গ্যাস বিদ্যুতের অভাবে দেশের শিল্পকারখানা যখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম; তখনই আবারো বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়লো ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ইউনিট প্রতি ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আগামী ডিসেম্বর মাস থেকেই নতুন এই মূল্য কার্যকর হবে। এই দাম পুনঃনির্ধারণের ক্ষেত্রে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ দাম বাড়ানোর পরও বিদ্যুতের উৎপাদন পর্যায়ে ভর্তুকি ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেবে সরকার বলেও জানিয়েছে কমিশন। এই দাম বৃদ্ধির ফলে এখনই গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে না। তবে নতুন দাম বিবেচনায় শিগগিরই বিতরণ কোম্পানিগুলো কমিশনের কাছে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে।
পাইকারি দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এদিকে গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রস্তাব তৈরি করছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যমূল্য আরও বেড়ে যাবে এবং জনগণের জীবনে দুর্গতি নেমে আসবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যুতের দাম বাড়লে সবধরনের পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় পণ্যমূল্য দফায় দফায় বেড়েছে। এতে খেটে খাওয়া মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। জ্বালানি সঙ্কটের কারণে কলকারখানায়ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম বাড়লে কৃষি ও কলকারখানায় উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এতে টালমাটাল হতে পারে গোটা বাজার ব্যবস্থা।
গতকাল সোমবার বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির করে ঘোষণা দিয়েছেন বিইআরসি চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল। এতে প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা করা হয়। সংবাদ সম্মেলন উপস্থিত ছিলেন, সদস্য আবু ফারুক, সদস্য মকবুল ই ইলাহী, সদস্য বজলুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। গত দেড় মাস আগে এ ধরনের প্রস্তাব নাকচ করেছিল বিইআরসি। সে সময় দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভালো না থাকায় এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সরকারের ওপর মহল আগ্রহ না দেখানোয় দাম বাড়েনি। এখন বিদ্যুতের লোডশেডিং নেই। পাশাপাশি আইএমএফের চাপ রয়েছে। তাই দাম বাড়ানো হচ্ছে। পাইকারি দাম বাড়লো ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ইউনিট প্রতি ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি।
এ দিকে বিইআরসির পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর সচিবালয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আপাতত বাড়ছে না, তাই উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সারা পৃথিবীতেই বিদ্যুৎ-জ্বালানির প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হচ্ছে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি নির্ভর করছে মাঠপর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, বিইআরসি তাদের মতো করে বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগে তারা ঘোষণা দিয়েও দাম বাড়ায়নি। সবকিছু তারা যাচাই-বাছাই করেই করেছে।
কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়লেও এখনই গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো সম্ভব নয়। বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রস্তাব দিলে তা যাচাই-বাছাই করে শুনানি করা হবে। এরপর সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
বিইআরসি গত ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দর ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করেছিল। এরপর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গত ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করে। ১৮ মে তাদের প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়। শুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে। প্রায় ৫ মাস পর গত ১৩ অক্টোবর বিইআরসি জানায়, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ও যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারায় পিডিবির আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। পিডিবি জানিয়েছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের লোকসান ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক ক্ষতি ৩১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা লোকসান হতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই লোকসান হয়েছে ৮ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ ভর্তুকির অর্থ ছাড় না করায় বেসরাকরি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রায় ৫ মাসের বিল বকেয়া পড়েছে। গত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেন্টাল-কুইক রেন্টাল ও আইপিপিগুলো পিডিবির কাছে ৩৩ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা পাবে।
এর আগে ১৩ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, পিডিবি যে প্রস্তাবনা দিয়েছে তা অস্পষ্ট ছিল। তবে আজকের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আপত্তি থাকলে তারা রিভিউ আবেদন করতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদেরও নিজেদের সব তথ্য স্পষ্ট ও নতুন করে উত্থাপন করে রিভিউ আবেদন করতে হবে। তারপর আইন যা বলে আমরা সেটিই করব। এ নিয়ে আরেকটি গণশুনানিও হতে পারে বা সরাসরি বিবেচনায়ও আনা যেতে পারে। গত ২ নভেম্বর পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগ এবং ৬ নভেম্বর বিইআরসির সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকা সফরকারী আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এ সময় বিদ্যুতের দাম, ভর্তুকি ও পিডিবির লোকসান নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর কমিশনের আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করে পিডিবি।
বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির ১৪-১৫ টাকা খরচ হচ্ছে। তাই দিন দিন লোকসান বাড়ছে সংস্থাটির। পিডিবি জানিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের লোকসান ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় লোকসান। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) লোকসানের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। এদিকে পাইকারিতে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এমন খবরে বিতরণ কোম্পানিগুলোও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন তৈরি করছে। পাইকারি বিদ্যুতের দর যতটুকু বাড়বে, তা ধরেই গ্রাহক পর্যায়ে মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে ৬ বিতরণ কোম্পানি। এসব প্রস্তাবের ওপর শুনানি করে নতুন মূল্য ঘোষণা করবে বিইআরসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন