সকলেই জানেন, কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ডিজেল ও কেরোসিনের দাম একলাফে লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়। এরপর বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। আবাসিক খাতে গ্যাসের দুই চুলার জন্য ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৮০ টাকা ও এক চুলার জন্য ৯২৫ টাকার স্থলে ৯৯০ টাকা করা হয়। সিএনজি বাদে গ্যাসের অন্যান্য খাতেও দাম বাড়ানো হয়। এর জের চলতে থাকার মধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। আগামী মাসেই বিদ্যুতের নতুন মূল্য নির্ধারণ ও কার্যকর হতে পারে। বলা বাহুল্য, এটা একটা চেইন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে গ্যাসের দাম বাড়বে। আবার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে তথাকথিত গণশুনানির আয়োজন করার প্রথা চালু আছে। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে এবার গণশুনানি হয়নি। গ্যাসের গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারী ক্রেতারা দাম না বাড়ানোর পক্ষে মত দিলেও সে মত পাত্তা পায়নি। কর্তৃপক্ষীয় ইচ্ছা কার্যকর হয়েছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও ‘না’ বলা হয়েছে। কিন্তু কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, বিদ্যুতের দাম বাড়ছেই। কত বাড়ছে? ইনকিলাবে প্রকাশিত খবর মোতাবেক, সেটা ইউনিট প্রতি তিন টাকার কম নয়। বিপিডিবি প্রস্তাব দিয়েছে, পাইকারি মূল্য প্রতি ইউনিট দু’ টাকা ৯৯ পয়সা বাড়াতে। অর্থাৎ এখনকার পাঁচ টাকা ১৭ পয়সার জায়গায় প্রতি ইউনিটের দাম দাঁড়াবে আট টাকা ২৬ পয়সা। বিপিডিবি’র মতে, গ্যাসের বর্তমান দাম বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুতের এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এখাতে সরকার ভর্তুকি দিলে অবশ্য বর্তমান দামই অপরিবর্তিত থাকবে। এতদিন সরকার এই টাকাটাই ভর্তুকি দিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর একটি বক্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, আমাদের মূল্য সমন্বয়ের দিকে যেতে হবে। সরকার আর কতদিন ভর্তুকি দিয়ে চালাবে? এভাবে ভর্তুকি দিয়ে চলতে পারে না।’ অতএব, প্রতিমন্ত্রীর কথায় এটা পরিষ্কার, সরকার পারতপক্ষে ভর্তুকি দিতে আর রাজি নয়, তা জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেই হোক, গ্যাসের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা বিদ্যুতের ক্ষেত্রেই হোক।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বড় আকারে বেড়েছে। সরবরাহও স্বাভাবিক জায়গায় নেই। এমতাবস্থায়, সব দেশেই জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মজুদ, সরবরাহ কমেছে, সংকট বেড়েছে, দামও বেড়েছে অধিকাংশ দেশে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল বা উপকরণ হিসাবে জ্বালানি তেল ও গ্যাস ব্যবহৃত হয়। কয়লাও ব্যবহৃত হয়। কয়লার দামও বেড়েছে। বলা যায়, সবদেশই বিদ্যুৎ উৎপাদন অধিক ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানো ছাড়া উপায় কী? আবার এও সত্য, দু’ বছরের অতিমারি এবং রাশিয়ায়-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতি এবং মানুষের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে যে-কোনো ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি অনাকাঙ্খিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে লক্ষ্য রেখেই কিছুদিন আগে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র তরফে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছিল, দাম বাড়ানো ‘আত্মঘাতী’ হবে। বাস্তবতা তো এই যে, দেশের অর্থনীতির পুনর্গঠনের কাজ সবে শুরু হয়েছে। এসময় জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে এই পুনর্গঠন কাজ ব্যহত হবে, শ্লথ হবে এবং কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে জনগণের জীবনযাত্রা আরো দুর্বহ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে, সাধারণ মানুষ চোখে সরষে ফুল দেখছে। প্রতিদিন সকালে-বিকালে পণ্যদির দাম বাড়ছে। বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলো যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছে। মানুষ অসহায়, নিরালম্ব। বিদ্যুতের দাম যখন কার্যকর হবে তখন সব জিনিসের দাম আরো একদফা বা একাধিক দফা বাড়বে। সাধারণ মানুষের জীবনধারণ ও বেঁচেবর্তে থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে মানুষের কষ্ট, দুর্ভোগ ও ক্ষোভ শেষ সীমায় এসে উপনীত হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি তাকে আরো বাড়াবে। এটা সরকারের জন্য খুব সুখকর হবে না। সামনে জাতীয় নির্বাচন, সেটাও সরকারকে মনে রাখতে হবে। উন্নয়নের চেয়ে মানুষের স্বস্তি, শান্তি, ও নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। সে বিবেচনায় সরকারকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। এখাতের ভর্তুকি বা লোকসান কমাতে বিকল্প পথ বেছে নিতে হবে। বিদ্যুতের চুরি, অপচয় ও সিস্টেম লস কমাতে হবে। যতটা প্রয়োজন, বিদ্যুৎ ততটাই উৎপাদন করতে হবে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের ঝামেলা মেটাতে হবে, যাতে এখানে আর এক পয়সাও দিতে না হয়। আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দিতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব ব্যবস্থা নেয়া হলে যে অর্থ ও সম্পদ সাশ্রয় হবে, তাতে বিদ্যুতের নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। সরকারের ভর্তুকি দেয়ারও প্রয়োজন হবে না। হলেও কম দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, জনস্বার্থে এ ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা ও নীতি-প্রথা সব দেশেই আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন