স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর ধানমন্ডির কনকর্ড আর্কেডিয়া শপিং সেন্টারে রাজউকের নকশা অমান্য করে ল্যাব এইড হাসপাতাল গড়ে তুলেছে। নকশা বহির্ভ‚ত এই হাসপাতাল ভেঙে ফেলতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একইসাথে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে নকা বহির্ভ‚ত স্থাপনা অপসারণেরও নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া কনকর্ড আর্কেডিয়া শপিং সেন্টারে দোকানের জায়গায় হাসপাতাল করার সময় ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে ভাঙচুর করায় ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ কারণে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা অথবা ভবনটি ধসে বহু প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে আতঙ্কে রয়েছেন ওই ভবনের ব্যবসায়ীরা।
কনকর্ড আর্কেডিয়া শপিং সেন্টারে ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়, ধানমন্ডির মিরপুর রোডে ২০০২ সালের ২ নভেম্বর ছয় তলা বিশিষ্ট শপিংমলটি উদ্বোধন করেন কনকর্ড গ্রæপের চেয়ারম্যান এ এস এম কামাল উদ্দিন। রাজউক অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নীচ তলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনড মার্কেট এবং ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা অফিস বøক হিসেবে ব্যবহার করার কথা। রাজউক অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী কনকর্ড কনডোমিনিয়াম লিমিটেড প্রায় ২০০ ব্যক্তির কাছে নীচ থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত বেশির ভাগ দোকান বিক্রি করে। বাকি দোকানগুলো কনকর্ড কনডোমিনিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আমমোক্তারের মালিকাধীন অংশ। একইভাবে ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলায় অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মালিকরা কিনে নেন। কিন্তু শপিংমলটি উদ্বোধনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে ২০০৪-২০০৫ সালে পার্শ্ববর্তী ল্যাব এইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কনকর্ড কনডোমিনিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর শওকত আলীর যোগসাজসে মার্কেটটির ৩য় ও ৪র্থ তলায় ১০২টি দোকান কিনে নেয়। এছাড়া তারা ৫ম তলার উত্তরাংশের অফিস স্পেসও কিনে নেয়। ১ম ও ২য় তলার ১২টি দোকানও কিনে নেয়। এসব দোকান ও অফিস স্পেস কিনে দীর্ঘ প্রায় ৮/১০ বছর ধরে তা তালাবদ্ধ রেখে ল্যাব এইড কর্তৃপক্ষ মার্কেটটিতে ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে। যার ফলে শপিং সেন্টারে থাকা অন্যান্য দোকান মালিকরা ক্রমাগত লোকসানের মুখে পড়েন। মার্কেটের ৩য় ও ৪র্থ ফ্লোর দুটির সমুদয় দোকান এবং ৫ম তলার উত্তরাংশের অফিস স্পেস ক্রমান্বয়ে ভেঙে রাজউকের অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে তা হাসপাতালে রূপান্তর করে পার্শ্ববর্তী ল্যাব এইড হাসপাতালের সাথে একীভ‚ত করে নেয়। এ সময় হাসপাতালের দুই অংশে চলাচলের জন্য শপিংমলের মধ্যেস্থিত ৩য়, ৪র্থ, ৫ম তলায় ৩টি সংযোগ ব্রিজ তৈরি করে। এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বাথরুম, সিড়ি ও পশ্চিম পার্শ্বে থাকা দুটি ক্যাপসুল লিফটের সামনে অবস্থিত কমন এরিয়া বেআইনিভাবে দখলে নিয়ে নেয়।
রাজউক অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী শপিং সেন্টারের প্রতিটি ফ্লোরে ক্রেতাদের চলাচলের সুবিধার্থে এক্সেলেটর চালু থাকলেও ল্যাব এইড কর্তৃপক্ষ ৩য় ও ৪র্থ তলার ৪টি এক্সেলেটর অপসারণ করে সেখানে ছাদ নির্মাণ করে হাসপাতালের ফ্লোরে রূপান্তর ঘটায়।
কনকর্ড মার্কেটের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সিড়ির মুখে ইটের দেয়াল গড়ে তোলে। পশ্চিম পাশের দুটি ক্যাপসুল লিফটের সামনেও একইভাবে দেয়াল নির্মাণ করে। এছাড়া ২য় তলায় ক্রয়কৃত চারটি দোকান ভেঙে এ বছরের জানুয়ারি মাসে শপিং সেন্টার কল্যাণ সমিতির বাধা উপেক্ষা করে সেখানে রাজউক অনুমোদিত নকশা বহির্ভূত দোকানের স্থলে ডেন্টাল ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে। এ ক্লিনিকে ল্যাব এইড কর্তৃপক্ষ কনকর্ড শপিং মলের বিদ্যুত ও পানির লাইন ব্যবহার করে আসছে। শপিং সেন্টার কল্যাণ সমিতির নিষেধ সত্তে¡ও তারা গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ডেন্টাল ক্লিনিকের জন্য আলাদা তিনটি এসির আউটলেট স্থাপন করে। এ সময় শপিং সেন্টারের পক্ষে বাধা দিলে ল্যাব এইডের অফিস কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সিকিউরিটির লোকজন কনকর্ড শপিং সেন্টারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় বাদী হয়ে শপিং সেন্টার কল্যাণ সমিতি পরদিন ধানমন্ডি মডেল থানায় জিডি করে। যার নং-৭১৭।
এদিকে রাজউকের নকশায় থাকা দোকানের জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণ করতে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করায় ৫ম তলায় অবস্থিত আশেপাশের অফিস স্পেসগুলোতে ফাটল দেখা দিয়েছে। নকশা বহির্ভূত কর্মকান্ডের বিষয়টি অবগত হয়ে রাজউক ২০১১ সালের ১১ অক্টোবর ল্যাব এইড কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেয়। এতে বলা হয়, মার্কেটের জায়গায় হাসপাতাল করা ইমরাত নির্মাণ আইনের ১৯৫২ এর ৩বি ধারার পরিপন্থি। এজন্য অবৈধ ভাবে নির্মিত হাসপাতাল কেন ভেঙে অপসারণের আদেশ দেয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয় ওই কারণ দর্শানোর নোটিশে। কিন্তু ল্যাব এইড কর্তৃপক্ষ এর সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় রাজউক ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি চূড়ান্ত নোটিশ জারি করে। এতে সাত দিনের মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিজেদের অর্থায়নে অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় রাজউক। অন্যথায় রাজউক নিজেই হাসপাতাল ভেঙ্গে অপসারণ করবে বলে চূড়ান্ত নোটিসে জানানো হয়।
কিন্তু এরপর দীর্ঘ সময় পার হলেও অদৃশ্য কারণে ভবনের নকশা বহির্ভূত অংশ ভাঙতে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ কিংবা রাজউক কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ কারণে শপিং সেন্টার কল্যাণ সমিতি আদালতের দারস্থ হন। আদালত ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষের অনুক‚লে শপিং সেন্টারের ২৩ টি দোকানের মালিকানা ও রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে রাজউকের অনুমোদিত প্লানের বাইরে হাসপাতালের রূপান্তর না করার আদেশ দিয়ে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। বর্তমানে ওই ২৩টি দোকান বন্ধ রয়েছে। এ ঘটনায় শপিংমল কল্যাণ সমিতি ও ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষের মধ্যে নানা রকম ঝামেলা দেখা দেয়। ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে ৩য় ও ৪র্থ তলায় নকশা বহির্ভূত দোকানের স্থলে হাসপাতাল ও টয়লেট নির্মাণের কারণে তাদের ব্যবহৃত টয়লেট থেকে পানি পড়ে নীচের দোকানদারদের ক্ষতি হতে থাকলে ভুক্তভোগী দোকান মালিকরা স্ব স্ব উদ্যোগে স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর শপিং সেন্টার কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে রাজউকের নকশা বর্হিভূত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। এর প্রেক্ষিতে বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো: খসরুজ্জামানের আদালত কনকর্ড শপিং সেন্টারে গড়ে তোলা নকশা বহির্ভ‚ত স্থাপনা (হাসপাতাল) কেনো ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন এবং পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে তা অপসারণে নির্দেশ প্রদান করেন। মামলায় বিবাদী করা হয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান, ডিপিডিসি, ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস, ধানমন্ডি থানাসহ সংশ্লিষ্টদের।
শপিং সেন্টার কল্যাণ সমিতির সভাপতি সানাউল হক নীরু বলেন, ভবনটির নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও আমমোক্তার কনকর্ড কনডোমিয়াম লিমিটেড ২০১০ সালের ১ ফেব্রæয়ারি সমিতির কাছে শপিংমলের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তর করে। তখন থেকে শপিংমলের দোকান ও অফিস মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে শপিং সেন্টার কল্যাণ সমিতি। কিন্তু ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে দোকান কিনে নিয়ে রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে হাসপাতাল নির্মাণ করেছে। দোকান ভাঙার কারণে শপিং সেন্টারের বিভিন্ন ফ্লোরে (অফিস স্পেস) ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে পাশের ভবন থেকে বিদ্যুৎ ও পানির লাইন এনে দীর্ঘদিন ধরে তা ব্যবহার করছে। এ ব্যাপারে ডিপিডিসি ও ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে বার বার অবহিত করা হলেও তারা এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা ন্য়েনি। ল্যাবএইডের কাছে সার্ভিস চার্জ বাবদ শপিং মলের গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন কোটি ৩১ লাখ ৭৫ হাজার ৮২৪ টাকা পাওনা থাকলেও ল্যাবএইড তা পরিশোধ করতে নানা প্রকার টালবাহানা করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এ ব্যাপারে ল্যাব এইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আবু মোহাম্মদ শামীমের সাথে টেলিফোনে অনেকবার যোগায়োগের চেষ্টা করেও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। ল্যাব এইড গ্রæপের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার আব্দুল মোতালেবের সাথে যোগায়োগ করলে তিনি এ বিষয়টি দেখেন না বলে জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন