ধারণার বাইরে রয়ে গেছে। তার আগে আগামী বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত রংপুর, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন রয়েছে। এসব নির্বাচন সুষ্ঠু করার চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে। এ নির্বাচনগুলো যদি গ্রহণযোগ্যভাবে নির্বাচন কমিশন করতে পারে, তবে তারা জনগণের আস্তা অর্জনের বিষয়টি কিছুটা হলেও দাবি করতে পারবে। এরপর জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের যে রকিব কমিশনের মতো বিগত ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না, তার গ্যারান্টি কি এখন দেয়া যায়?
চার.
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দল বরাবরই একটু ব্যাকফুটে থাকে। অন্তত আমাদের দেশে স্বৈরশাসন বা একনায়কতন্ত্র বাদ দিলে এ প্রবণতা সবসময়ই দেখা গেছে। বিগত প্রায় ৯ বছর ধরে এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বৈরশাসন না হলেও ক্ষমতাসীন দলের অতি কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাবের কারণে বিরোধী দল বিশেষ করে সংসদের বাইরের দলগুলো ব্যাকফুটে চলে গেছে বা ঠেলে দেয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক রীতি-নীতিতে এমন রাজনৈতিক পরিবেশ খুব কম দেখা যায়। তবে ক্ষমতাসীন দল তার এমন শাসন ব্যবস্থা নিয়ে খুবই খুশি। কারণ তার বিরোধিতা করার মতো দল নেই বা বিরোধিতা করে এমন দলকে কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। উল্টো ক্ষমতাসীন দল কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলে বেড়াচ্ছে। দেশে অবারিত গণতন্ত্র আছেÑ দাবি করছে। এটা কেমন গণতন্ত্র তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। আমাদের দেশের জন্য এমন শাসন ব্যবস্থা এক নতুন অভিজ্ঞতা। অনেকে এ ধরনের শাসন ব্যবস্থাকে এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। কারণ এ শাসন ব্যবস্থায় জবরদস্তি এবং সব কিছুই আমার, এমন একটা প্রবণতা রয়েছে। আমরা যদি স্থানীয় নির্বাচনগুলোর দিকে দৃষ্টি দেই, তবে দেখব সেখানে বিরোধী দলকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন দল তার মতো করে নিজের প্রার্থীদের জিতিয়ে এনেছে। আর গণতন্ত্র দেখানোর জন্য তাদের ইচ্ছা মতো কিছু নির্বাচনে বিরোধী দলকে বিজয়ী করা হয়েছে। বলা যায়, এক ধরনের লোক দেখানো গণতন্ত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর বিজয় সেই লোক দেখানো গণতন্ত্রের প্রতীক কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকা অস্বাভাবিক নয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন এবং তার আগে অনুষ্ঠিতব্য স্থানীয় নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে হওয়ার উপর এ সন্দেহ থেকে মুক্তি অনেকাংশে নির্ভর করছে।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন