স্টাফ রিপোর্টার : আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের আপোষহীন রাজনীতিক বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি শফিউল আলম প্রধান আর নেই। গতকাল রোববার রাজধানীর আসাদ গেটেস্থ নিজ বাসভবনে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী এই নেতা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন। ইন্না নিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তিনি গত দুদিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। এর আগে একাধিকবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রধানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়-স্বজন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আসাদগেটস্থ বাসায় ছুঁটে আসেন। সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তাঁর মৃত্যুতে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, বিকল্পধারার সভাপতি সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা দৌধুরী, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২০ দলীয় জোটের নেতা এবং দেশের ইসলামী ধরার দলগুলো শোক প্রকাশ করেছেন।
জাগপা সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার লুৎফর রহমান জানান, গতকাল বাদ জোহর আসাদ গেট দলীয় কার্যালয়ের সামনে মরহুমের প্রথম নামাজের জানাযা শেষে মরহুমের লাশবাহী গাড়ী গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পথে নির্বাচনী এলাকা দিনাজপুরে ইনস্টিটিউট মাঠে রাত সাড়ে আটটায় দ্বিতীয় জানাযা এবং জন্মস্থান পঞ্চগড়স্থ নিজ শহরের চিনিরকল ময়দানে রাত ১১টায় তৃতীয় নামাজের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। আজ বাদ আছর বায়তুল মোকারম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে চতুর্থ নামাজের জানাযা শেষে বনানী কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হবে।
জাগপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শফিউল আলম প্রধানের জন্ম ১৯৫০ সালে পঞ্চগড়ে। তার বাবা তমিজউদ্দিন প্রধান ছিলেন বরেণ্য রাজনীতিক। তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার ছিলেন। মুত্যুকালে তিনি স্ত্রী অধ্যাপিকা রেহানা প্রধান, মেয়ে ব্যারিস্টার তাহমিয়া প্রধান, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধানকে রেখে গেছেন।
বাবা মুসলিম লীগের রাজনীতি করায় প্রধান পরিবারে রাজনৈতিক আবহে বেড়ে উঠেন। পুরান ঢাকার বোরহানউদ্দিন কলেজে পড়ার সময় তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়ার সময় আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ নের্তৃত্বে অসীন হন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হলে তিনি শেখ ফজলুল হক মনির অনুসারী হিসেবে আওয়ামী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুহসীন হলে সেভেন মার্ডারে তাকে প্রধান আসামী করা হয়। এ ঘটনাকে শফিউল আলম প্রধানের অনুসারীরা রাজনৈতিক চক্রান্ত দাবি করলেও বঙ্গবন্ধুর আমলেই তার মৃত্যুদন্ডাদেশ আসে। পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে জিয়াউর রহমানের সময়ে ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল রমনা গ্রিনে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) গঠন করেন। এই জাগপার ব্যানারে তিনি দেশ মাটি ও মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি রাজপথে ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, তিস্তার পানি, টিপাইমুখে বাঁধের বিরোধিতা, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে বছরের পর বছর আন্দোলন করেছেন। এ জন্য প্রতিটি সরকারের শাসনামলেই তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। গণমানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজনীতি করতে গিয়ে কারাবরণ করেন এ জন্যই মেয়েকে ব্যারিষ্টারী পড়িয়েছেন।
প্রধানের মৃত্যুর খবরে ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা সকালেই আসাদগেইটের বাসায় জড়ো হতে শুরু করেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সেখানে গিয়ে এই রাজনৈতিক সহকর্মীর পরিবারের সদস্যদের সান্তনা জানান। এ ছাড়াও ছুটে আসেন ২০ দলীয় জোটের শরীক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আব্দুল্লাহ আল নোমান, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, আমানউল্লাহ আমান, নাজিমউদ্দিন আলম, হাবিবুর রহমান হাবিব, শামা ওবায়েদ, বিলকিস জাহান শিরীন, এ্যালবার্ট পি কস্তা, জাগপার চট্টগ্রামের মহানগর সাধারণ সম্পাদিকা তানিয়া আক্তার রূপা, ২০ দলীয় জোট নেতা রকিবউদ্দিন চৌধুরী, ডিএলের সাইফুদ্দিন আহমদ মনি, এনপিপির ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, আবু নাসের মো. রহমতউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা ভূইয়া, সাহিদুর রহমান তামান্না, আলহাজ্ব ফায়জুর রহমান, শেখ ফরিদউদ্দিন, খোরশেদ আলম সুমন, নজরুল ইসলাম বাবলু, সাইফুল আলম, রাকিবুল ইসলাম রুবেল প্রমুখ।
শোকে স্তব্ধ বগুড়া
মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) এবং শহীদ জিয়াউর রহমানের বাড়িই শুধু নয় সদ্য মরহুম জননেতা জাগপা প্রধাণ শফিউল আলম প্রধাণের অন্যতম ঘনিষ্ট সহযোগি / স্ত্রী ও জাগপা কেন্দ্রিয় কমিটির সহ সভানেত্রী রেহেনা প্রধান , তার অন্যতম দলীয় সহযোগি দলের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান , ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শামীম আকতার পাইলট সহ জেলা জাগপার সাবেক সভাপতি মরহুম আমির হোসেন মন্ডল , মরহুম আব্দুর রাজ্জাক ( বাচ্চু সরকার ) , মরহুম শেখ মাহবুব হোসেন লেমন সবারই বগুড়ায় । এছাড়া শফিউল আলম প্রধাণের পৈতৃক নিবাস পঞ্চগড় যাতায়াতের সময় বগুড়ার উপর দিয়েই যেতে হয় বগুড়ার সাংবাদিকদের সাথে আন্তরিকতার টানে তাঁকে প্রায়ই যাত্রা বিরতী করতে হত বগুড়ায়। ফলে মনে প্রাণে আধিপত্যবাদ বিরোধি এই আপোষহীন রাজনীতি বিদের সাথে বগুড়ার আপামর মানুষের একটা নিবিড় সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। এছাড়াও সম্প্রতি ২০ দলীয় রাজনৈতিক জোটের মধ্যে শফিউল আলম অন্যতম একজন নীতি নির্ধারক হওয়ায় বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চান সহ বিএনপির সর্বস্তরের নেতা কর্মিদের সাথেও শফিউল আলম প্রধাণের ছিল অকৃত্রিম গভীর সম্পর্ক ।
ফলে কাল রোববার সকাল ৭টার কিছু পরেই যখন বগুড়ায় জেলা জাগপা নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে বগুড়া বাসির মধ্যে প্রধানের আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সবাই শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। সন্ধ্যার দিকে পঞ্চগড়গামী মরহুমের লাশ বহনকারী গাড়ীটি বগুড়া ছেড়ে যাওয়ার সময় মাটিডালিতে জেলা জাগপার সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল কাদির তুহিন ও যুগ্ম সম্পাদক মোকলেছুর রহমানের নেতৃত্বে নেতা কর্মি সমর্থক ও সর্বস্তরের মানুষ তাকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান । বগুড়ার সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুর রহিম বগরা ও মহসিন রাজু বলেন, রাজনীতির বাইরের জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক , সাংষ্কৃতিক কর্মি, শিক্ষাবিদ ও অন্যান্য পেশাজীবীদের নিয়ে তিনি নেপথ্যে থেকে বগুড়ায় একটি জাতীয় মহাসমাবেশের ইচ্ছা পোষন করে ‘‘ জাতীয় জাগরণ আন্দোলন ’’ নামে এটি সংগঠনও গঠণ করে দেন। তার একান্ত ইচ্ছা ছিল বেগম খালেদা জিয়া ওই অনুষ্ঠানে ‘‘চীফ গেষ্ট’’ থাকবেন । সাংবাদিক ইউনিয়ন বগুড়ার সভাপতি মীর্জা সেলিম রেজা মরহুমের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন . তিনি ছিলেন ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও নির্ভিক এক কণ্ঠ ।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন