পবিত্র মাহে রমজান মানসিক, শারীরিক ও সামাজিকভাবে সকলকে করছে উন্নত। এ বিশেষ সময়ে অনেককে খাবার-দাবারের ব্যাপারে অতিরিক্ত সচেতন হতে দেখা যায়। এতে করে বিরূপ প্রভাব পড়ে শরীরের উপর। ওজন যায় বেড়ে, রোজা রাখতে সমস্যা হয়। মনে রাখতে হবে বছরের বাকি এগারো মাসের মতো এ মাসের খাদ্যতালিকাও হবে অনেকটা একইরকম। সুষম খাদ্যের ব্যাপারে আপোষ করলে চলবে না। খেতে হবে প্রচুর শাসসবজি, ফল। যাদের শরীরে ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তারা একটু সচেতন হলে এ সময় ওজন অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারেন। তবে যাদের ওজন কম তাদের ওজন না বাড়লেও তা যাতে কমে না যায় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। রোজার সময় শরীরের মেটাবোলিক রেট কমে আসে, অন্যান্য নিয়ন্ত্রণকারী ক্রিয়াগুলো কাজ করা শুরু করে। শরীরে জমে থাকা এবং খাদ্য থেকে আসা ফ্যাট ব্যবহৃত হয় কার্যকরভাবে। প্রতি খাবারের পর ফল খাওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এমন খাবার বেছে নিতে হবে যা শরীরে থাকবে বেশি সময়। ফলে দেখা দিবে না সমস্যা। ধীরগতিতে পরিপাক হওয়া খাদ্যগুলো পেটে থাকবে ৮ ঘণ্টা, অপরদিকে দ্রæত পরিপাককৃত খাদ্যের সময় ৩-৪ ঘণ্টা। তন্তুযুক্ত খাদ্য পরিপাকে সময় লাগে বেশি। আটার রুটি, শাকসবজি এবং ফল এ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। চিনি এবং চিনিযুক্ত খাদ্য তাড়াতাড়ি হজম হয়। তাই এ সময় খাদ্যতালিকায় এদের রাখতে হবে পেছনের সারিতে আবার এমনভাবে বাছাই করতে হবে যাতে তা সুষম হয়। ফল, শাকসবজি, গোশত বা মাছ, ডেইরি প্রোডাক্ট এবং ব্রেড বা সিরিয়াল থেকে খাদ্যে বাছাই করতে হবে। ভাজা খাবার শরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং যতো কমে পারা যায় খেতে হবে। ভাজা খাবার শরীরে টক্সিন তৈরি করে। এসব পরিবর্তিত খাবার ঠিকমতো হজম না হওয়ায় দেখা দেয় বদহজম, পেট জ্বালা করে। শরীরের ওজন বাড়াতে সাহায্য করে।
এ সময় সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে বিশেষ কতগুলো ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। প্রথমত ইফতার, রাতের খাবার বা সেহরীর সময় অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেতে হবে। অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে। মিষ্টি ও মিষ্টিযুক্ত খাবারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফল খেতে হবে প্রতি খাবারের পর। খেতে হবে প্রচুর শাকসবজি। যেসব খাদ্য বেশি সময় পেটে থাকবে অর্থাৎ কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার সেহরীর সময় খেতে হবে। ফলে ক্ষুধাজনিত কোন সমস্যা দেখা দিবে না। এছাড়া সেহরীতে অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। খাওয়া যেতে পারে হালিম। এতে আছে প্রোটিন এবং তা শরীরে থাকে বেশি সময়। খেজুর খুবই উপকারী। সুগার, তন্তু, শর্করা, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস হলো খেজুর। কলায় আছে প্রচুর পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং শর্করা। পাকা কলা যে কোন রসালো ফলের চেয়ে বেশিক্ষণ পেটে থাকে। ইফতার এবং রাতে ঘুমোতে যাবার আগে প্রচুর পানি ও ফ্রুটজুস খান। এতে করে শরীরে ফ্লুইডের সামঞ্জস্য ফিরিয়ে আনতে পারবে। ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্যাফেইন মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে। চা, কফি ও সফট ড্রিংকসে আছে ক্যাফেইন। নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস থাকলে ধীরে ধীরে তা কমিয়ে আনতে হবে। হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে মাথা ব্যথাসহ মানসিকতার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রস্রাবের পরিমাণ বেড়ে গেলে শরীর থেকে পানি বের হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য প্রয়োজনীয় মিনারেল সল্টও বেরিয়ে যাবে। এই সল্ট ও পানি রোজাকালীন সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে অতীব প্রয়োজন। ধূমপান সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে এবং সারাজীবনের জন্য। এছাড়া কিছু হালকা ব্যায়াম করতে হবে। হাঁটাচলার মাধ্যমে বা স্ট্রেসি’র মাধ্যমে তা করা যেতে পারে। সর্বোপরি পরিমিত ঘুম হতে হবে।
ইফতারের টেবিলে এমন খাবার থাকতে হবে যাতে শরীর তৎক্ষণাৎ গøুকোজের যোগান পায়। প্রাণিকোষের জন্য গøুকোজ খুবই প্রয়োজন। বিশেষ করে মস্তিষ্ক ও ¯œায়ুকোষের জন্য। খেজুর এবং ফ্রুট জুস এক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকর। তিনটি খেজুর এবং এক গøাস জুস শরীরের গøুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক করতে যথেষ্ট। খাওয়া যেতে পারে স্যুপ। স্যুপ এবং জুস শরীরের পানি এবং মিনারেলের ঘাটতি মিটিয়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত শরবত বা মিষ্টিজাতীয় খাবার উপকারের চেয়ে ক্ষতি করে বেশি। রাতের খাবারে প্রয়োজন মতো শাকসবজি, ফল, গোশত, মাছ খেতে হবে। দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারও খাওয়া যেতে পারে। গোশত এবং মাছে আছে প্রচুর প্রোটিন, মিনারেলস এবং ভিটামিন। ভাতে আছে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, মিনারেলস এবং তন্তু। দুধ এবং দুগ্ধজাত খাদ্য প্রোটিন এবং ক্যালসিয়ামের প্রকৃষ্ট উৎস। শাকসবজিতে আছে তন্তু, ভিটামিন-এ, ক্যারোটি লাইকোপেন এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট। এসব খাদ্য ক্যান্সার, হৃদরোগসহ শারীরিক অন্যান্য সমস্যা প্রতিরোধে বিশেষভাবে কার্যকর। ফল খেতে হবে সব খাবারের শেষে। এতে করে হজমে সমস্যা হবে না। সেহরীর সময় হালকা খাবার খেতে হবে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে। খাবার যেন হয় সুষম।
রোজার স্বাস্থ্য সমস্যায় করণীয়
* কোষ্ঠকাঠিন্য : রিফাইন্ড খাবার বেশি খেলে এবং পানি ও তন্তু জাতীয় খাবার কম খেলে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই পানি খেতে হবে প্রচুর, শাকসবজি ও ফল খাবার পরিমাণে বাড়িয়ে দিতে হবে। আর বাদ দিতে হবে অতিরিক্ত রিফাইন্ড খাবার।
* পেপটিক আলসার : এসিডের মাত্রা খালি পেটে বেড়ে গেলে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে করে বুক জ্বলা, পেটে ব্যথা হতে পারে। রোজার সময় এ সমস্যা অনেকের মধ্যেই দেখা দেয়। অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার, কফি পানীয় এ সমস্যাকে আরো উসকে দেয়। শাকসবজি, ফলে, আছে প্রচুর ফাইবার বা তন্তু। এসব খাবার পেশীর কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয়। খাদ্য হজমে সাহায্য করে। খাদ্যকে বিপাক রসের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে চলে যেতে সাহায্য করে। তন্তু জাতীয় খাবার এসিডিটির সমস্যা কমাতে বিশেষভাবে কার্যকর। ফল ও শাক-সবজি এসিডিটির সমস্যায় কার্যকর না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খেতে হবে।
* বদহজম : অতিরিক্ত খেলে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত পরিমাণে ভাজা এবং ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার, মশলাজাতীয় খাবার এ সমস্যার জন্য দায়ী। ডিম, কফি, মশুরের ডাল, গ্যাস তৈরি করতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে অতিরিক্ত পরিমাণে খাবেন না। ফ্রুট জুস খান, না পারলে ফ্রেস পানি খান প্রচুর। ভাজা খাদ্য বাদ দিন।
* তন্দ্রাভাব : লবণ বা পানি কম খেলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে করে শরীরে প্রচুর ঘাম হয়, দুর্বল লাগে, অসাড়ভাবসহ কোন কাজে শক্তি পাওয়া যায় না। রক্তচাপ কমে গেলে পাশাপাশি মূর্ছা যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। সাধারণত বিকেলের দিকে এমন হতে পারে। এজন্য ফ্লুইড এবং লবণ খাওয়া বাড়িয়ে দিতে হবে। শান্ত থাকতে হবে। রক্তচাপ মেপে দেখতে হবে। উচ্চরক্তচাপের রোগীদের ওষুধ খাবার ব্যাপারে রোজার সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
* ডায়াবেটিস : রোজার সময় ডায়াবেটিক রোগীদের বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো তাদের ওষুধ খেতে হবে, ইনসুলিন নিতে হবে বা জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। সাধারণত ইনসুলিন অনির্ভর বা টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে সঠিক খাদ্য নির্বাচনের মাধ্যমে চমৎকারভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
* মাথাব্যথা : ঘুমে ব্যাঘাত, সিগারেট বা ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় হঠাৎ করে বাদ দেয়ার ফলে এ উপসর্গ দেখা দিতে পারে। রক্তচাপ কমে গিয়েও মাথাব্যথা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য তীব্রতা থাকবে বেশি এবং ইফতারের আগে বমি বমি ভাব হবে। এ সমস্যা সমাধানে পরিমিত ঘুমাতে হবে, ধীরে ধীরে ধূমপান ও ক্যাফেইনসমৃদ্ধ পানীয় পান বাদ দিতে হবে।
* বøাড সুগার কমে যাওয়া : নন-ডায়াবেটিকদের ক্ষেত্রে সেহরীর সময় রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। শরীর অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি করায় রক্তে শর্করার মাত্রা কমে গিয়ে নানারকম উপসর্গ দেখা দিবে। দুর্বলতা, অসড়াভাব, মনোনিবেশে সমস্যা, মাথাব্যাথাসহ বুক ধড়ফড় করতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে সুগার সমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় অতিরিক্ত পরিমাণে সেহরীর সময় খাওয়া যাবে না।
* অস্থি সন্ধি ও পেশীতে ব্যথা : অনেকের, বিশেষ করে বৃদ্ধদের এবং অস্থি-সন্ধির প্রদাহে আক্রান্তদের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি নামাজ পড়তে গিয়ে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে করে সন্ধিতে ব্যথা হতে পারে, ফুলে যেতে পারে এবং অস্বস্তি লাগতে পারে। ক্যালসিয়াম, ম্যাগনিশিয়াম এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার কম খেলে পেশীতে ব্যথা হতে পারে। অস্থি-সন্ধির সমস্যা সমাধানে প্রথমত শারীরিক ওজন বেশি থাকলে তা কমাতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। পেশীর সমস্যায় শাকসবজি,ফল, ডেইরি প্রোডাক্ট, গোশত এবং খেজুর খেতে হবে। তবে উচ্চরক্তচাপের জন্য যারা ওষুধ খাচ্ছেন এবং কিডনিতে যাদের পাথরের সমস্যা আছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
যা ত্যাগ করবেন
* ভাজা এবং তেলসমৃদ্ধ খাবার খাবেন না।
* অতিরিক্ত সুগার সমৃদ্ধ খাবার ত্যাগ করবেন।
* অতিরিক্ত খাবেন না, বিশেষ করে সেহরীর সময়।
* সেহরীর সময় চা, কফি, সফট ড্রিংকস খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। এসব পানীয়তে প্র¯্রাব বেশি হবে। এতে করে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় লবণ বেরিয়ে যাবে। যা কিনা রোজার সময় শরীরের জন্য প্রয়োজন।
* ধূমপান নিষেধ।
যা করবেন
* প্রচুর পরিমাণে পানি খাবেন।
* শাকসবজি ও ফল খাবেন। ফল খাবেন প্রতি খাবারের পর।
* সেহরীর সময় কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট খেলে তা বেশি সময় পেটে থাকবে।
* খেজুর খাবেন। এতে আছে সুগার, ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম।
* কলাও বিশেষ উপকারী। কার্বোহাইড্রেট, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস কলা।
* পরিমিত ঘুমাবেন।
* হালকা ব্যায়াম করবেন।
* নিয়মিত রাতে ঘুমাবার আগে ও সেহরীতে খাবার পর দাঁত ব্রাশ করবেন।
ডা. জহুরুল হক সাগর
zhsagar@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন