শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

সামাজিক অপরাধ: মিডিয়া ও প্রোপাগান্ডার প্রভাবমুক্ত ভূমিকা চাই

| প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


মোহসিন মারুফ : সর্বব্যাপী সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের সমাজের বেশীর ভাগ মানুষ যখন অস্থির নিরাপত্তাহীনতার নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে তখন বহুচর্চিত সাধারণ নৈমিত্তিক অসামাজিক বা অরাজনৈতিক ঘটনাগুলোও হঠাৎ করে ব্যাপক প্রচারের েস্রাতো পড়ে নতুন মাত্রা লাভ করছে। এখানে প্রথমত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কোন আলোচ্য ঘটনার ভীত নির্মান করছে, অত:পর নিজেদের পক্ষ-বিপক্ষ ও স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে মেইনস্ট্রীম ও কর্পোরেট মিডিয়াগুলোকেও নিজেদের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে প্রচারে নেমে পড়তে দেখা যাচ্ছে। অনিশ্চিত ও অস্বচ্ছ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় প্রচারনা ও প্রোপাগান্ডার এই চালচিত্র কোন নতুন উপসর্গ নয়।  ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সৃষ্ট লুটেরা অর্থনীতি, বিজাতীয় অপসংস্কৃতি ও ভোগবাদি সমাজবাস্তবতায় প্রবেশের মধ্য দিয়ে আমরা যে ধীরে ধীরে একটি ঘুণে ধরা সমাজে প্রবেশ করেছি, তার প্রতিষেধক বা প্রতিবিধানের কোন উদ্যোগ না নিয়ে আমরা কেবল মাঝে মধ্যেই মিডিয়ার মতলবি প্রচারনায় প্রভাবিত হয়ে কোন বিশেষ ঘটনাকে উপজীব্য করে শোরগোল তুলে সমাজ বদলের মূল দায় থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চাইছি। আমাদের অনেকেই হয়তো ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী তনুর কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ধর্ষিত ও নিহত হওয়ার ঘটনাটি ভুলে গেছি। কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় হিযাবধারি শিক্ষার্থী  সোহাগি জাহান তনুকে ধর্ষনের পর হত্যার ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর মূলত: সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হওয়া জনমত থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে অপরাধের বিচারের দাবীতে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছিল। তবে রাষ্ট্রযন্ত্র ও ক্ষমতাধর কুশীলবদের কাছে এমন প্রচারনাও খুব বেশী মূল্য পায়নি। অবশেষে তণুহত্যা ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলে  অভিযোগ তুলে গত বছরের মার্চ মাসে ঢাকা এবং কুমিল্লায় বিভিন্ন সংগঠনের তরফ থেকে রাজপথে বিক্ষোভ করেছিল শত শত মানুষ। ব্যাপক জনমত ও গণদাবীর পরও তনুহত্যার মোটিফ বা বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পারেনি আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
 পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নূরুল হুদার মতে, শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারনায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব নয়। গত বুধবার নুরূল হুদার লেখা একটি নিবন্ধ ঢাকার একটি ইংরেজী দৈনিকে ‘অনলি সোশ্যাল মিডিয়া ক্যান নট ইনফ্লুয়েন্স ল’ এনফোর্সমেন্ট’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক এই মহাপরিদর্শক, সাম্প্রতিক বনানীর একটি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষন নিয়ে ব্যাপক মিডিয়া হাইপ এবং আনুসাঙ্গিক বিষয়াবলী নিয়ে একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। আলোচিত ঘটনার পর স্থানীয় থানা পুলিশ যদি সততা ও পেশাদারিত্বের সাথে তাদের আইনগত দায়িত্ব পালন করত তাহলে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া হয়তো আরো সুনিশ্চিত হতো। অভিজাত এলাকার একটি হোটেলে আয়োজিত বার্থ ডে পার্টিতে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তরা সমাজের অতি বিত্তশালী ঘরের বখে যাওয়া সন্তান। তাদের পিতা ও স্বজনদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে এ ধরনের অভিযোগে প্রথমে পুলিশের নিস্পৃহ ভূমিকা, অত:পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সমাজের উপরতলায় ব্যবসা ও বিত্ত-বৈভবের অসূয়া থেকে সৃষ্ট মতলবি প্রচারনার ডামাডোলে গা ভাসিয়ে প্রশাসনযন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ অতি উৎসাহী ও অতিতৎপরতা দেখাতে শুরু করে। ধর্ষনের মত ন্যাক্কারজনক অপরাধের সাথে জড়িতদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার গণদাবীকে পাশ কাটিয়ে এখন যেন তা’ বারোয়ারি, এলোপাথাড়ি তৎপরতার ইভেন্টে পরিনত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার গত কয়েকদিনের তৎপরতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, সরকারের এসব সংস্থা একটি ধর্ষণ মামলাকে কেন্দ্র করে দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়, হোটেল ব্যবসায়, মদ ও বারের ব্যবসায়, শুল্ক ব্যবস্থাসহ আনুসাঙ্গিক প্রচলিত সব ব্যবস্থাকেই পাল্টে ফেলতে । দেশে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার স্বর্ণ কেনাবেচা হয়। এসব সোনা কিভাবে দেশে আসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তা অজানা থাকার কথা নয়। অভিজাত পাড়ার হোটেল,গেস্টহাউজ ও পার্টিসেন্টারে কি হয়, কারা সেখানে যাতায়াত করে, সেখানকার বৈধ-অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কেও পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো অজ্ঞ নয়। শহরের অভিজাত এলাকায় চলমান বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উপর নজরদারি করে যে কোন অবৈধ বা অনৈতিক-অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করাও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর দায়িত্ব। যথাযথ প্রক্রিয়ায় এসব দায়িত্ব পালনে কার্যকর ভ’মিকা পালন না করে হুজুগে প্রচারনার ডামাডোলে পড়ে সবকিছু উলটপালট করে ফেলতে চাইছে। ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত পুত্রের কল্যানে স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলদারের বিলাসী জীবনের নেপথ্য ঘটনাবলী এখন প্রতিদিন সবিস্তারে বেরিয়ে আসছে মিডিয়ায়। কিন্তু হোটেল রেইনট্রী’র মালিকপক্ষের নানা ঠিকুজি তালাশ করে তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় করার প্রচেষ্টা, দেশের স্বর্ণ ব্যবসার চলমান প্রক্রিয়াকে অচল করে দেয়া, অভিজাত এলাকার হোটেল, বার ও নারকোটিক্স ব্যবসায়কে রাতারাতি ধোয়া তুলসি পাতায় পরিনত করার অসম্ভব অতি উৎসাহী তৎপরতা শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো। বনানীর রেইনট্রী হোটেলে ধর্ষন মামলার পর থেকে অভিযুক্তদের পাশাপাশি  হোটেল মালিক ও তাদের আত্মীয় পরিজনদের নিয়েও নানা মিডিয়ায় মতলবি প্রশ্ন তোলা হলেও পক্ষান্তরে ধর্ষনের শিকার কথিত দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি, প্রকাশিত হয়নি।
এপ্রিলের ২৮ তারিখ রাতে বনানীর রেইনট্রী হোটেলে ধর্ষণের ঘটনার আগে ও পরে আরো কয়েকটি অপেক্ষাকৃত ন্যাক্কারজনক ও মর্মান্তিক ঘটনার কথা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শ্রীপুরে নির্যাতনের বিচার না পেয়ে এক পিতার নিজের মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করা এবং জুরাইনে বনানী ঘটনার একমাস আগে এক কিশোরি গণধর্ষনের শিকার হওয়ার পর মেয়েটির বাবা ৫ জনের নামে ধর্ষনের মামলা করলেও তাদের কাউকেই এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে এসব ঘটনার ভিকটিমএবং অভিযুক্তরা সমাজের অতি সাধারণ মানুষ। বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ভিকটিম এবং অভিযুক্ত উভয় পক্ষই সমাজের উঁচুতলার মানুষ। তবে ভিকটিমদ্বয়ের চেয়ে ধর্ষনের অভিযুক্তরা অনেক বেশী বিত্তশালী হওয়ায় এবং সমাজের উঁচুতলার ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি ও বিত্তবৈভবের প্রতিযোগিতার কারণে ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মেইনস্ট্রীম মিডিয়ায় অনবরত সংবাদ শিরোনাম হয়ে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন, নারকোটিক্স বিভাগ, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকল দফতর ও সংস্থাগুলো যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙ্গে অতি উৎসাহী তৎপরতা দেখাতে শুরু করেছে। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান দেশবাসি এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে অস্ত্র-মাদকসহ সব ধরনের অবৈধ চোরাচালান, মানব পাচার, মদ, জুয়া, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য  অশ্লীলতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি চায়। এ জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ  সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে মিডিয়া হাইপে গা না ভাসিয়ে সারা বছর নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্ব সততার সাথে পালন করতে হবে। রাতারাতি তৎপরতা চালিয়ে কতিপয় অভিযুক্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে সমাজের কাছে হেয় করা সম্ভব হলেও সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয় থেকে জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এভাবে অপরাধের পুনরাবৃত্তি এবং অভিযোগের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বদলে প্রকৃত অপরাধিকে আড়াল করার মওকা সৃষ্টি হয় ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন