বিশিষ্ট রাজনীতিক, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের ১৫৯ নম্বর প্লটের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাড়ির সমস্ত মালামাল অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রাজউক। মওদুদ আহমদ গত ৩৬ বছর ওই বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করছিলেন। বাড়িটির ব্যাপারে একটি মামলা সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গেলে রায় মওদুদ আহমদের বিপক্ষে যায়। আপিলের রায় পুনর্বিবেচনায় জন্য তিনি আবেদন করলে গত রোববার আদালত তা খারিজ করে দেন। অত:পর কালবিলম্ব না করে রাজউক উচ্ছেদ অভিযান চালায়। মওদুদ আহমদ অভিযোগ করেছেন, রাজউকের এই বাড়ি দখল সম্পূর্ণ বেআইনী। বিরোধীদলের নেতা হওয়ার কারণেই সরকার গায়ের জোরে বাড়িটি দখলে নিয়েছে। এব্যাপারে রাজউক কোনো কাগজ পত্র বা আদালতের নোটিশ দেখাতে পারেনি। তিনি আরও অভিযোগ করেছেন, দেশে আইন নেই, বিচারও নেই। আপিল বিভাগের রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। এতে কি পর্যবেক্ষণ আছে তা দেখার সুযোগ হয়নি। তিনি জানিয়েছেন, তাকে যাতে ডিস্টার্ব না করা হয় সেজন্য নি¤œ আদালতে মামলা করেন এবং তাতে সমনও জারি করা হয়। এসবের তোয়াক্কা না করে বাড়ি থেকে তাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সরকারী দলের কেউ হলে কি সরকার এমন আচরণ করতো, প্রশ্ন মওদুদ আহমদের। বলা বাহুল্য, যেভাবে তড়িঘড়ি করে রাজউক বাড়িটি দখলে নিয়েছে তাতে দ্বিমুখী নীতির পরিচয় স্পষ্টত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ দখলদারদের কবলে রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সম্পদ ও সম্পত্তি কত যে অবৈধ দখলদারদের কবজায় আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এই অবৈধ দখলদারিত্বের অধিকাংশের সঙ্গে সরকারী দলের লোকেরা জড়িত। অথচ এসব সম্পদ-সম্পত্তি দখলমুক্ত করে সরকারের নিয়ন্ত্রনে নেয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। রাজউকেরও অনেক সম্পত্তি অবৈধ দখলে রয়েছে। সে সব সম্পত্তি উদ্ধারে রাজউককে এতটা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে দেখা যায়নি। রাজউকের কর্মকর্তারাই বলেছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আসলে কে, কখনো সে কথা জানানো হয় না। রাষ্ট্র বা সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশীল মহলেই যে সেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, তা বুঝতে বাকী থাকেনা। অতএব বলতেই হয়, এটি মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল। মওদুদ আহমদ প্রবীণ রাজনীতিক, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, ও মন্ত্রী। তিনি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তি যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। একই সঙ্গে তিনি খ্যাতিমান আইনজীবী এবং লেখক। এই সম্মানিত ব্যক্তির সঙ্গে সরকার ও রাজউক যথাচিত আচরণ করেনি, যা করা উচিৎ ছিল।
প্রচলিত আইনে কাউকে উচ্ছেদ করতে হলে আগে নোটিশ দিতে হয়। একটি নির্দিষ্ট সময় বেধে দিয়ে বলতে হয়, এই সময়ের মধ্যে দখল ছেড়ে দিতে হবে। এর অন্যথা হলে উচ্ছেদ অভিযানের প্রশ্ন ওঠে। মওদুদ আহমদের বক্তব্য মতে, আইনের এই বাধ্যবাধকতা এ ক্ষেত্রে প্রতিপালিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, আদালতের পূর্ণ রায় প্রকাশিত না হওয়ায় রায় ও পর্যবেক্ষণের পুরোটা জানা সম্ভব হয়নি। তাই কোনো পদক্ষেপ নিতে রায়ের পুরোটা প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিৎ ছিল, যা করা হয়নি। তৃতীয়ত, মওদুদ আহমদ নি¤œ আদালতে মামলা করেছেন। আদালতের তরফে সমন ও শুনানির তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। মামলাটি বিন্দুমাত্র আমলে নেয়া হয়নি। চতুর্থত, বাড়িটি রাজউক দখল বা নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে কিনা সে প্রশ্নও আছে। বাড়িটি ব্যক্তির সম্পত্তি সরকারের নয়। মওদুদ আহমদ জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের রায়ে এ কথা বলা হয়েছে। যদি সেটা হয়, তাহলে রাজউক কিভাবে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারে? যার বাড়ি তিনি বা তার উত্তরাধিকারীর পক্ষে আইন ভূমিকা রাখতে পারে, রাজউক বা সরকারের পক্ষে রাখার কথা নয়। এসব বিবেচনায় নিয়ে এটা বলা বোধ হয় অসমীচীন হবে না, রাজনৈতিক নিদের্শনায় রাজউক এই হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে আইনের ব্যতিক্রম করার পাশাপাশি মান্যমান ব্যক্তিকে অসম্মান ও অশ্রদ্ধা করা হয়েছে। রাজউক কর্তৃপক্ষ পরেও এই উচ্ছেদ অভিযান চালাতে পারতো। সেটা না করে দ্রæত অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করে কথিত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টি হাসিল করলেও সংস্থা হিসাবে তার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছে। এ ঘটনা একই সঙ্গে দুর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।
সন্দেহ নেই, মওদুদ আহমদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ খারাপ নজির হয়ে থাকবে। যেমন বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ খারাপ নজির হয়ে আছে। খালেদা জিয়া কিংবা মওদুদ আহমদ মূলত রাজনীতিক এবং বৃহত্তম একটি দলের শীর্ষ বা শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, যে দলটি দীর্ঘদিন দেশ পরিচালনা করেছে। বলা হয়, আইন সকলের ক্ষেত্রে সমান। খালেদা জিয়া কিংবা মওদুদ আহমদকে বাড়ি থেকে যেভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাতে আইন যতটা কাজ করেছে তার চেয়ে অনেক বেশী কাজ করেছে জোর-জবরদস্তি, যা ক্ষমতাসীনদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাদের সম্মান নয়, অত্যন্ত অসম্মান ও অশ্রদ্ধার সঙ্গে বাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। রাজনীতিতে আদর্শগত বিরোধ, লক্ষ্য-কর্মসূচীগত পার্থক্য, ক্ষমতার দ্ব›দ্ব নতুন কিছু নয়। কিন্তুু আমাদের দেশে বৃহৎ দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এ বিষয়গুলোর পাশাপাশি আরও যা রয়েছে তা হলো, প্রতিহিংসাপরায়নতা, সংঘাতমূলক প্রবনতা, পরস্পরিক অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা। এক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অপর দলের নেতৃবৃন্দের সম্পর্ক ব্যতিক্রম বাদে এতটাই খারাপ যে, কথাবার্তা ও মুখ দেখা-দেখি পর্যন্ত হয় না। শ্রদ্ধা, সম্মান, সহিষ্ণুতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিরলদৃশ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, কোনো একটি দল অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে। একদিন না একদিন তাকে ক্ষমতা ছাড়তেই হবে। সেদিন যেন তার কৃতকর্মের অনুরূপ কর্মের শিকারে পরিণত হতে না হয়, সেকথা সর্বদা খেয়াল রাখা উচিৎ। যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো, ভবিষ্যতেও যদি সেই দৃষ্টান্তের অনুসরণ লক্ষ্য করা যায়, তাহলে নিশ্চয় এখনকার ক্ষমতাসীনদের তা ভালো লাগবে না। এরকম ঘটনা না ঘটুক, একান্তভাবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন