মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৫ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

নিবন্ধ

বালাকোটের চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবু নোমান : মর্দে মুজাহিদ সাইয়েদ আহমদ বেরলভী (রহ.)কে নিয়ে ইসলামি রেনেসার কবি ফররুখ আহমদ তার কালজয়ী কবিতায় ‘রায় বেরেলীর জঙ্গি পীর’ আখ্যা দিয়ে লিখেন- সবাই যখন আরাম খুঁজে/ ছুটে ঘরের পানে। জঙ্গী পীরের ডাক শোনা যায়/ জঙ্গের ই ময়দানে। সবাই ভাবে পীরের কথা/ শুনেছি তো ঢের। এমন পীরের কথা তো ভাই/ পাইনি কভু টের।
গভীর রাতে প্রকৃত আল্লাহওয়ালাদের দুচোখে যেমন অশ্রæ ঝরে ঠিক তেমনীভাবে দিনের আলোতে তার তরবারিতে ইসলাম ও মুসলমানের দুশমনদের রক্ত ঝরে। বেরলভী (রহ.) [জন্ম- ২৯ নভেম্বর ১৭৮৬] শুধু তসবিহ হাতে ও জায়নামাজে থেকে মুরিদানকে নিয়ে খানকায় বসে থাকেননি, নিজের সুখ-শান্তি ত্যাগ করে যুদ্ধের ময়দানে এসে একদল বিশুদ্ধ আত্মার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী বাহিনী নিয়ে সিংহের মত গর্জে উঠেছেন।
১৮৩১ সালের ৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট প্রান্তরে ইংরেজ ও শিখ মিত্র বাহিনীর সাথে জিহাদ করে এক অসম যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের আযাদি আন্দোলনের অকুতোভয় সিপাহসালার, ঈমানি চেতনার প্রাণপুরুষ, ইমামুত তরিকত, যামানার শ্রেষ্ট মুজাদ্দেদ এবং যুগের শ্রেষ্ট বুজুর্গ ও পীর, অলিয়ে কামেল, আমীরুল মু’মিনীন হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) এবং তার কতিপয় সহযোদ্ধা। তার শাহাদত ছিল ব্রিটিশ এবং তাদের মিত্র শিখদের অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বেরলভীর প্রতিষ্ঠিত তরীকা, তরীকায়ে মোহাম্মদীয়া মানুষকে দেখিয়েছে একটি আলোকোজ্জ্বল পথ।
একথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, বদর, ওহুদ, কারবালার সূত্রধরেই ও বালাকোটের শহীদদের প্রেরণায় ভারতে মুসলমানগণ আজাদী আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথক আবাসভূমি লাভে উজ্জীবিত হয়েছিলেন।
পরাধীন ভারতবাসীর কেউই তখনো ব্রিটিশদের শাসন ও শোষণ থেকে রক্ষার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেনি। সাধারণ মানুষ কখনই ভাবতো না তারা ব্রিটিশদের জুলুম, নির্যাতন ও শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারবে। এমনই এক সময় বেরলভীর আর্ভিভাব ঘটেছিল যখন ভারতের মুসলমানদের উপর ইংরেজ, শিখ ও হিন্দুদের অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যুলুম-নির্যাতন এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, যালিমরা মুসলিম নারীদের দাসীরূপে ব্যবহার করত। ফসলাদি নষ্ট ও ঘরবাড়িতে আগুন দেয়াসহ সীমান্তের মসজিদগুলোকে মন্দির ও ঘোড়ার আস্তাবলে পরিনত করেছিল। সর্বোপরি একদিকে মুসলমানরা বিধর্মীদের হাতে লাঞ্চিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত হচ্ছিল অন্যদিকে বৃটিশ, হিন্দু ও শিখদের প্রভাব প্রতিপত্তির ফলে নিজস্ব তাহজিব, তামাদ্দুন তথা মূল আদর্শ, সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে পাশ্চাত্য ও হিন্দুয়ানি আদর্শ, সংস্কৃতি গ্রহণ করা শুরু করেছিল।
এমনকি বিভিন্ন এলাকায় মুসলমানরা হিন্দুদের পোশাক, পরিচ্ছদ ব্যবহার করাসহ তাদের নামের পূর্বে ‘শ্রী’ শব্দ পর্যন্ত ব্যবহার করত। ঠিক সেই মুহুর্তে আজাদী আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সিপাহসালার, শহীদে বালাকোট, আওলাদে রাসুল সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)।
বেরলভী (রহ.) এর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন রায়বেরেলীতেই শুরু হয়। ১৩ বছর বয়সে পিতার ইন্তেকালের পর ভারতের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শাহ ইসহাক দেহলভী (রহ.) এর কাছ থেকে ইলমে শরীয়তের পান্ডত্ব অর্জন করেন। পরবর্তিতে অনেক দুর্গম পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে দিল্লিতে এসে ইমামুল মুহাদ্দিসীন, শায়খুল মাশায়েখ আব্দুল আযিয মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। বেরলভী (রহ.) অতি অল্পদিনেই ইলমে তাসাউফের সু-উচ্চ মাকামে আরোহন করেন এবং শাহ সাহেব (র.) তাকে খিলাফত দান করেন। খিলাফত লাভের পর বেরলভী (রহ.) কঠিনভাবে রিয়াজত, মুশাক্কাতে আত্মনিয়োগ করায় ইলমে বাতিনের সকল মাকামই তার আয়ত্ব হয়েছিল অতি সহজে। তার পীর হযরত শাহ সাহেব (রহ.)’র নিকট কোন লোক মুরিদ হতে আসলে তিনি তাদের হযরত বেরলভীর (রহ.) নিকট পাঠিয়ে দিতেন এবং বলতেন, আমার কাছ থেকে ১২ বছরে যা হাসিল করতে পারবেনা, বেরলভীর কাছ থেকে ১২ দিনে তা আয়ত্ব করতে পারবে।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের (৭১২ খ্রিস্টাব্দ) পর আফগান শাসক সুলতান মাহমুদ বারংবার ভারত আক্রমণ করে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম থেকে নবাব সিরাজ উদদ্দৌলা পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার বছর মুসলমানগণ এই উপমহাদেশে শাসন কার্য চালিয়েছেন।  পরবর্তীতে মুসলিম শাসক ও সমরবিদগণ নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে বিলাসিতা, ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। মুসলমানরা শুধু রাজ্য হারায়, আপন দ্বীন ও সিরাতে মুস্তাকীম থেকে বহু দূরে সরে পড়ে। তারা বিদেশি বেনিয়াদের মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হবার পরিবর্তে এক জন অন্য জনের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে বিদেশিদের সাহায্য কামনা করতে থাকে। এ সুযোগে ইংরেজ ও ফরাসীগণ ভারতে তাদের সম্রাজ্যবিস্তারের প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে।
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে ইংরেজগণ বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে শঠতার মাধ্যমে পরাজিত করে বাংলাসহ গোটা উপমহাদেশ তারা পদানত ও জোরজবরদস্তিমূলক আধিপত্যবাদী শাসন কায়েম করে। যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং অন্যদিকে মুসলিম সমাজের ইসলামী জীবনাচরণে ব্যাপক অনৈসলামিক আক্বীদা, বিশ্বাসের দুর্বল অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এতে করে এ অঞ্চলে এক সর্বব্যাপী সংস্কারমূলক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যায়। সেই আসু বিপ্লবের হাতছানিই যেন সাইয়েদ আহমাদ শহীদের ‘তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়া’ আন্দোলনের হাত ধরে উপমহাদেশের শিরক, বিদআতী জঞ্জালের অন্ধকার গহŸরে তাওহীদী নবপ্রভাতের সূচনা ঘটায় তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়া। তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়া হলো চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নক্সবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদীয়া তরিকার সার নির্যাস। অধ্যাপক এইচ. রহমান সম্পাদিত ‘ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে সাইয়েদ সাহেব (রহ.) এর প্রতিষ্ঠিত তরিকায়ে মুহাম্মদীয়াকে ‘সংস্কার আন্দোলন’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ আছে : ‘ভারতের মুসলমানদের জাগরণ ও স্বাধীনতার জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন তাদের মধ্যে শাহ সৈয়দ আহমদ বেরলভীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য’। উপমহাদেশে তাসাওউফের এই বিপ্লবী সিলসিলা এগিয়ে নেন কারামত আলী জৌনপুরী, সুফি ফতেহ আলী এবং ফুরফুরার পীর আবু বকর সিদ্দীকী ও ছারছীনার পীর নেছার উদ্দিন আহমদ (রহ.) প্রমুখ।
উচ্চ পাহাড়ঘেরা দূর্গম ঐতিহাসিক বালাকোট শহরটি পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খাইবার-পাখতুনখাওয়ার (সাবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) হাযারা অঞ্চলভুক্ত মানসেহরা জেলা থেকে ৩৮ কি.মি. পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে শহরটি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে সউদী আরব, আরব আমিরাত ও পাকিস্তান সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় শহরটি আবার গড়ে তোলা হয়।
সৈয়দ আহমদের বাহিনীর সাথে ইতোপূর্বে কয়েকটি যুদ্ধে শিখ ও ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত হয়। সম্মুখ সমরে মুজাহিদ বাহিনীর সাথে টিকে উঠা সম্ভব নয় ভেবে বৃটিশ ও শিখ নরপতিগণ ক‚টকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলমান সমাজে বিশ্বাসঘাতক তথা মোনাফেকদের অভাব কোন কালেই ছিল না। সীমান্তের প্রধান জমিদার ও গোত্রপতিগণকে ইংরেজ ও শিখ শাসকেরা বিভিন্ন প্রকার লোভ দেখিয়ে বশীভূত করে ফেলে। তারা মুজাহিদদের যাবতীয় তথ্যাদি ইংরেজ ও শিখদের নিকট গোপনে সরবরাহ করতে থাকে এবং সুসংগঠিত মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ভাঙন সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে সৈয়দ সাহেবকে ইউরোপীয়দের মোকাবেলা করতে হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন তাদের সূর্য মধ্যগগণে। প্রায় সমগ্র বিশ্বকে তারা কব্জা করে ফেলেছিল। এর বাইরে সেখানে ছিল স্বার্থপর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিশ্বাসঘাতক সরদার ও তাদের অনুসারীরা। ফলে ক্ষুদ্র অথচ পর্বতসম ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান মুজাহিদ বাহিনীর চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে।
ইংরেজ বাহিনী মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সীমান্তবর্তি মুসলমান নামধারী পাঠান ও শিখ সর্দারদের মোজাহীদ বাহিনীর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে লাগিয়ে দেয়। অবশেষে ১৮৩১ ঈসায়ী সনের ৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোটের ময়দানে অপ্রস্তুত মোজাহীদ বাহিনীর উপর পাঠান, শিখ, ইংরেজ, মুনাফেক বাহিনী হামলা করে। উল্লেখ্য যে, মুজাহিদ যোদ্ধা ছিল ৭শ’ এবং শিখ সৈন্যদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। যুদ্ধে ৩শ’ মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন আর শিখ সৈন্য নিহত হয়  প্রায় ১ হাজার জন। মুজাহিদদের সংখ্যাস্বল্পতা ও রসদপত্রের অপ্রতুলতা যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করলেও পরাজয়ের মূল কারণ ছিল মুসলিম নামধারী মুনাফিকদের বিশ্বাসঘাতকতা। যেসব সামন্ত ও খানরা শিখবাহিনীর হাত থেকে তাদেরকে রক্ষার জন্য সাইয়েদ আহমদকে আহ্বান করেছিল তারা পরবর্তীতে মুসলমানদের সাহায্য না করে গোপনে শিখদের সাথে হাত মেলায়। শিখবাহিনী যখন মেটিকোটে আরোহনের চেষ্টা করছিল তখন সেখানে পাহারায় থাকা মুজাহিদ বাহিনীতে অনুপ্রবেশকারী কিছু মুনাফিক তাদেরকে গোপন পথ বাতলে দেয়। এই চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা না করলে শিখবাহিনী মেটিকোটে প্রবেশ করতে পারত না। এছাড়াও হাযারার এক উপজাতীয় প্রধান শিখদের বালাকোটের সাথে সংযুক্ত পাহাড়ের উপরিভাগে উঠার গোপন পথের সন্ধান দেয়।
সৈয়দ বেরলভী পাঠান নেতা সুলতান মুহাম্মদ খাঁ ও তার ভাইদের বিশ্বাস করে পেশোয়ারের প্রশাসক বানান। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে ইসলামী হুকুমতের ক্বাযী, তহসিলদারসহ বহু উঁচুস্তরের মুজাহিদকে এক রাতে শহীদ করেছিল। এছাড়াও কিছু পাঠান জিহাদ করার চেয়ে লুটপাটে আগ্রহী ছিল। দরিদ্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাঠানরা অনেক ক্ষেত্রে শরিয়তি আইনের চেয়ে স্থানীয় কবিলার প্রচলিত আইন পালন করত বেশি। সৈয়দ বেরলভী এগুলো সম্পর্কে শরিয়তের আলোকে ফয়সালা দিলেও পাঠানদের মনঃপূত হতো না।
ইসলামবিরোধী ও ইউরোপীয় সম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে ভারতকে উদ্ধার করে ইসলামী হুকমতের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছিলেন বেরলভী (রহ.)। তিনি বিদেশী আগ্রাসী শক্তি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাত থেকে জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উপমহাদেশের মজলুম জনতাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। আযাদী আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই ছিল এদুটি। আজও তার ত্যাগ ও কুরবানী মুসলমানদের অনুপ্রেরণার অনস্বীকার্য উৎস। বর্তমান সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সমগ্র মুসলমানদের বালাকোটের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া জরুরি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন