মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

নিবন্ধ

এসব নাকি ভূতের সেতু

| প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : সেখানে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। আশেপাশে নেই কোনো লোকালয়। কৃষক ও কৃষিশ্রমিকরা প্রয়োজনে মাঠে যাওয়া আসা করে জমির আইল দিয়ে। প্রয়োজন নেই কোন রাস্তার। তবুও সেখানেই নির্মাণ করা হয়েছে সেতু। সংযোগ সড়ক, রাস্তা ও প্রয়োজন ছাড়া অর্থহীন এ ধরনের সেতু নির্মাণ করায় বিভিন্ন স্থানের জনগণ ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে নাম দিয়েছেন ‘ভূতের সেতু’ বলে। তাছাড়া নেতা ও কর্মকর্তারা এতো নদী-খাল কোথায় পাবেন ব্রিজ/কালভার্ট করতে? এজন্য ফসলের মাঠের মধ্যে অথবা বিরাণ ভূমি, কি সেতুর দুই মাথায় ধান খেত থাকার পরও ‘ভূতের সেতু’ নির্মাণের সু-কীর্তি রেখে চলেছেন!
অনেকের মতে, যে পরিমাণ টাকা দিয়ে অহেতুক সেতু নির্মাণ করা হয় তা দিয়ে এলাকার ভাঙা রাস্তা মেরামত করলে মানুষ বছরব্যাপী দুর্ভোগ থেকেও রক্ষা পেত। যেখানে সেখানে অপ্রয়োজনীয় এসব ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণে নদীর গতিপথ বন্ধ ও সংকুচিত হওয়ার সাথে কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। আর নির্মাণের নামে তছরুপ হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার পশ্চিম বজরা গ্রামের মুহুরী বাড়ির সামনের ব্রিজটি যেন মরণফাঁদ। বজরা, শীলমুদ ও সাকিরপুর গ্রামের একমাত্র সংযোগ সড়কের এ ব্রিজটির গত এক বছর পূর্বে মূল ফটক ভেঙে পড়ে যায়। হাজার হাজার মানুষের চলাচলের একমাত্র ব্রিজটির এ অবস্থায় চরম দুর্দশায় জীবনযাপন করছে এলাকাবাসী। প্রতিদিন এ ব্রিজ দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শত শত ছাত্রছাত্রীর ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। এলাকাবাসী অসুস্থ হলে জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাওয়ার জন্য কোনো যানবাহান পাওয়া যায় না। এমনকি এলাকার আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে পুলিশ সময় মতো পৌঁছাতে বিড়ম্বনার শিকার হয়। একমাত্র সড়ক এটি হওয়ায় উপজেলা শহর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে গ্রামগুলোর বাসিন্দারা।
বরগুনার বেতাগী টাউন ব্র্রিজ অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু না হওয়ায় পৌরবাসীকে চরম ভোগান্তিসহ ঘটছে প্রায়ই দুর্ঘটনা। জানা গেছে, টাউনব্রিজ নির্মাণের দীর্ঘদিন পর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উদ্যোগে নির্বাহী প্রকৌশল অধিদপ্তর বরগুনার আওতায় পল্লী সড়ক ও কালভার্ট মেরামত কর্মসূচির অধীনে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শুরুর দিকে টাউন ব্র্রিজ অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ কাজের দরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু আজো ঠিকাদার কাজটি শুরু না করায় স্থানীয়দের যাতায়াতে কষ্টের শেষ নেই। সবচেয়ে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে শিশু, গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধ ও মালামাল পরিবহনকারীদের। স্থানীয়দের অভিযোগ, মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে টাউনব্রিজ নির্মাণ করা হলেও অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ না হওয়ার কারণে সে সুবিধা ভোগ করতে পারছে না মানুষ।
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর (দক্ষিণ) ইউনিয়নের নলডগী গ্রামে ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালের জুন মাসে সেতুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলেও সেতুর দুই পাশে নেই রাস্তা। কে বা কারা এই সেতু নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করেছেন, স্থানীয় বাসিন্দারা জানে না। তাদের অভিমত, লেদি খালের ওপর যে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, এর জন্য গ্রামবাসী কোনো প্রস্তাব কিংবা আবেদন করেনি। বরং এই সেতু নির্মাণের কারণে তাদের ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ফসল নষ্ট করা হয়েছে। এলাকার মানুষের চলাচলের জন্য পূর্ব থেকেই কয়েক দিক দিয়ে রাস্তা আছে। তারা আরো জানায়, সংযোগ সড়কের নামে আমাদের ফসলি জমির ওপর দিয়ে কোনোভাবেই রাস্তা তৈরি করতে দেয়া হবে না। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আওরঙ্গজেব যা মন্তব্য করেন তা রীতিমত হাস্যকর, তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এলাকাবাসীর চলাচলের জন্য সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর চাইতে বেশি কিছু আমি জানি না।
রাজশাহীর তানোরে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ও নকশায় সংযোগ সড়কের স্থান না রেখেই কেবলমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় নেতার ইচ্ছেপূরণ করতে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু-কালভার্ট নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণের মধ্যে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংযোগসড়ক ছাড়াই প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন খাঁড়ির ওপর ৬টি সেতু-কালভার্টের নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন ও নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছে। জানা যায়, উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যন্ত এলাকায় খাঁড়ির উপর ৬টি সেতু নির্মাণে তালিকা প্রস্তুত করে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরে পাঠানো হয়। ওই তালিকা অনুযায়ী নকশা অনুমোদন করে গত বছরের ৫ অক্টোবর ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর হতে দরপত্র আহবান করা হয়। স্থানীয়রা জানায়, সরেজমিন তদন্ত করলেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে, এসব সেতু নামের কালভার্ট কেবলমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্মাণ করা হচ্ছে। এদিকে এসব সেতু-কালভার্ট নির্মাণের ব্যয়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা গেছে। উপজেলা এলজিইডি’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের অর্থ লোপাটের জন্যই সংশ্লিষ্ট বিভাগ তিনগুন বেশি অর্থ ব্যয়ে সেতুর নামে এসব কালভার্ট নির্মাণ করছে। তিনি বলেন, এসব সেতু নামের কালভাট নির্মাণে কোনোভাবেই ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হবে না।
এছাড়াও বাঁধাইড় ইউপির গাল্লা-প্রকাশনগর খাড়ির ওপর সেতু নির্মাণ কাজ চলছে। সেতুর উভয়পাশে বিস্তর ধান খেত রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, এই সেতুর পাশেই মাত্র দু’শ হাত দূরে একই খাঁড়ির ওপর সেতু ও সড়ক রয়েছে। অযথায় এই সেতু নির্মাণ না করে সেই টাকা ব্যয়ে এলাকার ভাঙা রাস্তা মেরামত করা হলে তা মানুষের কাজে আসত। ঠিক একই অবস্থা কলমা ইউপির বলদিপাড়া-মোয়াতলা খাড়ির ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পে। এই সেতুর দুই পাশেই বনবিভাগের বিপুলসংখ্যক ঔষুধী ও বনজগাছ বাগান রয়েছে। এছাড়া পাঁচন্দর ইউপির বনকেশর-মরাপাড়া খাঁড়ির সেতুর দু’পাশেই ধান খেত। একই ধরনের অবস্থা সরনজাই ইউপির কাজিজিয়া-বিল্লী খাড়ির ওপর মুকুলের জমির নিকট সেতু নির্মাণ প্রকল্পে। এখানেও সংযোগসড়ক ছাড়াই সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কনকদিয়া ইউনিয়নের আমিরাবাদ ও বীরপাশা— এই দুই গ্রামের মধ্যবর্তী খালটি পুনঃখননের কাজে ব্যাপক অনিয়মের পুকুরচুরি হয়েছে! স্থানীয় কৃষকরা জানায়, খাল খনন করা হয়েছে কৃষকদের উপকারের জন্য। সঠিকভাবে খনন না করায় উপকারের চেয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বেশি। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আইএপিপি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ওই খননকাজ করে।
একটি বিশেষ গোষ্ঠি লুটপাটের জন্যই শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ ধরনের প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে সেতু নির্মাণ করে। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বব্যাংকের সূদভিত্তিক অর্থায়নের সুষ্ঠু ব্যবহার না হওয়ায় এর দায়ভার জনগণের উপর বর্তায়। আমাদের দেশের প্রতিটি শিশুর আজ জন্মই হচ্ছে ঋণের দায়ভার নিয়ে। সেতু নির্মাণের অজুহাতে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারদের সরকারি অর্থ আত্মসাতের চেষ্টাই শুধু কাজ। এসব প্রকল্প সাধারণ মানুষের কোন কাজে আসছে না। বাঁধ, ব্রিজ, কালভার্টের কাজ বাস্তবায়নের জন্য কার্যাদেশপ্রাপ্ত অধিকাংশ ঠিকাদার নিজেরা কাজ না করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেসব দলের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দেয়। আর সাব-কন্ট্রাক্টররাও ক্ষমতার জোর ও জবাবদিহীতার কোন বালাই না থাকায় দায়সারাভাবে নিন্মমানের সামগ্রী ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি বিপুল অর্থ লুটপাঁট করছে। নির্মাণ কাজে কালর্ভাটের ড্রইং পরিবর্তন, উচ্চতা কমিয়ে ফেলা, গাইডওয়াল না দেয়া, নিন্মমানের রড ও পাথর ব্যবহার, নিয়মানুসারে সিসি ঢালাই না করাসহ শিডিউলমতে পাইলিং না করে নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখায় ধসে পড়ার ঘটনাও ঘটছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন