মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

নিবন্ধ

যুব সমাজকে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম


মোহাম্মদ আবু তাহের : তারুণ্যের উদ্দীপনাই সুস্থ সমাজের চাবিকাঠি। সকল কাজে তরুণ ও যুবসমাজকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। বিশ্বায়নের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যুগে তারুণ্যের শক্তি সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। যুবসমাজকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য সকলের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণে একে আমাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। তারুণরাই একটিভ সিটিজেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি গঠনমূলক সমাজ গঠনে তরুণদের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বিশেষ করে সমাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এখন অনেক দেশের জন্য উদাহরণ। কিন্তু বিপরীত চিত্র দেখা যায় দেশের উচ্চ শিক্ষিত যুবসমাজের চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। এদেশে বেকারত্বের হার বেশি, যারা সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত। অধিকাংশ শিক্ষিত বেকার যুবক চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছন ঘুরার কারণে বেকারত্ব বেড়েই চলছে দ্রæত গতিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপের ২০১৩ সালের হিসেবে বেকারত্বের হার ছিল ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে তা আরও বেশি।
আমাদের উচ্চ শিক্ষিত অপার সম্ভাবনাময় যুবসমাজের এই বাস্তবতা সত্যিই মর্মস্পর্শী। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতে, দেশের শ্রমবাজারে মানবসম্পদের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণের কাজটি প্রথমে করা দরকার। কোন খ্যাতে কি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকবল কতসংখ্যক দরকার তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। তিনি পেশাভিত্তিক ও কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপর জোর দিয়েছেন। পলিটেকনিক ইন্সিটিটিউট, নার্সিং ইন্সিটিটিউট, ভোকেশনাল ইন্সিটিটিউট আরও বেশি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তাছাড়া তৈরি পোশাক, পোল্ট্রি শিল্প, ফিসারিজসহ বিভিন্ন উৎপাদন ও পেশামুখী খাতের জন্য দক্ষ লোকবল গড়ে তোলার জন্য আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হল, দেশে বেকারত্বের সংখ্যা দুই কোটিরও বেশি যা অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান।
একবিংশ শতাব্দীর এই পৃথিবীতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজগঠন ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে জ্ঞানের ভিত্তিতে বিপুল জনগোষ্ঠী বা যুবসমাজকে উৎপাদনশীল জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। ডিজিটাল বাংরাদেশের যে স্বপ্ন বর্তমান সরকার মানুষকে দেখিয়েছে তা আসলেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনেরই স্বপ্ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে দেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করতে হলে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। যুবসমাজ শুধুমাত্র চাকরির পেছনে না ঘুরে যাতে উদ্যোক্তা হতে পারে সেজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ আরও বেশি জোরদার করা দরকার। টেকসই উন্নয়নে উদ্যোক্তাদের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। আমাদের দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ তরুণ। আমরা যদি আমাদের তরুণ ও যুবসমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে পারি তাহলেই দেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। উদ্যোক্তারা যেকোন দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। উন্নত দেশের সফলতার ইতিহাস মূলত সৃষ্টিশীল উদ্যোক্তাদের সক্রিয় ও গঠনমূলক ভ‚মিকারই ইতিহাস।
লাখ লাখ মানুষের মনে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন জাগাতে বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের ও যুবসমাজের অহংকার সিলেটের সন্তান ব্রিটিশ উদ্যোক্তা সাবিরুল ইসলাম তার নিজ মাতৃভ‚মি বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যতিক্রমী বক্তব্য দিয়েছেন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যার কাছে মানুষের হসিমাখা মুখ। পৃথিবীজুড়ে তিনি তারুণ্যের স্বপ্নের কথা বলে যান। বিশ্বজুড়ে সাবিরুল তারুণদের আইকন। সাবিরুল বলেন, “নিজের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগাতে পারলে সাফল্য নিশ্চিত। বিশ্বাস রাখতে হবে নিজের উপর। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করাটা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। তাতে নিজের স্বকীয়তাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। সফল হতে হলে থাকতে হয় অদম্য ইচ্ছা শক্তি।” সফলতা লাভের জন্য বিনয়ী হতে হয়। সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য তিনি সাতটি মূলমন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন :
১। সবসময় ইতিবাচক থাকতে হবে।
২। লক্ষে অবিচল থাকতে হবে।
৩। স্বাধীন ও মুক্তভাবে চিন্তা করতে হবে।
৪। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
৫। কেন কি করছি সেই উদ্দেশ্য ঠিক রাখতে হবে।
৬। ধৈর্য ধরতে হবে এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার চেষ্টা করতে হবে।
৭। টাকা-পয়সা নয় মানুষই সবচেয়ে বড় সম্পদ। কাজেই মানুষের উপর আস্থা রাখতে হবে এবং মানুষকে সম্মান দিতে হবে।
বাংলাদেশ বিপুল সম্ভাবনার দেশ। বাংলাদেশের যুবসমাজ অন্য যে কোন দেশের চেয়ে উন্নত মানসম্পন্ন, সাহসী, পরিশ্রমী এবং গুণসম্পন্ন। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলেই দেশ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না। বাংলাদেশের তরুণেরা স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানামুখী প্রতিভা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। সামাজিক উদ্যোক্তা ও তারুণ্যনির্ভর। ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা হলো- এমন একজন ব্যক্তি, যিনি কর্মী হিসেবে কাজ করার বদলে একটি ব্যবসা চালাতে পারেন যা সম্পূর্ণরূপে তার সৃজনশীলতা, একান্ত পরিশ্রম ও সাধনার ফল। এক্ষেত্রে তাকে ব্যবসায়ীক ঝুঁকি ও সফলতা সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে।
আমাদের দেশে অধিকাংশ যুবক উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবতে পারে না। এটা প্রকৃত পক্ষে তাদের দোষ নয়। পারিপার্শ্বিক চিন্তা-ধারণা তাকে এভাবে তৈরি বা প্রস্তুত করে রেখেছে। ব্যবসায়িক চিন্তা-ধারণা তাদের মাথায় আসে না তারা শুধু একজন চাকরিজীবী হওয়ার কথা ভাবতে পারেন। আমাদের মনে আরেকটি ধারণা কাজ করে যে, শুধুমাত্র ধনী হলেই ব্যবসায়ীক উদ্যোক্তা হওয়া যায়। এমন ধারণা থেকে শিক্ষিত অনেক যুবক চাকরির পেছনে হন্যে হয়ে ছোটে। কিন্তু বেশিরভাগ যুবক চাকরি পায় না এবং একসময় তাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সও চলে যায়। শুরু হয় হতাশা। নিজের সম্ভাবনাগুলোকে কাজে না লাগিয়ে নিজের জীবনকে ব্যর্থ জীবন হিসেবে ভাবতে শুরু করে। যারা এরকম হতাশার মধ্যে জীবন ধারণ করছে এবং যারা সত্যিকার অর্থে সৎভাবে কিছু করে আত্মসম্মানের সঙ্গে জীবন ধারণ করতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এমন হাজার হাজার ব্যবসায়ী আছেন অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সদস্য হয়েও শত প্রতিক‚লতার মাঝে তারা থেমে থাকেন। সফল ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হলে কিছু গুণাবলী প্রয়োজন। যা হল-
১। সঠিক কাজ নির্বাচন করা।
২। নিজের কাজের প্রতি আস্থাশীল হওয়া।
৩। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
৪। সঠিকভাবে অর্থ ব্যয় করা।
৫। সকল ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা।
৬। ক্রেতার সন্তুষ্টি বুঝতে পারা।
সফলতা পেতে হলে বা সফল উদ্যোক্তা হতে হলে নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শিখতে হবে। নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানালে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। জীবনকে পাল্টিয়ে দেওয়া সম্ভব। মনে রাখতে হবে সবসময় লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে, তাই বলে থেমে যাওয়ার সুযোগ নেই। নিজেকে বলতে হবে যে আমি এটা পারি। আর যতক্ষণ পর্যন্ত কাজটি শেষ হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত লেগে থাকতে হবে।
যুবসমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে পারলেই দেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। কারিগরি শিক্ষায় স্নাতক বা স্নাতকোর্ধ্ব এবং উচ্চশিক্ষত বেকার যুবকদের যারা উদ্যোক্তা হতে চান তাদের সহজ শর্তে স্বল্প সুদে সরকার ঋণদানের সুযোগ করে দিতে পারে। এতে করে বেকারত্ব হ্রাস পাবে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, দেশের অর্থনীতি টেকসই ও মজবুত হবে, বাড়বে জাতীয় আয়।
যুবসমাজকে মনে রাখতে হবে, জীবনে যেকোন প্রতিক‚লতা আসুক না কেন কোন ভাবেই হতাশ হওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি প্রতিক‚লতা প্রতিটি সমস্যা নতুন সুযোগ নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, জীবন সবসময় সহজভাবে চলে না। জীবন রেললাইন না। জীবন হচ্ছে নদী, জীবন হচ্ছে ঝর্ণা, জীবন হচ্ছে আকাবাঁকা পথ। যারা রাজপথে চলে তাদের জীবনে অনেক সময় কোন অর্জনই থাকে না।
আত্মবিশ্বাসের অভাবে জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আত্মবিশ্বাসহীনতা মানুষকে কর্মবিমুখ করে তোলে। নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। সকল ক্ষেত্রে সফল হতে হলে পাঁচটি গুণ অর্জন করতে হবে, যা হল:
১। শুকরিয়া।
২। মনছবি বা ভিশন।
৩। ছাদাকা বা দান (একটি ভালো কথাও ছাদাকা হতে পারে)।
৪। ছবর বা ধৈর্য।
৫। সৎপথে থাকা/ সামাজিক সংগঠনে যুক্ত থাকা।
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি পারমানবিক বিজ্ঞানী এ পি জে আব্দুল কালাম বাংলাদেশের তরুণদের উদ্দেশ্যে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন- ‘আমরা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে মূলত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোকপাত করছি, তা হল-
১। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
২। জ্ঞান আহরণ করতে হবে বিরতিহীনভাবে।
৩। অনেক বড় সমস্যা আসলেও জীবনের লক্ষ্য থেকে সরে না আসা।
৪। কোনো কাজের সাফল্য ও ব্যর্থতা নেতৃত্বগুণে সামাল দিতে পারা।
৫। সবসময় জীবনে আরো বড় লক্ষ্য রাখা। মনে রাখবে ছোট লক্ষ্য রাখা অপরাধের সমান।
৬। অব্যাহতভাবে জ্ঞান আহরণ করতে হবে এবং সমস্যা সমাধানে অধিনায়ক হতে হবে।
৭। সমস্যাকে কখনও নিজের উপর চেপে রাখা যাবে না।
৮। যত কঠিন সময় আসুক না কেন কখনও হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না
৯। সবাইকে মনে রাখতে হবে, মানুষ যেন আমাকে স্মরণ রাখে।
১০। নিজেকে অনন্য সাধারণ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
১১। মনে রাখতে হবে তোমার চারপাশের পৃথিবী তোমাকে সর্বদা সাধারণের কাতারে নিয়ে আসার চেষ্টায় লিপ্ত।
১২। নিজের একটি দিনও যেন বৃথা মনে না হয় সে চেষ্টা করতে হবে।’
তরুণ ও যুবকদের অবশ্যই উচ্চ আকাক্সক্ষা থাকতে হবে। উঁচু মানের বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। নিজের অগ্রগতি ও এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা থাকতেই পারে। বাধা দূর করার জন্য অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায় থাকতে হবে। মানুষের অপার সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত কবি জালাল উদ্দিন রূমি’র একটি বিখ্যাত কবিতা
“I will fly and fly” উদ্বৃত করছি:-
I’m born with potential,
I’m born with goodness and trust,
I’m born with ideas and dreams,
I’m born with greatness,
I’m born with confidence,
I’m born with wings,
So I’m not meant for crawling,
I have wings, I will fly ,
And I will fly and fly.

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট এবং সভাপতি
ব্যাংক অফিসার্স এসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন