মোহাম্মদ আবু নোমান : দেশের রাজনৈতিক অবস্থা শান্তিপূর্ণ থাকায় সামগ্রিকভাবে গত ৩ বছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ভালোয় রয়েছে। এখন বিনিয়োগ পরিবেশ ভালো থাকলেও মন্দা কাটেনি। যদিও প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে রয়েছে। কিন্তু কম বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যাবে না। প্রবাসী আয় কমছে। এর কারণ অনুসন্ধান জরুরি। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রবাসীরা বিনা মাসুলে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোপূর্বে নির্দেশনা দিয়েছেন। উৎপাদনমুখী প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্ব থাকছে আগামী বাজেটে। প্রবৃদ্ধির মাত্রা বাড়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অবদান উল্লেখযোগ্য। তবে এ ধারা অব্যাহত রাখতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানবসম্পদের উন্নয়ন। মানবসম্পদের উন্নয়নে পিছিয়ে আমরা। বর্তমানে কর্মক্ষম বয়সের হার অনেক বেশি। এ জন্য কর্মমুখী শিক্ষার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। এর সাথে বিশেষ গুরুত্বের তালিকায় রাখতে হবে বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সুযোগ অধিকতর ব্যবহার ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন রপ্তানির বাজার সৃষ্টি।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয়, যা বাজেট নামে অভিহিত। বাজেটের আকারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫ নম্বরে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজেটের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালে বাজেটের আকার ছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বাজেটের প্রায় কাছাকাছি, ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। গত বছর বাংলাদেশের মোট বাজেট ছিল ৩ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার। রাজস্ব আয় ২ হাজার ৩৭৮ কোটি ডলার, ঘাটতি যা মোট জিডিপির ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল চীন, তাদের মোট বাজেটের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৯ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। প্রতিবেশী ভারতের মোট বাজেট ২৮ হাজার ৩১০ কোটি ডলার। রাজস্ব আয় ২০ হাজার ১০ কোটি ডলার।
আগামী জুলাইয়ে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন ভ্যাট আইনের (মূল্য সংযোজন কর) কারণে পণ্যমূল্য বাড়বে না বলে মনে করছে রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি বাজেটের চেয়ে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। বাজেটের সম্ভাব্য আকার করা হচ্ছে ৪ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের চেয়ে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা বেশি। বড় অঙ্কের এই বাজেট বাস্তবায়ন ও অর্থসংস্থানের প্রয়োজনেই আগামী অর্থবছর থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হবে। লক্ষ্যণীয় যে, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার আগেই মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন শুরু হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা ভ্যাটের কারণে জুলাই থেকে পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়বে বলে আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। দরবৃদ্ধিরও আগাম প্রচারণাও চালাচ্ছে। তাই মূল্যস্ফীতির হাত থেকে ভোক্তাকে রক্ষা করতে এনবিআরের প্রস্তুতি কী, তা জানতে চায় সচেতন মহল।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট কেন্দ্র করে আশা-নিরাশার দোলাচলে দেশের শেয়ারবাজার। তবে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা, আগামী বাজেটে ভালো কিছু মিলবে পুঁজিবাজারে। বিশেষ করে করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা ২৫ হাজার থেকে বৃদ্ধি করে ১ লাখ টাকায় উন্নীত করবে সরকার। অন্যদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শতভাগ কর অবকাশ সুবিধা চায়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এরপর নানা বাধা-বিপত্তি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝা অতিক্রম করেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এগিয়েছে দেশের অর্থনীতি। বেড়েছে প্রবৃদ্ধির হার। এর সঙ্গে বেড়েছে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারায় বহুমুখী পরিবর্তন এসেছে। বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য রক্ষায় আগে বৈদেশিক সহায়তাই বড় ভ‚মিকা রাখত। এখন সেখানে এগিয়ে এসেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। দেশে মাথাপিছু আয় বাড়লেও সমাজের মধ্যে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। দরিদ্রশ্রেণি দারিদ্র্যের সীমা থেকে বেরিয়ে এলেও তাদের জীবনযাত্রার মান খুব বেশি একটা বাড়েনি। এখনো দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ অতিদারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। সম্পদ কেন্দ্রীভ‚ত হচ্ছে একটি গ্রæপের হাতে। এতে আয় বাড়ার সুফল সব মানুষ পাচ্ছে না। তবে মাথাপিছু আয় বাড়ার কারণে দেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উঠে আসছে।
জাতিসংঘের বিধি অনুযায়ী, যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, তাদের বলা হয় নিম্নআয়ের দেশ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এ তালিকাতেই ছিল। আর ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার, তারা মধ্যম আয়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে আবার আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে ৪ হাজার ১২৫ ডলার পর্যন্ত হলে তা হবে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং আয় ৪ হাজার ১২৬ ডলার থেকে শুরু করে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার হলে দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ। এর চেয়ে বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে সেই দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ আয়ের দেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকে দেখা যায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় কমে দাঁড়ায় ১২০ ডলার। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬০ ডলারে। তবে ১৯৭৭ থেকে ’৭৯ অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে আয় কমে যায়। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় আবার বেড়ে দাঁড়ায় ১৯০ ডলারে। ১৯৮১-৮২তে ২৬০ ডলারে। সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চ‚ড়ান্ত হিসাবে, গত অর্থবছর (২০১৫-১৬) বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৫ ডলার। গত এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ১৩৭ ডলার মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬০২ ডলার। এ হিসাবে গত ৪৪ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ।
ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) একটি প্রত্যক্ষ কর পদ্ধতি। এটি সরাসরি ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। বাংলাদেশে এ ব্যবস্থা চালু করা হয় ১৯৯১ সালে। ভ্যাট আদায়ে ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে বেশি ভ‚মিকা রাখে। তবে ভ্যাটের হার বৃদ্ধি সময়পোযোগী কিনা সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে যৌক্তিক পর্যায়ে ভ্যাটের হার নির্ধারণ করা দরকার, যাতে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও ভোক্তা সবার সুবিধা হয়। বর্তমানে রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ আসছে এ খাত থেকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূূত্রে জানা গেছে, বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ১৬০টি দেশে ভ্যাট ব্যবস্থা চালু আছে। এসব দেশে ভ্যাটের হার সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ২০ শতাংশ, সুইডেনে ২৫। আর আমাদের আশপাশের কয়েকটি দেশে ভ্যাটের হারের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় ১০ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৬, নেপালে ১৩, পাকিস্তানে ১৭ ও মিয়ানমারে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশে এখন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত আছে।
কোনো দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি হচ্ছে সেই দেশের অর্থনীতির আকার পরিমাপের একটি পদ্ধতি। একটি দেশের জিডিপি বলতে বোঝায়, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের ভেতর উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মোট বাজারমূল্য। বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দীর্ঘ সময় ধরেই ৬ শতাংশের ঘরে অবস্থান করছে। গত অর্থবছর এ হার সরকারি হিসাবে ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে। কিন্তু বেসরকারি ও বিদেশি সংস্থা এবং দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা এ তথ্য মানতে নারাজ। তাদের মতে, প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ঘরেই রয়েছে। সেটি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। কারো মতে আরও কম। তবে সরকার দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছে, প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ঘর অতিক্রম করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতাকে ভিত্তি ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে নতুন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে হলে এখন নতুন নতুন খাতে জোর দিতে হবে। অবকাঠামো ও সেবা খাতের উন্নয়ন জোরদার করতে হবে। সরকারি সেবাকে আরও সহজ করতে হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন জোগান দেওয়া সম্ভব হলে প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। বর্তমানে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গ্যাসের অপেক্ষায় চালু করতে পারছে না উদ্যোক্তারা। চাকরির বাজার সীমিত হওয়ায় স্বাবলম্বী হতে তরুণদের মাঝে ব্যবসার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে, যা ভালো একটি দিক। এসব নতুন উদ্যোক্তাদের এফবিসিসিআইর সাথে সরকারও একটু সহায়তা করলে তারা দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে। সব মিলে সামনের দিনগুলো ভালো হবে বলেই সকলের আশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন