শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

ইসলামি লিপিকলা

| প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুজিবুর রহমান মুজিব
ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গঁ জীবন বিধান। মনব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ-বিবর্তন ও অগ্রাভিযানের ইতিহাসে ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান স্বীকৃত, খ্যাত। মুসলিম পন্ডিত-দার্শনিক-আলেম-ওলামা-জ্ঞানী-গুনীজন যেমনি শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, স্থাপত্যশিল্পে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন ঠিক তেমনি ইসলামী লিপিকলায় ও মুসলমানদের অনুপম অবদান অনস্বিকার্য।
আরবি বর্নমালাকে কেন্দ্র করেই ইসলামি লিপিকলার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ। আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি, আরবি লিপি-বর্ন হরফ-জের-জবর-পেশের সঙ্গে মুসলিম জাহানের একটি আলাদা আবেগ-অনুভূতি-স্বকিয়তা-বৈশিষ্ট-স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। আরবি পবিত্র আল কোরআনের ভাষা। আরবি ইসলাম ধর্মের প্রচারক-মহামানব মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) এর মাতৃভাষা, আরবি ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ সঃ) এরও ভাষা। আরবিতেই আল্লাহর ফেরেশতা মহানবীকে বলেন ‘ইকরা বিসমি রাব্বুকাললাজি খালাক্ক-খালাকাল ইনসানা মিন আলাক।’ এই আরবি ভাষা ও সংস্কৃতিও খুবই প্রাচীন। কথিত আছে, মানবজাতির আদি পিতা ও আল্লাহর নবী আদম (আঃ) আরবি, সিরীয় ও অন্যান্য বর্নমালার উদ্ভাবন করেন। হযরত আব্দুল্লা বিন আব্বাসের বর্ণনা মতে, হযরত ইসমাইল (আঃ) মাত্র চৌদ্দ বছর বয়েস থেকেই আরবি বর্নমালায় লিখন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। কারো কারো মতে, হযরত ইদ্রিস (আঃ) আরবি লিখন পদ্ধতির প্রবর্তক। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে আরবি লিপিকলা মুসলিম জাহান কর্তৃক স্বীকৃতি। ইসলামিক লিপিকলার ইতিহাসে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক একটি চির স্মরণীয় ও শ্রদ্ধেয় নাম। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রীয় কাজে রোমান ও পারসিক হরফের পরিবর্তে আরবি হরফ ব্যবহার করায় ইসলামি লিপিকলার স্বর্ণযুগের শুভ সূচনা হয়। ঠিক তেমনি আব্বাসীয় শাসনামলে ও আরবি লিখন পদ্ধতির প্রচলন ছিল।
আরবি লিপি কলার বিকাশের আরো কিছু ধর্মীয় কারণও বিদ্যমান ছিল। মুসলিম সমাজে জানদার প্রানির ছবি তথা চিত্র অংকন নিষিদ্ধ হওয়ায় মুসলমান লিপি কলাবিদগন ধর্মীয় কারনেও পবিত্র আল কোরআনের ভাষা আরবি হরফে সৃজনশীল-শিল্পসম্মত লিখন পদ্ধতি তথা ইসলামিক ক্যালিওগ্রাফিতে আত্মনিয়োগ করেন। রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রশংসাপ্রাপ্ত হন। চিত্রশিল্পের চাইতে ইসলামিক লিপিশিল্পও ছিল সহজ, সরল, মার্জিত, রুচিশীল।
মুসলিম লিপিকলাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বিভাগত্রয় হল: ১. কুফি বা কুফিক রীতি, ২. নাসখ রীতি, ও ৩. নাসতালিক রীতি। কুফিক রীতি আরবি লিপির প্রধান ও প্রাচীন রীতি। প্রাচীন ইরাকের ঐতিহাসিক কুফা- নগরে এই রীতির উদ্ভব বলে এই পদ্ধতি কুফিক পদ্ধতি নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে খ্যাত ও স্বীকৃত মেসোপটেমীয় সভ্যতা বিশে^র একটি প্রাচীন সভ্যতা। এই মেসোপিটেমীয় লিখন পদ্ধতির অনুকরণে কুফিক রীতির বিকাশ। প্রাক ইসলামি এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই পদ্ধতির প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। খোলাফায়ে রাশেদীনের অন্যতম শ্্েরষ্ট খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) এর শাসনামলে কুফিক রীতি সর্বপ্রথম সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে লোক প্রিয়তা অর্জন করে। কুফিক লিপি কলার বিকাশে খলিল ইবনে আহমদ, আলী ইবনে কুশাইর, আসওছাদ কুতুবাই প্রমুখ লিপিকারকগন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও অবদান রাখেন বলে জানা যায়। নাসখ রীতি কুফিক রীতির পরিবর্তিত আধুনিক রূপ ও পদ্ধতি। হিজরি চতুর্থ সন থেকে এই পদ্ধতি প্রচলিত ও ব্যবহৃত। মুসলিম লিপি শিল্পের ইতিহাসে নাসখি পদ্ধতির আবির্ভাব এক রেঁনেসা যুগের সূচনা করে। এই লিপি শিল্পের প্রধান শিল্পি ছিলেন ইয়াকুত মুসতা সিমি। তাঁর লিপিকলা সমগ্র মুসলিম জাহানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাব্রিজি চিত্র কলার প্রধান চিত্রকর খাজামীর আলী উদ্ভাবিত আরবি লিপি কলার অনুপম ও আধুনিক পদ্ধতি- নাসতালিক রীতি- ইসলামি লিপিশিল্পকে নবতর রূপ প্রদান করেছে। আরবি লিখন পদ্ধতির নাসখ আর পারসিক পদ্ধতির তালিকের সমন্বিত সৌন্দর্য মন্ডিত রূপ ও নামই নাসতালিখ রীতি। তাজ সুলমানী নাসতালিক রীতির ব্যাপক অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
ইতিহাসের আলেচিত ও স্বীকৃত সত্য যে, ক্যালিওগ্রাফি বা লিখন শিল্পের ইতিহাসে মুসলমানদের অবদান ঐতিহাসিক। অনুপম, অপরিসীম। পৃথিবীর কোন সভ্যজাতি মুসলমানদের মত লিপিশিল্প-লিপিকলার ইতিহাসে অবদান রাখতে পারেন নি। চীন, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইটালিতে লিপি শিল্পের চর্চা থাকলেও আরবি লিপি কলা ও লিপি শিল্পের মত উন্নত শিল্পশৈলিও শ^াস্বত সৌন্দর্য কোথাও দৃষ্ট হয় না। মানব সভ্যতার লিপি কলার ইতিহাসে ক্যালিওগ্রাফিতে ইসলামি লিপিশিল্পের অনুপম অবদান ঐতিহাসিক।
দু:খ ও দূভাগ্যজনকভাবে উল্লেখ করতে হয়, বিরান্নব্বই ভাগ মুসলমানদের দেশে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী মোতাবেক রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও ইসলামী এই ঐতিহ্যের চর্চা নেই, চালু নেই। প্রয়োজনীয় বই পুস্তক নেই। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীন আর্ট ইন্সটিটিউট ইসলামি লিপিকলা ক্যেলিওগ্রাফির কি চর্চা হয় দেশবাসী জানেন না। ইসলামি লিপিকলার চর্চা ও চালুর মাধ্যমে ভূত-প্রেতের ছবির পরিবর্তে আরবি হরফ দ্বারা ইসলামি লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা কি আমাদের অন্ধকার ভূবনকে আলোকিত করতে পারিনা ? ধর্ম মন্ত্রনালয়, ইসলামি ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের কি কিছু করার নেই ?
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
তানভীর সিরাজ ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১:০০ এএম says : 0
চমৎকার বিষয়। পরিশেষে লেখকের প্রকাশিত ব্যথা বাস্তব চিত্র ধারণ করেছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। আমি ইনকিলাবের এক লেখক ও পাঠক হিসাবে এ বিষয়ে তুলনামূলক আরও প্রবন্ধ চাই।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন