স্টালিন সরকার : কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন ২১ বছর। স্বল্প জীবনে তাঁর কলমের ডগা থেকে বের হয়ে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনা। তাঁর কবিতার পরতে পরতে ক্ষুধা দারিদ্র, পরাধীন দেশের দুঃখ দুর্দশাজনিত বেদনা, শোষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন, শোষিত মানুষের কর্ম-জীবন চিত্র। তিনি পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে তোলার প্রত্যয়ে বলেছিলেন ‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল’। ২১ বছর বয়সের তরুণ কবি সুকান্তের কবিতা এখনো প্রাসঙ্গিক; তাঁর কবিতা এখনো জীবন্ত। যাপিত জীবনে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। কথায় আছে ‘মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নহে’। লেখনির মাধ্যমেই সুকান্ত এখনো বেঁচে আছেন। অথচ ৭০ থেকে ৯০ বছর পৃথিবীতে বেঁচে থেকে প্রচুর কবিতা লিখেও অনেক কবি হারিয়ে গেছেন কালের গর্ভে। তাদের লেখার গভীরতা-প্রসঙ্গিকতা নেই। জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান কোনোদিন মন্ত্রী ছিলেন না; এমপিও হননি। রাষ্ট্রীয় অর্থে জনগণের সেবার সুযোগ পাননি। তারপরও তিনি বেঁচে থাকবেন বহুদিন এদেশের প্রতিবাদী মানুষের শ্লোগানে। কারণ তিনি সা¤্রাজ্যবাদী বিরোধী অবস্থান, আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অকুতোভয় সৈনিক। প্রধান শুধু একজন নেতার নাম নয়; একটি শ্লোগান; দেশপ্রেমের একটি মন্ত্র। তিনি ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে যে হুংকার দেন সে আওয়াজ দিল্লী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সুকান্তের ‘পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল’ শ্লোগানের মতোই প্রধানের ‘পিÐীর শৃংখল ভেঙ্গেছি; দিল্লীর গোলামীর জন্য নয়’ শ্লোগান যুুগ যুগ এ দেশের বঞ্ছিত মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হবে।
শফিউল আলম প্রধানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথেই। ’৯০ এ প্রথম পরিচয়েই বুঝিয়ে দিলেন যেন জনম জনমের চেনাজানা। থাকতাম সিপিবির সাবেক সভাপতি শহীদুল্লাহ চৌধুরীর এলাকা ডেমরা বাজারের শ্রমিক পল্লীর পার্শ্বে। উত্তপ্ত রাজপথ। হরতাল অবরোধ চলছে তো চলছেই। মাঝে মাঝে বাসা-বাড়িতে হানা দিচ্ছে পুলিশ।
অর্থনৈতিক সংকটও প্রকট। রাজনৈতিক কর্মী এবং একটি সাপ্তাহিকে লেখালেখিতে সামান্যই অর্থ পাই। তাকে কী? পরিচয়ের শুরুতেই ‘এসো হে বন্ধু এসো এসো’ বলেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। উত্তরাঞ্চলের কোথায় বাড়ি? রংপুর বলতেই হুংকার দিয়ে উঠলেন, আনিস ভাই (জাগপার সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আনিসুর রহমান গফরগাঁয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিনে কয়েকজন পাকসেনাকে হত্যা করেন) নতুন অতিথির সৌজন্যে হয়ে যাক! জাগপার সিনিয়র সহসভাপতি ডা. এ কে আবদুল আজিজ (সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাসের বন্ধু) পকেট থেকে টাকা বের করলেন। পাশের হোটেলে ১০ থেকে ১২ জন খেতে গেলাম। শুধু ভর্তা, ডিম আর ডালভাত। ’৯০ সালে ওই যে পরিচয় তারপর সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এ সম্পর্ক এক সময় পরিবার পর্যন্ত গড়িয়েছে। এই ২৭ বছরে কত ঘটনা, কত স্মৃতি মানসপটে জমা হয়ে গেছে। পল্টন অফিস, আসাদ গেইটের বাসায় ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা, বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত কত স্মৃতি! কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই দেশ, দেশের মানুষ, কৃষকের সমস্যা, সীমান্ত হত্যা, তিস্তার পানি কেন ভারত দেবে না, গোলামির চুক্তি করে বাংলাদেশের লাভ কি হলো, জীবন দিয়েও ট্রানজিট দেব না ইত্যাদি প্রসঙ্গ তিনি তুলবেনই। বাবা মুসলিম লীগ নেতা গমিরউদ্দিন প্রধান ছিলেন পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের স্পীকার। সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন প্রধান। তারপরও অতি সাধারণ জীবন যাপন করেন। পল্টনের অফিসে কত দুপুর যে শুধু ডালপুরি-আলুপুরি খেয়ে কাটিয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। এক টাকা দামের তিনটি আলুপুরি খেয়ে অনায়াসে দুপুরের লাঞ্চ সেরেছেন। পকেটে একশ টাকা আছে; বের করে দিলেন গাজীকে। গাজীই সব। সংসারের বাজার করা, বাগান বাড়ি দেখা, অধ্যাপিকা রেহানা প্রধান, ছেলে রাশেদ প্রধান মেয়ে তাসমিয়া প্রধানের সবকিছুই গাজীই দেখেন। ওই টাকা দিয়ে গাজী পুরি চা আনেন। দুপুরের খাওয়া ওই। নেতাকর্মী বেশি টাকা কম অতএব মুড়ি নিয়ে আয়! দলের শত কর্মী ছিল তার পরিবারের সদস্য।
যারা রাজনীতি করেন তারা রাজনীতিক; কিন্তু সবাই নেতা নন। কেউ কেউ নেতা। যারা প্রকৃত নেতা তারা নিজের আদর্শ দশর্নের অনুসারী সৃষ্টি করেন। অনুসারীরা নেতা ও নেতার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখেন। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখো কোটি অনুসারী সৃষ্টি করে গেছেন, লাখো অনুসারী রেখে গেছেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, মাওলানা এম এ মান্নানের অনুসারীরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নিকট অতীত বাংলার শার্দুল কাজী জাফর আহমদ নিজস্ব অনুসারী সৃষ্টি করে গেছেন। আর নেতা হিসেবে অসংখ্য অনুসারী রেখে গেলেন শফিউল আলম প্রধান। এ ছাড়া গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, অলি আহাদ, আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মহিউদ্দিন আহমদসহ অনেক জাঁদরেল রাজনীতিক ইন্তেকাল করেছেন। তাদের জন্মদিন মৃত্যুবার্ষিকী কেউ মনে রাখে না। যারা ‘নেতা’ অনুসারীরাই তাদের আদর্শ এগিয়ে নেয়। প্রধানের অনুসারীরা তাঁর আদর্শ এগিয়ে নেয় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
নেতারা দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখেন; সে স্বপ্নের মৃত্যু নেই। বিপ্লবীরা মরে না। কারণ বিপ্লবীরা স্বপ্নদ্রষ্টা। শফিউল আলম প্রধান কোনো কমিউনিস্ট বিপ্লবী ছিলেন না। বিদ্রোহ করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চেতনা দূরের কথা মন্ত্রি-এমপি হওয়ার খায়েশও দেখাননি। তিনি সারাজীবন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থে গণমানুষের রাজনীতি করেছেন, জেল জুলুম নির্যাতন সহৃ করেছেন। প্রধান মওলানা ভাসানীকে হৃদয়ে লালন করতেন। তাঁর মৃত্যু দিবস ১৭ নভেম্বর প্রতিবছর টাঙ্গাইলের সন্তোষে যেতেন। বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে গেছি সন্তোষে। আর দশজন রাজনীতিকের মতো কর্মীদের বাসে পাঠিয়ে তিনি প্রাইভেট কার বা মাইক্রোতে যেতেন না। নিজেও কর্মীদের সঙ্গে বাসেই যেতেন। সামনের সিটে বসেছি। পিছনের সিটে শফিউল আলম প্রধান ও অধ্যাপিকা রেহানা প্রধান। বাস চলছে ধীর গতিতে। কোথাও দাঁড়ানোর সুযোগ নেই; অথচ সবাই ক্ষুদার্ত। কোনো এক কর্মী বাসে ওঠার সময় কিছু চানাচুর নিয়ে উঠেছেন। নেতা টের পেয়েছেন। তৎক্ষণাত নির্দেশ যা আছে সবার মধ্যে ভাগ করে দাও। ৩০ জন মানুষের মধ্যে ভাগে কতটুকু পড়ে? ঠিকই তিনি সবাইকে একটু একটু করে চানাচুর দিয়ে নিজে খেলেন। নিজের খাওয়ার আগে সহকর্মীদের কথা আগে চিন্তা করতেন। মিটিং মিছিল থাকলে প্রায়ই দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি নিয়ে পল্টনের অফিসে আসতেন। নেতাকর্মীদের ভাত-রুটি-পুরি যাই সম্ভব খাওয়ান। কিন্তু সাধারণ অড্ডায় অফিসে দুপুরের খাবারের সময়। নেতাকর্মীরা ঘিরে রেখেছেন। পকেটে টাকা নেই। যার পকেটে টাকা থাকতে পারে বুঝতে পারলে তাকে পাকড়াও করতেন; তুমিই ধার দাও; সবাই কিছু খাই। সে টাকায় কোনো দিন ভাত খাওয়া হতো আবার কোনো দিন রুটি, এমনকি কলা পাউরুটি বা শুধু চা বিস্কুট খেয়ে দিন পার করে দিতেন। বাবার বন্ধু সাবেক স্পীকার শামসুল হুদা চৌধুরী অনেক চেস্টা করেছেন বিচারপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভায় নিতে; পরবর্তীতে এরশাদের মন্ত্রিসভায় নেয়ারও চেস্টা করেছেন। তাঁর এক জবাব ‘আগে চাই গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব রক্ষার গ্যারান্টি; তারপর মন্ত্রিত্ব’। তিনি মনে করতেন স্বাধীনতার পরবর্তীতে কোনো সরকারই বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন মর্যাদার আসনে’ বসাতে পারেনি। সবাই দিল্লীর তোষামোদী করেছেন, বন্ধুত্বের নামে ভারতকে বড়ভাই মেনে নিয়েছে। কেউ প্রকাশ্যে কেউ পর্দার আড়ালে থেকে। অতএব নো মন্ত্রিত্ব। সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদ, তিস্তার পানি, ৫৪ অভিন্ন নদীর পানির হিস্যার দাবিতে আন্দোলন করেছেন, গ্রেফতার হয়েছেন। প্রতিটি সরকারের সময়ই তিনি কারাবরণ করেন। ’৯৮ সালে গ্রেফতার করে এক গোয়েন্দা অফিসে নেয়া হয়েছে। কয়েকজন নেতা দেখতে গেছেন। নেতাদের দেখা করতে হলো না। অগত্যে সাংবাদিক হওয়ায় কথা বলার সুযোগ পেলাম। অনেক কথা শোনালেন। জামিনের জন্য এবং মামলার জন্য আইনজীবীদের ধর্না দিতে হয়। মেয়ে তাসমিয়াকে ব্যারিষ্টার বানাব। না, প্রধান জেল-জুলুমকে ভয় পেতেন না। বললেন, এবার লিখে দিও আমি আমার ছেলেমেয়েকে দেশের জন্য উৎসর্গ করলাম। আসাদ গেইটের বাসায়ও একাধিকবার বলেছেন, অবশ্যই মেয়েকে ব্যারিষ্টার করবো। আর দেখা হলেই চিৎকার ‘দেশের খবর কি, আমরা কি আছি?’
দলীয় নেতাকর্মী হোক, জোট সমমনা দলের নেতাকর্মীই হোক আন্দোলন করতে গিয়ে যারাই গ্রেফতার হয়ে জেলে যেতেন; তাদের আদালত থেকে কারাগারে পৌঁছার আগেই সবার জন্য জেলগেটে পৌঁছে যেত নতুন লুঙ্গি, গামছা, সাবানসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। জেলে সবকিছু মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরামর্শ দিতেন। প্রধানের ভাষায় মেনে নিয়ে থাকলে কারাগারও হতে পারে জীবনের সবচেয়ে স্বণালী সময়। প্রধানের মতো দেশমাতৃকার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে নেতারা আত্মোৎসর্গ করেন তারা বেঁচে থাকেন। দেশপ্রেমের জীবন উৎসর্গ করে মরণকে হাসিমুখে বরণ করার সাহস থাকার মাঝেই জীবনের সফলতা। কত হাজার হাজার নেতা এদেশে রাজনীতি করেছেন। মৃত্যুর পর কতজন তাদের মরে রেখেছে? রাজনীতি করে মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন, জীবন উপভোগ করেছেন, মৃত্যুর পর ভেসে গেছেন কাল¯্রােতে। কিন্তু কীর্তিমান যারা দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য আত্মনিয়োগ করেন, জাতীয় স্বার্থের পক্ষ্যে জীবনবাজী রেখে লড়াই করেন, তারা মানুষের মাঝে বেঁচে থাকেন অনন্তকাল। রাজনীতিকদের জীবনের সার্থকতা এখানেই নিহিত। মানুষ মরণশীল হলেও কর্মগুণে অমরত্ব লাভ করে। দীর্ঘজীবন রাজনীতি করা শফিউল আলম প্রধান মন্ত্রী এমপি না হলেও এদেশের মাটি ও মানুষের কাছে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের কবিতার মতোই ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম/ নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম’ হয়েই উপস্থিত থাকবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন