আফতাব চৌধুরী
আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। রাষ্ট্র, সমাজ ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে এবং স্তরে পুরুষের সমপর্যায়ে নারীর অধিকারবাদের এক উজ্জ্বল দিন। অবশ্য বলতে হয় সমানাধিকারের দাবি যেন পশ্চিমা দেশের প্রগতির অন্তিম ধারায় পর্যবসতি না হয়। তাদের মতো যেন বলতে না হয়, আমরা পুরুষের চেয়ে কম কীসে? শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, দক্ষতা-যোগ্যতা, কোনো বিষয়ে যখন কম নই, তখন পুরুষের কাছে নতমস্তক হব কেন? সুতরাং দেশে-বেশে, আচারে-ব্যবহারে, আহারে-বিহারে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে বাধা কোথায়? অন্তত আজকের দিনে বাংলাদেশী নারীদের স্মরণ করা উচিত নারীত্বের সর্বোচ্চ মহিমা-গরিমার সেই প্রাচীন দিনগুলো যাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা যায়। পরস্ত্রীলোলুপ বহিরাগতের পৈশাচিক কবল হতে আত্মরক্ষার দায়ে যে সময় বাংলাদেশী নারী সমাজকে অবগুণ্ঠন বা পর্দা প্রথায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সে-সময় থেকেই নারী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তারই শোচনীয় পরিণামে বাংলাদেশী নারীশিক্ষা এক নিদারুণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খায়। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী অবরুদ্ধ থাকায় নারী-পুরুষ অপেক্ষা পিছিয়ে পড়লেও সব নারী কিন্তু দুর্জয় তেজ-বীর্য হারায়নি। সেই সময়ের অত্যাচার নির্যাতনের মধ্যেও এক শ্রেণীর নারী অসামান্য ক্ষাত্রবীর্য নিয়ে উদ্দীপ্ত ছিলেন।
আমরা স্বীকার করি ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে নারীশিক্ষার হার আজ পুরুষের সমপর্যায়ে উন্নীত। সেই সঙ্গে সমান অধিকারের দাবিও সোচ্চার। কিন্তু আমাদের স্বীকার করতে হবে, রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থা হতে এক দল মহীয়সী নারী যে বাগ্মিতাশক্তি ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তা আজ বিশ্বের অজানা নয়। আন্দোলনের বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন এবং নিজের কর্মপ্রতিভার পরিচয় দিয়ে গেছেন।
অবশ্য বলতে হয়, নারী শিক্ষা-দীক্ষায় পুরুষের পাশে দাঁড়ানোর অধিকার লাভ করলেও পরিবার ও সমাজজীবনে বহু নারী আশানুরূপ শান্তি ও সন্তোষ লাভ করতে পারেনি। নারীর অধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রও সজাগ। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ যাতে না-থাকে সে ব্যাপারে আইনের ব্যবস্থা আছে। এত কিছুর পরও নারী নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি বেড়েই চলছে। শিক্ষা-দীক্ষা কিছুই পারছে না। বহু নারী যেমন অনেক ক্ষেত্রে নারীত্বের মর্যাদা হারিয়েছে। একদল পুরুষের ক্ষেত্রে নারী শুধুই ভোগ-লালসার সামগ্রী। শিক্ষিত-অশিক্ষিত দুটি দিক একই অবস্থায় আছে। উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত পুরুষের ভোগ-লালসার যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় লালসার শিকার যেমন রুচিমার্জিতা নারী হচ্ছে, ঠিক একদল নারী শিকার ধরে দেবার ফাঁদও তৈরি করে পুরুষকে প্রলোভিত করছে।
বিকৃত মানসিকতার নারী-পুরুষ যেমন আছে, সুস্থ মানসিকতার নারী-পুরুষও আছে। যারা কোনোদিন-কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না। বরং দেখা গেছে বহু পুরুষই নারীকে বেশি সম্মান দেন। বলতে অসুবিধা নেই যে, এ দেশের অনেক পরিবারই নারী-পুরুষের সম্মিলিত শক্তিদ্বারা সুষ্ঠুরূপে গড়ে উঠেছে। তাছাড়া বহু পুরুষই ঘর গৃহস্থলিতে নারীর অবদানকে অগ্রাহ্য করেন না। সেই সঙ্গে বহু স্বামী তার রোজগারের টাকা আগেও যেমন স্ত্রীর হাতে তুলে দিতেন, বর্তমানেও দিচ্ছেন।
বলতে দ্বিধা নেই, বহু-স্ত্রীর তাদের স্বামীর পদানত রাখার নজির যেমন আছে, তেমনি বহু স্বামী তাদের স্ত্রীদের পদানত রেখে অত্যাচার করার নজিরও আছে। তাহলে মানুষ নামক জীব সে পুরুষই হোক বা নারীই হোক সুখ-শান্তি ভোগ করতে পারে না। ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল অর্থ না বুঝে স্বাধীনতার কথা অনেকেই বলেন। কিন্তু স্বাধীন সত্তার অর্থই অনেকে জানেন না। পুরুষ স্বাধীনতা ও নারী স্বাধীনতা বলতে যে আলাদা কোনও স্বাধীনতা নেই, যেই স্বাধীনতা প্রকৃতিজাত স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকার কোনও নারী-পুরুষের নেই। যদি তা ঘটে তাহলে এক সাথে নারী-পুরুষের রুখে দাঁড়াতে হবে।
একই জীবন সত্তার কথা আজ প্রচার করার সময় হয়েছে। পুরুষতন্ত্র ও নারীতন্ত্র বলতে কিছু নেই তা পরিষ্কার করা দরকার। পুরুষহীন নারী যেমন থাকতে পারে না, নারীহীন পুরুষও থাকতে পারে না। এই উভয়কে নিয়েই আছে মানবতন্ত্র। যা বাঁচা-বাড়ার ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন।
পুরুষতন্ত্র পুরুষের এক মনগড়া তন্ত্র। স্নায়ুতন্ত্রে ওই তন্ত্রকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়ায় পুরুষ জন্ম থেকে হয়ে উঠে ক্ষমতাশালী এবং নারীর রক্ষক। আসলে কেউ কারও রক্ষক নয়। সবাই নিজে নিজেই রক্ষক হবার ক্ষমতা অর্জন করে। সত্যি সত্যি নারী জাগরণ যদি ঘটে তাহলে প্রতিটি ঘরের মনুষ্যত্বহীন পুরুষগুলোর পৌরুষ জাগবে। খুন-ধর্ষণ, অসাধুকর্মকা-, দুর্নীতি পৌরুষের প্রতীক নয়। পুরুষ কখনও নারীহীন ঘরে থাকে না। পুরুষের অপৌরুষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না থাকায় খুনী, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ, অসাধুপুরুষ ঘরে এসে আশ্রয় নেয়। আর সেই আশ্রয় দেবার অপরাধ থেকে নারী মুক্ত হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গৃহিণীর মন-মেজাজ-অহংকার বজায় রাখতে পুরুষকে দুর্নীতির প্রশ্রয় নিতে হয়। গৃহবিবাদের মূলেও নারী, তারও অনেক প্রমাণ আছে।
শিক্ষা-দীক্ষায় নারী এখন অনেক এগিয়ে। তাছাড়া নারী যে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি সহানুভূতিপ্রবণ এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ তা আর বলেতে হয় না। দেখা গেছে, একটা ছেলেকে নিয়ে পরিবার যত বিব্রত হয়, মেয়েকে নিয়ে কিন্তু ততটুকু নয়। মেয়েরা বুঝে মা-বাবার দুঃখ-কষ্ট। নারীজীবন মুখ্য তিন ভাগে বিভক্ত। কন্যা, জায়া ও জননী। তাই নারীশিক্ষা বলতে নারী জীবনের এই তিনটি অঙ্গকে সুন্দরভাবে বিকশিত করে তুলতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নারী জাতিকে আদর্শ জায়া ও জননীরূপে গড়ে তোলার কোন বিষয় নেই। তাদেরও সংসারের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জ্ঞান নেয়ার প্রয়োজন আছে। দেখা যায়, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব বিষয় আছে তা অধ্যয়ন করে শেষে চাকরি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অর্থার্জনের সুযোগ-সুবিধা নিতে চায় বর্তমান নারী। কিন্তু জীবনের পূর্ণতা যে শুধু অর্থ উপার্জনের মধ্যেই নয়, বিবাহের মধ্যে দিয়ে পরিসমাপ্তি হয় সেটা বুঝার চেষ্টা করে না কেউ কেউ। পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে অনেক নারীই অশান্তিকে বরণ করেন। এ দেশ থেকে যে পারিবারিক প্রথা এখনও লুপ্ত হয়ে যায়নি সে জ্ঞান তাদের থাকা দরকার। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক নারী, কিন্তু মানসিক ও শারীরিক বৃত্তিকে যেন সুন্দর পথেই পরিচালিত করে।
সমাজে পুরুষের যে অধিকার আছে, নারীরও সেই অধিকার আছে। বিবাহিত জীবনেও নারীর সমান অধিকার। কোনও নারী যদি সেইসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সেইসব অধিকার তার লাভ করতে হবে পুরুষের সাথে হাত মিলিয়ে তার নারীত্বের মহিমাকে জাগ্রত করে। নারী শিক্ষায় উন্নত হোক, নারীত্ব জাগুক। অধিকার আপনা থেকেই আসবে। অধিকার কেউ দেয় না, অধিকার অর্জন করতে হয়।
বিশ্বায়নের বাজার ধরে রাখতে নারীর দেহ-প্রদর্শন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারীর অশ্লীল ছবি বিতরণ, বিশ্ব সুন্দরীর খেতাব জয়ে নারী জাগরণ নারীকে স্বাধীন করে না, বরং পুরুষের ভোগ-লালসাকে বাড়িয়ে দেয়। সে কারণে বাংলাদেশী নারীই বুঝবে নারীর কর্তব্য কী। বিশ্বায়ন বলতে এই নয় যে, দেশের প্রাচীন কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে বিশ্বের বাজারে বিক্রি করে দিতে হবে। উন্নতি এই নয় যে, বিশ্বের বাজার থেকে নিজের দেশের উপযোগী নয় এমন আদর্শ টেনে আনতে হবে। শিক্ষার অর্থ এই নয় যে, ভোগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দিতে হবে। দেখা গেছে, উন্নত দেশে নারী-পুরুষ শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত হয়েছে, প্রচুর অর্থ রোজগার করতে পারছে, ভোগ-বিলাসে নিজকে ভাসিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারছে। কিন্তু সত্যি কী তারা সুখী? সুখ কুড়িয়ে আনতে গিয়ে কুড়ানো সুখ থেকে কেন উঠে আসছে কাড়ি কাড়ি হতাশা? উচ্ছৃঙ্খল স্বাধীনতা এবং বোধহীন শিক্ষা জীবনের প্রকৃত মমার্থ অনুধাবন করতে পারে না।
নারী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই প্রকৃত শিক্ষা ফলপ্রসূ হোক। সমপর্যায় আসবে। তবেই মনে হবে নারী ভোগের বস্তু নয়, নারী প্রতিটি পুরুষের ক্ষেত্রে তিন ভাগে বিভক্ত কন্যা-জায়া ও জননী রূপে সেই সৃষ্টি থেকেই। কন্যা-জায়া-জননী হলেই যে নারী গৃহবন্দি হয়ে পড়ে তা সত্য কথা নয়। সেই অধিকার খর্ব হওয়ারও কথা নয়। সেই অধিকার বলে যৌতুকের মতো সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করতে হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হতে হবে। কন্যা-জায়া-জননী জাগ্রত হলেই ঘটবে প্রকৃত নারী জাগরণ, আসবে সুখ-শান্তি।
সাংবাদিক-কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন