নাছিম উল আলম : সরবারহে ঘাটতি না থাকলেও শুধুমাত্র বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে বরিশাল মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকাতেই দিন-রাত বিদ্যুৎ বিভ্রাটে সুস্থ জীবন ব্যবস্থা বিপন্ন। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও চরম সংকট চলছে। চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দুর্ভোগ বর্ণনার বাইরে। দিন-রাতের অনেক সময়ই সন্তানের পাশে উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের হাত পাখা নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে জরুরি অস্ত্রোপচারসহ চিকিৎসা ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত প্রায়ই।
দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায় প্রায় ১৩০ মেগাওয়াট চাহিদার পুরোটাই সরবারহ করা সম্ভব হলেও জরাজীর্ণ বিতরণ ব্যবস্থাসহ ৩৩/১১ কেভী সঞ্চালন লাইন এবং ১১/০.৪ কেভী বিতরণ লাইনসহ ট্রান্সফর্মারগুলো চরম দুর্ভোগে ফেলছে সাধারণ মানুষকে। এমনকি খোদ বরিশাল মহানগরীতে বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে সুস্থ জীবন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে বার বার। নগরীর ১৩২ কেভী গ্রিড সাব-স্টেশন থেকে রূপাতলী ৩৩/১১ কেভী মূল সাব-স্টেশনে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হয়। সেখান থেকে একাধিক ১১ কেভী ফিডার ছাড়াও ৩৩ কেভী সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে পলাশপুর ও কাশীপুর ৩৩/১১ কেভী সাব-স্টেশন এবং ঝালকাঠী ৩৩ কেভী সাব-স্টেশনে বিদ্যুৎ পৌঁছানো হচ্ছে। ঐসব ৩৩ কেভী সাব-স্টেশন থেকে ১১ কেভী একাধিক ফিডারের মাধ্যমে বিতরণ ট্রান্সফর্মার ও ০.৪ কেভী বিতরণ লাইনের মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে।
কিন্তু রূপাতলী মূল সাব-স্টেশনের ৩৩/১১ কেভী ট্রান্সফর্মার ছাড়াও সেখানের ‘বাসবার’ ও ‘ব্রেকার’গুলো দীর্ঘদিনের পুরনো। এছাড়াও পুরো সাব-স্টেশনটি ১৯৯০ সালের পরে আর পুনর্বাসন ও পরিপূর্ণ সংস্কার করা হয়নি। এমনকি প্রায় একই সময়ে নগরীর কাশীপুর ও পলাশপুরে দুটি ৩৩/১১ কেভী সাব স্টেশন নির্মাণের পর তাও অদ্যাবধি পরিপূর্ণ পুনর্বাসন করা হয়নি। তবে সম্প্রতি পলাশপুর সাব-স্টেশনে ১৫ এমভিএ ক্ষমতার ৩৩/১১ কেভী একটি ট্রান্সফর্মার ক্ষতিগ্রস্ত হবার পরে একটি নতুন ট্রান্সফর্মার স্থাপন করা হয়। এছাড়াও রূপাতলীÑ পলাশপুর একটি বিকল্প ৩৩ কেভী লাইন নির্মাণ করা হয়েছে।
রূপাতলী-কাশীপুর ও পলাশপুর-কাশীপুর ৩৩ কেভী লাইনসহ দুটি সাব-স্টেশনের সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ৩০ বছরেরও বেশি পুরে না। ফলে সামান্য বাতাসেই এ সাব-স্টেশন দুটি ছাড়াও এর সাথে সংযুক্ত ১১ কেভী বিতরণ লাইনগুলোতে গোলযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল দিনভরই বরিশালের রূপাতলী সাব-স্টেশন থেকে পলাশপুরগামী ৩৩ কেভী সঞ্চালন লাইনের বাসবার ও ব্রেকারে কাজ করতে গিয়ে গোটা নগরীর বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। কাশীপুর থেকে পলাশপুরে বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ নিয়ে সরবারহ ঠিক রাখতে গিয়ে কাশীপুর সাব-স্টেশনে সংযুক্ত ৭টি ফিডারেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা সরবারহ বিঘিœত হয়।
এছাড়াও বরিশাল মহানগরীসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক হাজার ১১/০.৪ কেভী ট্রান্সফর্মারগুলো অনেকটাই অরক্ষিত। এসব ট্রান্সফরমারের ৮০ ভাগই ওভারলোডেড। ড্রপআউটগুলো ত্রæটিপূর্ণ। ট্রান্সফর্মারের বহির্গামী লাইনে কোনো এমসিপি নেই। ফলে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বহু মূল্যবান ট্রান্সফর্মারসমূহ। উপরন্তু কোনো এলাকায় একটি ট্রান্সফর্মার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা পরিবর্তনেও ২৪ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগছে। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ক্রমশ সীমা ছাড়াচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, দক্ষিণাঞ্চলসহ পশ্চিম জোনের ২১টি জেলার বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি ওজোপাডিকো’র উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ সহসা মাঠ পর্যায়ে দেখভাল করেন না। উপরন্তু এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠার এক যুগ পরেও গ্রাহক সেবার মান উন্নয়নে তেমন কিছুই করা হয়নি। মাঠ পর্যায়ের অতি জরুরি প্রয়োজনেও যানবাহনের সংকট মারাত্মক। অভিযোগ কেন্দ্রগুলোতে প্রায়ই কোনো লোকজন থাকে না। সামান্য বাতাসেই জরাজীর্ণ বিতরণ লাইনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ গত এক দশকে সারা দেশের সাথে দক্ষিণাঞ্চলেও বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু সেবার মান ক্রমশ তলানিতে। বিদ্যুৎ সংকট না থাকলেও বিভ্রাটের যন্ত্রণায় সুস্থ সমাজব্যবস্থাসহ শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষসহ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ।
এসব ব্যাপারে গত কয়েকদিনে ওজোপাডিকোর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক-কারিগরি ছাড়াও বরিশাল সার্কেলের ডিজিএম-পরিচালনার সাথে আলাপ করা হলে তারা উভয়ই সরবারহ ও বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষে কাজ চলছে বলে জানান। পরিচালক কারিগরি জানান, একটি প্রকল্পের আওতায় বরিশালের রূপাতলী সাব-স্টেশনটি পুনর্বাসন কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। উপরন্তু নবগ্রাম রোডসহ মহানগরীতে আরো ২টি ৩৩ কেভী সাব-স্টেশন নির্মাণ করা হবে বলেও জানান। পাশাপাশি বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়নে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা জানিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো ধরনের অবহেলা সহ্য করা হবে না বলেও জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন