শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মানুষের অপরাধ প্রবণতা

| প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এস এম মুকুল : কিছু দিন আগের কথা, ধামরাইয়ের জঙ্গলে পলিথিনের ব্যাগে ভরা এক শিশুকে জীবিত উদ্ধার করেছে এলাকাবাসী। ধামরাইয়ের শুয়াপুর পুকুরপাড় গভীর জঙ্গলে পলিথিনের ব্যাগে ভরে ফুটফুটে নবজাতককে কে বা কারা ফেলে চলে যায়। ভোররাতে পথচারীরা শিশুটির কান্না শুনে প্রথমে ভয়ে দৌড় দেয়। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে সবাই মিলে জঙ্গলে গিয়ে পলিথিনের ব্যাগ থেকে শিশুটি উদ্ধার করে। নিকট অতীতে আরেক লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে। বংশদ্ব›েদ্ব ৪ শিশুকে খুন করে মাটিচাপা দেওয়া হয় সেখাণে! আমরা কি আদিম নৃশংসতার যুগে চলে যাচ্ছি? কেন এমন ঘটছে- এর বহুবিদ ব্যাখ্যাই দেয়া যেতে পারে। মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, সমাজবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, অপরাধ বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা, মূল্যবোধে, ধর্মীয় আচার ও সামাজিক বৈষম্যের ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষের মাঝে এত হিং¯্রতা আধুনিক সভ্যতায় এত নির্মম হতে দেখা যায়নি। কেন জানি মনে হচ্ছে, মানুষরা আবারো আদিম বর্বরতার ফিরে যেতে চাচ্ছে! সত্যি সত্যি যেন এমনটা না ঘটে সেটাই প্রত্যাশা। সৃষ্টির সেরা জীবের মাহাত্ম্য আমরা যেন রক্ষা করতে পারি। একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে- শত বিরোধ, প্রতিহিংসা থাকলেও মানুষে মানুষে এত খুনোখুনির বর্বরতা ছিলো না। হীন স্বার্থের দ্ব›েদ্ব মানুষ মানুষের জীবন নিয়ে নিত না। শিশু ও নারীর বিষয়গুলো ছিলো আরো স্পর্শকাতর। আধুনিক সভ্যতায় মানুষজাতি শিখেছিলো- নারী ও শিশুর প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে হয়। কিন্তু আজকের সভ্যতায় আমরা এসব কি দেখছি, জানছি?
চোখ বন্দ করে ভাবলেই একথার প্রমাণ পাই। অপরাধ প্রবণ মানুষ কিনা করে। বনের পশুকে শিকার করার কৌশলকে ক্রমাগতভাবে মানবজাতির উপরই প্রয়োগ করছে এখন। খাবারে বিষ মেশায় মানুষ, ওষুধে ভেজাল করে মানুষ। আধুনিক নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ নিজেদের সর্বনিম্ন ঝুঁকিতে রেখেই বেশি বেশি শিকার সম্পন্ন করতে নেমে পড়েছে। মানুষের এই আধিপত্যের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অন্যান্য প্রাণি ও প্রজাতির ওপর। শিকারি হিসেবে মানুষের নিষ্ঠুরতা এবং বিভিন্ন প্রাণির ওপর তার প্রভাব নিয়ে সারা বিশ্বের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কানাডার একদল বিজ্ঞানী সায়েন্স সাময়িকীতে বলা হয়েছে, সামুদ্রিক প্রাণিদের শিকার হয়ে পূর্ণবয়স্ক মাছের সংখ্যা যত কমেছে, মানুষের কারণে কমেছে তার চেয়ে ১৪ গুণ বেশি। আর স্থলে ভালুক, নেকড়ে ও সিংহের মতো বিভিন্ন শিকারি প্রাণী হত্যা করছে মানুষ। এসব প্রাণি পরস্পরকে যে হারে শিকার করে, সেই তুলনায় তারা নিজেরাই মানুষের শিকার হচ্ছে নয় গুণ বেশি। গবেষণায় তাঁরা দেখতে পান, শিকারি মানুষের আগ্রাসন জলে-স্থলে অন্যান্য প্রজাতির জন্য এতটাই বিপর্যয়কর যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব প্রাণির ক্রমবিকাশের ধারাই বদলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগে মানুষ বিপজ্জনক নানা উপায়ে শিকার করত। এখন অত্যাধুনিক বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাণি হত্যা করা হচ্ছে। স্তন্যপায়ী প্রাণি হত্যায় বন্দুকের গুলি এবং মাছ শিকারে জাল ও হুক ব্যবহার করা হচ্ছে। নিজেদের নিরাপদে রেখেই শিকার করার এই সুবিধাটা অন্য কোনো শিকারি প্রাণী পায় না।
কি অবাক কান্ড- আমরা নির্বিচারে গাছ কেটে বন উজার করে ফেলছি। তাতে কি হচ্ছে ভেবে দেখুন। বনের পশু পাখি, কীট-পতঙ্গ, পোকা-মাকড় তাদের অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। পশু পাখিরা পোকা মাকড় খায়- যেসব পোকা মাকড় আমাদের শস্য ও ফসলের ক্ষতি করে। এই প্রাণিজগৎকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব ক্ষমতা ও গুণাগুণ দিয়ে- যারা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে মানবজাতির নিরাপত্তা দিচ্ছে। আর সেই মানবজাতি তাদেরকে ধ্বংস করে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে! ধেয়ে আসছে- টর্নেডো, ঘুর্ণিঝড়, প্লাবন, বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প, অদ্ভুত রোগবালাই।
মানুষের অপরাধ প্রবণতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে দেখুন। কবর থেকে লাশ তুলে কঙ্কাল নিয়ে বিক্রি করছে। জীবন্ত মানুষের কিডনি কেটে নিয়ে লাশ ফেলা হয় নদীতে। কিছু দিন পূর্বে রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে কিডনি পাচারকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারকতৃদের তথ্যে জানা যায়, ভারতের কয়েকটি হাসপাতালে এসব কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। তাদের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের কিছু চিকিৎসকের যোগাযোগ রয়েছে। রোগীদের টার্গেট করে তাদের কাছে এসব কিডনি বিক্রি করা হতো। ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে কলকাতার একটি হাসপাতালে গিয়ে এসব কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো। গোয়েন্দা মুখপাত্রের ব্রিফিংঅনুযায়ী, এই চক্র খুবই ভয়ংকর। যারা কিডনি দিতে অস্বীকার করে তাদের অজ্ঞান করে কিডনি নেওয়া হতো। বিদেশি টিভি সিরিয়াল দেখে প্রভাবিত হয়ে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে নাটোরে তানভীর হোসেন নামে এক মাদ্রাসাছাত্রকে হত্যা করেছে তার তিন সহপাঠী। ঘটনাটি ঘটেছে শহরের আলাইপুর এলাকা আশরাফুল উলুম মাদ্রাসায়। অপহৃত ওই মাদ্রাসাছাত্রের লাশ সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার ও তার তিন সহপাঠীকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের দেয়া তথ্য মতে শহরের আলাইপুর এলাকা আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার পাশের একটি বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে তানভীরের জবাই করা লাশ উদ্ধার করে। বিদেশী সিরিয়াল দেখে অপহরণ ও হত্যাকান্ডে উৎসাহিত হয় বলে স্বীকার করেছে তিন হত্যাকারী।
অপরাধ প্রবণ মানুষের ফাঁদচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে মূলত মানুষই। যেমন যে ব্যক্তি কার্বাইড দিয়ে কলা পাকায়, সেই ব্যক্তি বিষাক্ত ওষুধ দিয়ে পাকানো অন্য ফল, ফরমালিনযুক্ত মাছ খায়। আবার যে ব্যক্তি ফরমালিন মিশিয়ে মাছ বিক্রি করে, সেই ব্যক্তি অতিরিক্ত কীটনাশকযুক্ত ফলমুল, সবজি নিয়ে পরিবার সহ ঠিকই খাচ্ছে। ভেবে দেখলে সহজ হয়ে যায় ব্যাপারটা। কোনো প্রকার ফাঁদ পেতে অন্যকে শিকার করলেও নিজের জন্যেও অনেক অনেক ফাঁদ পাতা আছে এই মানুষ সমাজে- এ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নাই। উপায় আছে অনেক, আর তা হলো- সৎ, সুন্দর জীবন যাপন করা। অতিলোভী মানসিকতা পরিহার করা। একা সব ভোগ করার প্রবণতা পরিত্যাগ করা। যেকোনো মূল্যে অর্থ কামানো মানসিকতা পরিহার করা।
লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন