মহিউদ্দিন খান মোহন : আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অতি সা¤প্রতিক আলোচনায় স্থান দখল করে নেয়া প্রাণী তিনটি কারো অপরিচিত নয়। এগুলোর মধ্যে একটি গৃহপালিত, বাকি দু’টি বন্য। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘কাক’ এবং ‘ফার্মের মুরগী’কে রাজনীতির মঞ্চে টেনে এনে সরস আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। আর বর্তমান সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপি’র বিশেষ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপন এনেছেন ‘ইঁদুর’কে। মজার ব্যাপার হলো, এরা দু’জনই স্ব স্ব রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সাবেক সভাপতি। ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আর আসাদুজ্জামান রিপন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের। রাজনীতিতে ঢুকে পড়া অবাঞ্ছিতদের চিহ্নিত করতে সাবেক এ দুই ছাত্রনেতার প্রায় একই ধরনের উদাহরণ ব্যবহার কাকতালীয় কি না তা অবশ্য হলফ করে বলা যাবে না। তবে, তাদের চিন্তা চেতনায় যে এক ধরনের সাযুজ্য রয়েছে সেটা বোধকরি অস্বীকার করা যাবে না।
গত ২২ মার্চ সিলেটে এক সভায় ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগে কাউয়া ঢুকে পড়েছে। তিনি আওয়ামী লীগ ও মুজিব পরিবারের নামে গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেই বলেছিলেন কথাটা। সে সময় তার ওই মন্তব্য গণমাধ্যমসহ সর্বস্তরে ব্যাপক আলোচনা-বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। কথা উঠেছিল ওই সব সংগঠন ও সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘নেতাদের’ কাজকর্ম নিয়ে। ক্ষমতাসীন দলের ছায়ায় থেকে এবং নাম ব্যবহার করে অনৈতিক ফায়দা লুটার বিষয়টি উঠে এসেছিল আলোচনায়। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়-এর নাম সংবলিত শতাধিক সংগঠনের নামের তালিকাও পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। শোনা গিয়েছিল ওইসব ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে সাঁড়াশী অভিযান চালাবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দু’ মাস পার হওয়ার পরও এরকম কোনো অভিযানের খবর পাওয়া যায় নি। এরপর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সিলেটে কাউয়া বলেছিলাম। এখানে কাউয়া বলব না। মনে হয় ফার্মের মুরগি ঢুকেছে। ফার্মের মুরগির দরকার নেই। দেশি মুরগি দরকার। ফার্মের মুরগি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না’। তার সে বক্তব্যও বেশ আলোড়ন তুলেছিল। নিজ দলের মধ্যে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতা নামধারীদের ইঙ্গিত করেই তিনি বলেছিলেন কথাটি। অবশ্য আলোচনা-সমালোচনার ঝড়ের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল কাদের পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছেন। সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছেন দলের নেতাকর্মীদের ‘কাউয়া’ কিংবা মুরগী না লিখতে। গত ১৯ এপ্রিল ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমন্ডলীর বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন- ‘মাফ চাই, প্লিজ আপনারা আর কাউয়া-মুরগি লিখবেন না।’ তবে, তিনি এখন যতই কাউয়া-মুরগি না লিখতে অনুরোধ করুন না কেন, প্রসঙ্গ এলেই সবাই যে তা ব্যবহার করবে এটা নিশ্চিত। কেননা, একবার যেটা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, শত চেষ্টায়ও সেটাকে মুছে ফেলা যায় না। তার অনুরোধে সাংবাদিকরা যদি লীগ দলীয় কর্মী ক্যাডারদের প্রসঙ্গে ‘কাউয়া’-‘মুরগি’ শব্দ দু’টি ব্যবহার নাও করেন, তাতে কিন্তু আওয়ামী লীগ ঝাড়া মোছা পরিষ্কার হয়ে যাবে না। কারণ, কাউয়া আর মুরগিরা বহাল তবিয়তে থেকেই যাবে।
এবার আসা যাক ইঁদুর প্রসঙ্গে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সঙ্গে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলাপকালে বিএনপি’র বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, ‘বিএনপিতে ইন্দুর (ইঁদুর) ঢুকেছে। সেই ইন্দুর এখন দলের ভিতরে বাইরে সমানভাবে কুট কুট করে কাটছে’। রিপন বলেছেন, ‘এই ইন্দুরের কথা চাউর হয়ে গেছে। এমন কি এখন সারাদেশে দলীয় নেতা-কর্মী সমর্থকদের মুখে মুখেও। বিশেষ করে চেয়ারপারর্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এর বেশি প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।’ এ সমস্যার সমাধান কী, এর জবাবে রিপন বলেছেন ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব আওয়ামী লীগে যে কাউয়া আর মুরগির কথা বলেছেন সেগুলো তো ঠিকমতো ঢিল ছুঁড়লেই তাড়ানো সম্ভব। কিন্তু বিএনপির এই ‘ইন্দুর’ তাড়ানো তো অত্যন্ত কঠিন। এগুলো দলের ভেতরে গর্ত করে এমনভাবে লুকিয়ে থেকে কুট কুট করে কেটে চলেছে যে, এর মধ্যেই দল ও নেতা-কর্মীদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সহজে এদের ধরা কিংবা তাড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন ৩০ এপ্রিল ২০১৭)।
অনেক কথাই শোনা যায় বিএনপিতে শক্ত অবস্থানে থাকা ওইসব ক্ষমতাধর ‘ইদুঁর’ সম্পর্কে। এরা নাকি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যদের চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখেন। শোনা যায়, চেয়ারপার্সন স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সুপারিশ বা পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু এসব ইঁদুরের পরামর্শ ফেলে দিতে পারেন না। তাদের পরামর্শেই নাকি বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে যায়নি, ২০১৫ সালের অপরিণামদর্শী ‘লাগাতার অবরোধ’ কর্মসূচিতে আটকা পড়েছিল। এসব ‘ইদুঁরে’র বিরাগভাজন হয়ে অনেক নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী বিএনপির বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরা যাকে তাদের স্বার্থের পথে কাঁটা মনে করে, তীক্ষè দাঁতের কামড় বসিয়ে দেয় তার শরীরে। ধেঁড়ে ইঁদুরের কামড়ের তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সংশ্লিষ্টরা দল থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়াকেই শ্রেয় মনে করেন। এভাবেই এক সময়ের সজীব সতেজ দল বিএনপি ক্রমশঃ নির্জীব হয়ে পড়ছে।
‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ গল্পের কথা তো আমরা সবাই জানি। সেই যে, যার বাঁশির সুরে পাগল হয়ে শহরের সমস্ত ইঁদুর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নদীতে। বিএনপিতে অবস্থান নেয়া কথিত ‘ইদুঁর’ তাড়াতে সেরকম একজন বাঁশিওয়ালার বড্ড প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু কোথায় সে বাঁশিওয়ালা? কবে আসবেন তিনি? মি. আসাদুজ্জামান রিপন কী সে বাঁশিওয়ালাকে খুঁজে বের করতে পারবেন?
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন