সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

নিবন্ধ

হাওরের দুর্যোগ লাঘবে কার্যকর উদ্যোগ চাই

| প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : মানুষ মানুষের জন্যে। জীবন জীবনের জন্যে। একটু সহানুভ‚তি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু! ভ‚পেন হাজারিকার গানের এই লাইনগুলোর প্রতিচ্ছবি আজ বাংলাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হচ্ছে। একটি বিপদের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি বিপদ নতুন করে আশার আলোকে নিভিয়ে দুঃস্বপ্নের অন্ধকার সাগরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অন্যায়-অবিচার আর জুলুমের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে শুধুমাত্র এক আল্লাহ বিশ্বাসী মুসলমানদের ওপর। আজকের দুনিয়াতে যত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তা সবই মানুষের দুই হাতের কামাই। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সূরা আর রোম-এর ৪১ আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলেস্থলে (সর্বত্র) বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, (মূলত) আল্লাহতায়ালা তাদের কিছু কাজকর্মের জন্যে তাদের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাতে চান, আশা করা যায় (এর ফলে) তারা সেসব কাজ থেকে ফিরে আসবে। মহান আরশের অধিপতির নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন দয়া করে আমাদের দোষ-ত্রæটিকে ক্ষমা করে গজবের হাত থেকে আমাদের এই প্রিয় দেশটাকে রক্ষা করেন। একটা সময় চীনের দুঃখ হিসেবে হোয়াং হো নদীর কথা শোনা যেত। এখন আর তেমনটা শোনা যায় না। কারণ চীন নদী শাসনের মাধ্যমে সেই দুঃখ ঘুচিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ঠিক তার উল্টো। বন্যা আসে বন্যা যায় তবু বন্যা প্রতিরোধে কার্যকরী উদ্যোগ দেখা যায় না। এ বছরের কথা না হয় বাদই দিলাম। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে আমাদের হাত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকা তলিয়ে যায়। অথচ তার প্রতিকার যেভাবে হওয়া উচিত ছিল সেভাবে ক্ষমতাসীন শাসকেরা করেনি। যে কারণে প্রতিবছরই লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রবল বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল আর অকাল বন্যায় পুরো হাওরাঞ্চলে বোরো ফসল তলিয়ে তা পচে পানিতে সৃষ্ট বিষাক্ত গ্যাসে মরে যাওয়া মাছ খেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস মারা যাওয়ায় কৃষক ও খামারিদের মাথায় বাজপড়ার অবস্থা হয়েছে। এই প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে হতাশায় নিমজ্জিত বিপর্যস্ত লাখো কৃষক চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছে। অপ্রত্যাশিত আগাম বন্যার পানিতে হাওরের মানুষ এখন দিশেহারা। হাওরাঞ্চলে প্রতিরক্ষা বাঁধ একের পর এক ভেঙেই চলেছে। অসহায় কৃষকের আর্তনাদে আকাশ ভারি হয়ে উঠলেও সমাজপতি আর ক্ষমতাবানদের সাহায্যের হাত যেভাবে প্রসারিত হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি। বিভিন্ন হাওরে বিপুল পরিমাণ মাছ মরে ভেসে উঠেছে। মৎস্য সম্পদের এমন ক্ষয়ক্ষতির কারণেও বিপন্ন কৃষকের মাছ ধরে সংসার চালানোর বিকল্প আয়ের পথটি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বোরো চাষিদের সহায়তায় সরকারিভাবে বলা হয়েছে, প্রতি মাসে পরিবারপ্রতি ৩০ কেজি চাল ও ৫শ করে টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু নানা রকম দুর্নীতির জাল ডিঙিয়ে তার কতটুকু তাদের হাতে গিয়ে পৌঁছবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। কিন্তু তারা তো এভাবে বাঁচতে চায় না, কারো কাছে হাত পাততে চায় না। শ্রমে-ঘামে ফলানো ফসল দিয়েই তারা যতটুকু সম্ভব সম্মানের সঙ্গে জীবন পরিচালনা করতে চায়। কিন্তু পারছে না কেন? স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা মিলে বাঁধ মেরামতের কোটি কোটি টাকা গায়েব করে দেওয়ার ফলে তাদের এই দুরবস্থা। সবকিছু হারিয়ে যখন হাওরের মানুষ বাঁচার লড়াইয়ে যুদ্ধ করছে তখন সরকারের এক আমলা যা বলেছেন তা কৃষকের কাটা ঘায়ে নুন ছিটানোর শামিল। গত বুধবার সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বলেছেন, এই বন্যায় কোথাও একটি ছাগলও মরেনি। এ ধরনের গাজাখুরি কথা সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকতা-কর্মচারীর কাছ থেকে জনগণ প্রত্যাশা করেনি। যে দেশের জনগণের করের টাকায় তাদের বেতন হয় সে দেশের জনগণের দুর্ভোগে এমন হাস্যকর বক্তব্য খুবই বেমানান।
হাওরাঞ্চলে বিপর্যয়ের দীর্ঘছায়া অনুপ্রবেশ করেছে। এর বিরূপ প্রভাব ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অসহায় মানুষগুলোর কান্নার আওয়াজ ইথারে ইথারে ভাসলেও শাসকগোষ্ঠীর টনক নড়েনি। কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকায় কৃষকরা এখন সর্বস্ব হারিয়ে দিশাহারা। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার পেছনে যাদের অবদান অনস্বীকার্য সেই কৃষকদের হাহাকার আর কান্নার রোল কান পাতলেই শোনা যায়। ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হাওরবাসীর দুঃখ-দুর্দশার যে মর্মন্তুদ চিত্র ফুটে উঠেছে তা সত্যিই বেদনাদায়ক। যে কৃষক ক্ষেতে কাঁচা ধান দেখে রাতে ঘুমাতে গিয়েছিল সকালে উঠে দেখে তার সব ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। যে ফসল আর কদিন পরেই ঘরে তোলার ধুম পড়ত সে ফসল আজ চোখের সামনে বিলীন হয়ে গেল। দেশের বড় একটি অংশের মানুষের বসবাস হাওরাঞ্চলে এবং তাদের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। হাওরাঞ্চলের কৃষি মূলত এক ফসলের। অর্থাৎ বোরো ধান উৎপাদনের মধ্যেই তাদের কৃষিকাজ সীমাবদ্ধ। বিপন্ন-বিপর্যস্ত কৃষকরা এখন মহাজনের দেনা পরিশোধ করার ভয়ে শঙ্কিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তাদের পাশে দাঁড়ানোর যেন কেউ নেই। প্রতি বছর হাওর রক্ষা বাঁধের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও আখেরে কোনো ফল মেলে না। হাওর রক্ষা বাঁধ নিছক শুধুই বাঁধ বললে ভুল হবে। এর সঙ্গে কোটি কোটি হাওরবাসীর অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। বাঁধ না টিকলে হাওরের ফসল ঘর পর্যন্ত পৌঁছে না। আর ফসল ঘরে না পৌঁছলে এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব কতটা প্রকট হয়ে ওঠে কিংবা উঠতে পারে তার দৃষ্টান্ত তো আমাদের সামনেই রয়েছে। হাওরাঞ্চলকে বাংলাদেশের শস্যভাÐার বিবেচনা করা হয়। বোরো ধানের প্রায় এক চতুর্থাংশই উৎপন্ন হয় হাওর এলাকায়। ওই সব এলাকার কৃষকের একমাত্র ফসল হচ্ছে বোরো। এবার আগাম বন্যায় হাওরের বোরো ধান প্রায় সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে।
প্রকৃতির কাছে সবকিছুই অসহায়। প্রকৃতির বৈরিতায় নিঃস্ব এখন হাওরের মানুষ। শুধু ধান জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে তা কিন্তু নয়! বিষাক্ত পানিতে টনের পর টন মাছ মরে গেছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে একজন বয়োঃবৃদ্ধ কৃষক তার দুঃখ-কষ্টের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন- ‘মনে কয় পানিতে ঝাঁপ দিয়া মইরা যাই, পোলাপাইন লইয়্যা এখন কেমনে চলুম, কী খাওয়ামু।
কৃষকের কল্যাণে অনেক কথা শোনা যায় কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কতটা হয় তা তো বিদ্যমান পরিস্থিতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করছি সরকার দ্রুত বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে হাওরবাসীর কান্না থামানোর জন্য উদ্যোগী ভ‚মিকা পালন করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন