ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ : নারী নির্যাতনের ঘটনা দেশে অব্যাহতভাবে ঘটে চলা নৃশংসতা-বর্বরতারই প্রকট রূপ। এতে সামাজিক অবক্ষয় আর ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের সাক্ষ্য মেলে। ঘরে-বাইরে সমানতালে নারীরা যেভাবে ধর্ষণের শিকার হয়ে চলেছে তা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। নারীরা আজকাল নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বিশেষত যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মাত্রা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। গ্রাম-গঞ্জ, স্কুল-কলেজ, অফিসপাড়া সবখানেই নারীরা ধর্ষণের শিকারে পরিণত হচ্ছেন ক্রমাগত।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতিমাসে ৩০০টিরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। প্রকৃত অর্থে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে সংগত কারণে যে, গ্রাম-গঞ্জ এমনকি শহরেও অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের কথা প্রকাশ করতে চান না। যেহেতু ধর্ষণের শিকার নারীটির ওপরই সামাজিকভাবে ঘৃণা বর্ষিত হয় বেশি। এমনকি এজন্য ধর্ষিতার পরিবার-পরিজন কিংবা তার অভিভাবকদেরও সুনজরে দেখা হয় না বললেই চলে। তাই অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও থানায় মামলা করেন না। আর থানায় মামলা দিতে গেলেও অনেক অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় ধর্ষিতাকেই। এরপর সাহস করে যারা ধর্ষণের মামলা থানায় বা আদালতে করেন তার সিংহভাগই রাজনৈতিক কারণে রেহাই পেয়ে যায়। এছাড়া ধর্ষণের মামলা তদন্ত করতে গিয়েও একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তা ধর্ষিতাকেই নানাভাবে হেনস্তা করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
ধর্ষণ কোনও সাধারণ অপরাধ নয়। এটি একটি গর্হিত ও অমার্জনীয় অপরাধ। আমাদের প্রচলিত আইনে এ অপরাধের কঠোর শাস্তি রয়েছে। শরীয়া আইনেও ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদন্ডের মতো কঠিন শাস্তির বিধান বিদ্যমান। এই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা সত্তে¡ও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের মাত্রা আমাদের সমাজে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর একটি মাত্র কারণ, ধর্ষকরা শাস্তির মুখোমুখি না হয়ে নানাভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষমাহীন যে কারণটি হচ্ছে তা রাজনৈতিক। এ কারণে খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধ করেও অনেকে বেঁচে যায়। ফলে এমন অপরাধ আমাদের সমাজে বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের অপরাধীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে একশ্রেণির বিকৃত মানসিকতার মানুষ প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে মেয়েদের ইজ্জত-সম্ভ্রম লুটে নেবার দুঃসাহস করে। অথচ অপরাধীরা এটা ভাবে না যে, সমাজে তাদেরও মা-বোন-কন্যাদের চলাফেরা করতে হয়। স্কুল-কলেজ বা কর্মস্থলে যেতে হয় তাদের পরিবারের কোনও কোনও নারী সদস্যকে। তারা যদি ধর্ষণের মতো নিষ্ঠুর ও নির্মম ঘটনার শিকারে পরিণত হয়, তাহলে তাদের কেমন মানসিক পরিস্থিতি হতে পারে। আসলে এমনটি যদি কোনও ধর্ষক কখনও চিন্তা করে তাহলে হয়তো ধর্ষণের মতো এমন মারাত্মক অপরাধ সংঘটনের চিন্তা তারা করতো না।
আমরা জানি না, অপরাধীচক্রের এমন মানসিকতা কখনও সৃষ্টি হবে কিনা! যারা ধর্ষণ বা খুনের মতো মারাত্মক অপরাধ করে তাদের বিবেকের মৃত্যু ঘটে। তারা মানুষ থাকে না। পশুতে পরিণত হয়। আর তাদের প্রতিহত এবং নিরপরাধ নারীদের রক্ষা করতেই তৈরি হয়েছে কঠোর আইন। শরীয়া আইনেরও একই উদ্দেশ্য। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে যদি ধর্ষকদের বিচারের মুখোমুখি না করা যায়, তাহলে এমন অপরাধ দিন দিন বাড়বে বই কমবে না কখনই।
আমরা মনে করি, ধর্ষকদের আইনানুগভাবে বিচারের মুখোমুখি করতে পারলেই আমাদের মেয়েরা সমাজে নিরাপদে নির্বিঘেœ চলাফেরা করতে যেমন সক্ষম হবে, তেমনই অপরাধের সংঘটকরাও অনেকটা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে। বিশেষত ধর্ষণ বা খুন এমন অপরাধীদের যেন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়া হয় সে বিষয়টি সম্পর্কে সজাগ থেকে তাদের আইনের হাতে তুলে দেবার ব্যাপারে যত্মবান থাকতে হবে সবাইকে।
নারী নির্যাতনের যে ক্রমবর্ধমান উন্মত্ততায় সমাজদেহ থরথর করে কাঁপছে, এর কঠোর প্রতিকার জরুরি। প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে জবাবদিহির আওতায় আনাও জরুরি। একই সঙ্গে দরকার সম্মিলিতভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। মনে রাখা দরকার, সময় সমাজকে এগিয়ে দেয়। আর সমাজের হাত ধরেই এগিয়ে যায় দেশ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব, সে ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে পুলিশ। জনগণের বন্ধু ও সেবক হিসেবে কাজ করে তারা। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় পুলিশের এই ভূমিকা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। অভিযোগ রয়েছে, অজ্ঞাত কারণে ধর্ষিতাকে সহযোগিতার বদলে তারা নানাভাবে ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে থাকে। পুলিশের বিরুদ্ধে থাকা এ অভিযোগ কঠোরভাবে মোকাবিলা না করলে ধর্ষণ কেন, সমাজে সব ধরনের অপরাধই ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তার আগেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন