মিজানুর রহমান বুলেট, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের বেহাল দশা। রোগিরা পড়েছে চরম দুরাবস্থায়। হাসপাতালের টয়লেট-বাথরুম ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবার মান। ১১ মাস ধরে ইওসি বিভাগ বন্ধ। ফলে গর্ভবতী মায়েরা পড়েছে চরম বিপাকে। দুই মাস ১২ দিন বয়সী শিশু আবু বকরকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মা মিতু বেগম। চার দিন হাসপাতালে অবস্থান করেন। তিনদিনের মাথায় সকালে ৫টাকা দামের একটি বনরুটি, একটি সাগর কলা এবং এক চিমটি চিনি দেয়া হয়। আর কোন খাবার জোটেনি। এ কয়দিনে বিছানার চাদর বদলানো হয়নি। কভারবিহীন বালিশ। তেলচটা অবস্থা। সর্বত্র ময়লা-আবর্জনা। দুইটি বাথরুমের একটি দরজা অর্ধেক ভাঙা, একটি নেই। ভেসিন ভাঙা। টয়লেটেরও একই অবস্থা। ব্যবহার উপযোগি নয়। একই দশা মহিলা ওয়ার্ডের। দুর্গন্ধে একাকার। ময়না-আবুল দম্পতি ভর্তি হয়েছিলেন চারদিন আগে। একদিন আগে থেকে খাবার পান তারা। দুপুরে এক টুকরো ছোট্ট সাইজের রুই মাছ (নলা মাছের মতো) আর ডাল দিয়ে দুই বেলা খেতে দেয়া হয়। বালিশের কভার নেই। বিছানার চাদর পাল্টায়নি এ চারদিনে। এ বিভাগেরও দু’টি বাথরুমের নিচের অর্ধেক দরজার তক্তা নেই, ভাঙা। টয়লেটেরও অর্ধেক দরজা নেই। আম্বিয়া খাতুন ভর্তি ১০দিন ধরে। তার কথা মতে ১০দিন পরে ফ্লোর মোছা হয়েছে। গোটা হাসপাতালের বেহাল দশার এটি খ-চিত্র। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেল, মহিলা ওয়ার্ডে ৩৫ জন এবং পুরুষ ওয়ার্ডে ৩৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি। কাগজ-কলমের হিসাব এটি। বাস্তবে অনেক রোগী শয্যায় নেই। ভর্তি হয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করছেন। যেন কোন নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। আলাউদ্দিন বিশ^াস ও বিলকিছ দম্পতি জানালেন, হাসপাতালে এক্সরে মেশিন ভাল থাকলেও তাদেরকে বাইরে থেকে ৩৫০ টাকায় এক্সরে করাতে হয়েছে। ইসিজি করাতে হয়েছে ৩৫০ টাকায়। নিয়মিত চিকিৎসকের দেখা পায় না রোগিরা। সকল ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। ৭০ বছর বয়সী প্রফুল্ল চন্দ্র মিত্র জানালেন, লেট্রিন ব্যবহার করা যায় না। নার্স-আয়া কিংবা ব্রাদার এদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের এন্তার অভিযোগ। মোট কথা হাসপাতালটিতে নেই কোন প্রশাসন। ডা. লোকমান হাকিমকে কলাপাড়ায় ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার পর থেকেই হাসপাতালের প্রশাসন ব্যবস্থায় বেহালদশা। ভেঙে পড়েছে চেন অব কমান্ড। ভারপ্রাপ্ত হয়েও তিনি তা নেমপ্লেটে লিখছেন না। ইউএইচএর একটি কক্ষ এবং তার নিজস্ব চেম্বারের জন্য আরও একটি কক্ষ তিনি দখল করে রেখেছেন। নিজে এনেসথেসিয়ার চিকিৎসক হয়েও ওই দায়িত্ব পালন না করায় সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ রয়েছে। একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আব্দুল ওয়াদুদ থাকা সত্ত্বেও মার্তৃস্বাস্থ্য সেবা (সিজারিয়ান) বন্ধ হয়ে আছে উপজেলা স্বাস্থ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার (ভারপ্রাপ্ত) কারণে। অজ্ঞানের বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ তার থাকলেও তিনি তা করছেন না। তাই বন্ধ হয়ে আছে ইওসি বিভাগ। বাধ্য হয়ে গরিব প্রসূতিরা ১০-২০ হাজার টাকা ব্যয় করে নিকটস্থ কোন ক্লিনিক কিংবা পটুয়াখালী-বরিশালে গিয়ে সিজার করে সন্তান প্রসব করান। অথচ ইওসি বিভাগ চালু থাকাকালে ফি মাসে ৩০/৩৫ জন মা সিজারিয়ান সুবিধা নিত। পেত মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমের সহায়তা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত কলাপাড়ায় মোট ১৪ হাজার ৮০ জন মা সন্তান প্রসব করেন। যার মধ্যে সিজারিয়ান পদ্ধতি অবলম্বন করেন ১১৮০ জন। ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল প্রমোশনজনিত কারণে ডা. আব্দুর রহিম অন্যত্র বদলি হওয়ার পর থেকে এনেসথেসিস্ট ডা. লোকমান হাকিম ভারপ্রাপ্ত ইউএইচএ হিসেবে কলাপাড়ায় যোগদান করলেও ইওসি সম্পূর্ণভাবে তার খেয়ালীপনায় বন্ধ হয়ে আছে। স্বাস্থ্যবিভাগ সূত্রে এও জানা গেল, বর্তমানে কলাপাড়ায় প্রসূতির সংখ্যা সাত হাজার ২৬০ জন। তাই নিরাপদ সন্তান প্রসবের জন্য ইওসি বিভাগ চালু করা জরুরি প্রয়োজন। এছাড়াও হাসপাতাল চলাকালে ক্যম্পাসে অসংখ্য দালালের অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। এরা তাদের সুবিধা অনুসারে রোগিকে নিজস্ব চিকিৎসকের কাছে পাঠায়। এজন্য মাসোহারা পেয়ে আসছে। দুই একজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে ক্লিনিকের সঙ্গে পার্টনারশিপ ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। অফিস আওয়ারে দুই একজন ডাক্তার ছাড়া সবাই ভিজিট নেন। অফিস আওয়ারে ক্লিনিকে অবস্থান করারও এন্তার অভিযোগ রয়েছে। মোটকথা কলাপাড়া হাসপাতালে এখন চলছে চরম অরাজক পরিস্থিতি। যেন কোথাও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সম্প্রতি এসব অনিয়ম রোধে কলাপাড়ায় ছয় বছরের বেশি সময়কাল চাকরি করা কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করার একটি সিদ্ধান্ত হয়। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে সাগরপারের এ জনপদের মানুষ সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি চিকিৎসা সেবা পায় না। ফিরতে হয় শুধুমাত্র ব্যবস্থাপত্র হাতে নিয়ে। যদিওবা ওষুধ মেলে তা প্যারাসিটামল কিংবা গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট। মানুষ এর প্রতিকার চেয়েছেন। আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এইচ মাহবুব আলম জানান, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও রোগির জন্য খাবার বরাদ্দ রয়েছে ৩১ জনের। গড়ে এখানে ইনডোরে রোগি ভর্তি থাকছে ৫০/৬০ জন। আর আউটডোরে ১১০ থেকে ১২০ জন। হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও এ চিকিৎসক জানালেন। উল্লেখিত অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. লোকমান হাকিম জানান, আমি এনেসথেসিয়া কোথাও করি না। আর এনেশথেশিয়ার চিকিৎসক ডা. ফরহাদ সাহেব একটি কোর্স সম্পন্নের জন্য চলে গেছেন, তাই সিজারিয়ান বন্ধ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন