শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

নিয়মের পরিবর্তন হওয়া উচিত

প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল
আমরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করছি, যেখানে সবকিছু মনে হয় যেন অন্ধের হাত ধরে চলছে। মাঝে মধ্যে আবার এমনও মনে হয়, আমরা দেশবাসী যেন অলীক এক স্বপ্নের ভেলায় চড়ে সর্বত্র বিচরণ করছি। কোথাও যেন কোনো ধরনের স্থির চিন্তার বিকাশ নেই। বড় কর্তারা নিজেরা ভালো থাকেন বলে মনে করেন দেশের সবাই খুব ভালো আছে। মানুষের বুকের ভিতরের রক্তক্ষরণের খবর তারা আর রাখেন না। দেশের চারিদিকের হালচাল দেখলে যে কেউ মনে করবে, যে যেমন ভাবে পারেন, তেমন ভাবেই সব পাওয়া না পাওয়ার ব্যাখ্যা করতে চান। কিন্তু প্রত্যেক মানুষই নিজের মতো থাকতে চায়। নিজের জীবনকে অন্যের ব্যাখ্যা মতো চালাতে চায় না। যদি সে নিজের জীবনকে অন্যের ব্যাখ্যা মতো চালাতে চায়, তাহলে তার পক্ষে সম্ভব নয় সুখ শান্তির মুখ দেখা। চলমান অবস্থায় এখন কেউ কারো প্রজা হয়ে থাকতে চায় না। মানুষ এখন সচেতন। সচেতন জনগোষ্ঠী আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। কেউ ইচ্ছে করলেই চলমান সময়ে কাউকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পিছনে ঠেলে দিতে পারবে না। অন্যায়-অবিচার আমাদের যতই গ্রাস করুক না কেন, তারপরও আমরা জ্ঞান-বুদ্ধি আর চিন্তার জগতে প্রগতির আহ্বান ঠিকই শুনতে পাই কিংবা পাচ্ছি। সেই প্রগতির আহ্বান আমাদের বলে দেয় আমরা কতোটা সমৃদ্ধ করেছি আমাদের ভাবনার পরিধিকে। আমরা যদি আজ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ফিচার, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্পাদকীয় কিংবা উপ-সম্পাদকীয় সমূহের দিকে চোখ মেলে তাকাই, তাহলে আমরা ঠিকই বুঝতে পারবো, আমাদের ছেলেমেয়েরা অর্থাৎ আমাদের আগামী প্রজন্ম কতোটা সহজভাবে চিন্তা করতে পারে আমাদের সমাজ সংসার সম্পর্কে। তাদের চেতনার গভীরতা এতোই যে, তাদের বলা যায়, তোমরাই ঠেকাবে সকল অন্ধত্ব আর অনাচারকে। তোমাদের আলোর জগতে রাশি রাশি অন্ধকার ঢেলে দিয়ে যদি কেউ তোমাদের বিপথগামী করতে চায়, তোমরাই তাদের প্রতিরোধ করবে নির্ভয় চিত্তে। সেই বিশ্বাস তোমাদের বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ দেখে, যে কেউ তোমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারবে। কিন্তু তারপরও কথা থাকে। আজকাল আমরা এমন সব বিষয় পত্র-পত্রিকায় দেখতে পাই, যা দেখে কেবলই মনে হয়, আমরা কিসের মধ্যে বসবাস করছি কিংবা আছি? মনে প্রশ্ন জাগে তারা কারা, যারা আমাদের আলোর জগতে অন্ধকার ছড়াতে চায় আমাদের চিন্তাকে অন্যত্র সরিয়ে দেবার জন্য ?
সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা গেছে, নির্বাচিত হয়েও পুলিশের চাকরি পাচ্ছে না শ্রাবণী। ওই সংবাদে বলা হয়, জন্ম থেকেই ময়মনসিংহ শহরে বসবাস শ্রাবণী দত্তের। তবে নিজেদের বাসাবাড়ি নেই। থাকে ভাড়া বাসায়। তাই তিনি স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে নি। এ জন্যই পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি হয়নি তার। শ্রাবণী ও তার পরিবারের দাবি- লিখিত, মৌখিক ও অন্যান্য পরীক্ষার পর পুলিশ কনস্টেবল পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছিলে শ্রাবণী রানী দত্ত। কিন্তু ভাড়া বাসায় থাকার অজুহাত দেখিয়ে চাকরি থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়। জানা যায়, শ্রাবণী রানী দত্তের মূল বাড়ি হচ্ছে নেত্রকোনা জেলায়। সেখানে তাদের কিছুই নেই। প্রায় চল্লিশ বছর আগে শ্রাবণী দত্তের বাবা নেত্রকোনা থেকে ময়মনসিংহ শহরে আসেন এবং ওঠেন এক ভাড়া বাড়িতে। এখানেই শ্রাবণী রানী দত্ত জন্মগ্রহণ করেছে। নেত্রকোনা জেলায় আর যায়নি। শ্রাবণী বড় হয়েছে ময়মনসিংহ শহরে। এই ময়মনসিংহ শহরকেই তার স্থায়ী নিবাস হিসেবে জেনেছে। অথচ আজ যখন চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে সব ঠিকঠাক, তখন সে জানল তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। যারা নিজেদের ভিটে মাটি থেকে উৎখাত হয়ে কিংবা যাদের নিজস্ব ঘর দুয়ার নেই কিংবা মাটি নেই জমি নেই তাদের বলা হয়ে থাকে উদ্বাস্তু। শ্রাবণী রানী দত্তের তাহলে ঠিকানা কোথায়? তারতো স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। যাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা থাকে না তার অনেকে ভবঘুরে কিংবা যাযাবর বলে থাকে। কিন্তু শ্রাবণী দত্ততো ভবঘুরে কিংবা যাযাবর নয়। রাষ্ট্রের ভিতরে যার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, তাকে কি রাষ্ট্রহীন মানুষ বলা যায় ? শ্রাবণী দত্ততো রাষ্ট্রহীন মানুষ নয়। কেননা সে এই দেশের নাগরিক। যদি রাষ্ট্রহীন মানুষ হয়ে থাকে তাহলে তার দায়িত্ব কে নেবে। যেহেতু তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই, সেখানেতো অন্য কোনো চাকরি পাবার কোনো সুযোগই ওর নেই। এ ব্যাপারে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপারের বক্তব্য হলো, এই নিয়ম অনেক আগের। আমাদের কিছু করার নেই। শ্রাবণী দত্তের বক্তব্য হলো, বৈধ নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ভাড়া বাড়িতে থাকার কারণে একটি জেলার স্থায়ী বাসিন্দার স্বীকৃতি না পাওয়া দুঃখজনক। এই ধরনের নিয়মের পরিবর্তন হওয়া উচিত।
এই নিয়ম হয়তো একদিন ছিল অর্থাৎ ভাড়াবাড়িতে থাকলে সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে স্থায়ী ঠিকানার জটিলতা দেখা দেবে। তখন মানুষের সংখ্যা ছিল খুব কম। তখন যারা লেখাপড়া করতো তারা ছিল উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনের সন্তান। তাদের গ্রামে যেমন বাড়ি থাকতো তেমনি করে শহরেও বাসা থাকতো। যাদের পয়সা-কড়ি ছিল না অর্থাৎ সেইসব দরিদ্র জনগোষ্ঠী লেখাপড়া করতো না। তারা জীবিকার তাগিদে শহরে আসলেও পড়াশুনার ধারে কাছেও ঘেঁষতো না। তারা ভাড়া বাসায় কিংবা বস্তিতে থাকতো। এখন কিন্তু সেই সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। এখন দরিদ্র একজন দিনমজুরও ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চায়। একজন দিনমজুর পিতা আশা করে না তার সন্তানও একজন দিনমজুর হোক কিংবা অফিস আদালতে যারা ছোট চাকরি করে, তারাও স্বপ্ন দেখে না তাদের সন্তান অফিস-আদালতে ছোটখাটো চাকরি করুক। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা এখন পরিবর্তনের হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছি। এখন মান্দাতার আমলের চিন্তা ভাবনা নিয়ে চলাফেরা করলে চলবে না। সময়ের ডাক শুনে শুনেই আমাদের চলতে হবে। চলমান সময়ে আমরা প্রগতির পতাকা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাব, এটাই আমাদের ব্রত ও প্রতিজ্ঞা। রাষ্ট্রের উচিত তার আইন-কানুনে পরিবর্তন আনা। যে পরিবর্তন শ্রাবণী রানী দত্তের মতো মেয়েদের ঠিকানাহীন কিংবা রাষ্ট্রহীন করে তুলবে না।
লেখক : কবি, গল্পকার ও আইনজীবী
কালীবাড়ি রোড, হবিগঞ্জ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন