মীর আব্দুল আলীম : রাঙামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে সেনাবাহিনীর পাঁচজন সদস্যসহ দেড়শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এক হিসাবে দেখা গেছে। গত ১০ বছরে ৪০১ জনেরও বেশি মানুষ পাহাড় ধসে মারা গেছে। আহত হয়েছে সহ¯্রাধিক। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড় ধসের মূল কারণ হলো পাহাড় থেকে মাটি কাটা। পাহাড়গুলো ৩০ ডিগ্রির বেশি ঢালু হলে সে পাহাড়ের পাদদেশে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়। পার্বত্য জেলাগুলোয় রয়েছে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত অসংখ্য ঢালু পাহাড়। মাটির জমাট বাঁধা পাহাড় যখন কাটার মহোৎসব চলে তখন প্রবল বর্ষণ হলে মাটির ওপরের আবরণ না থাকায় যে প্রবল জলধারা নিচে ধাবিত হয় তার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ মাটি এসে পাহাড়ের পাদদেশে আছড়ে পড়ে। আর তখনই ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা।
২০০৭ সালে চট্টগ্রামে যখন পাহাড় ধসে ব্যাপক প্রাণহানি হয় তখন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে আলোকে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ২০০৭ সালে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর পাহাড়ের পাদদেশে গাইডওয়ালসহ শক্ত প্রটেকশন করার কথা থাকলেও নেয়া হয়নি কার্যত কোনো ব্যবস্থা। আর এসব কারণেই এ রকম মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় ভবিষ্যতে যাতে এ রকম ঘটনা আর না ঘটে। কিন্তু তদন্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তা কীভাবে রোধ করা যাবে? পাহাড়ের মাটি কেটে যারা পাহাড়টাকে বিপজ্জনক করে তুলল তারা কীভাবে সেটা করতে পারল তার জবাব কে দেবে? কারা পাহাড় কেটে পাহাড়কে মৃত্যুকূপে পরিণত করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। একই ঘটনা বারবার ঘটবে আর পাহাড়ে মানুষের লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এটা হতে পারে না। যারা সেখানে অনন্যোপায় হয়ে বসবাস করছে তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে। নইলে বিপজ্জনক পাহাড়ের পাদদেশে প্রটেকশন দেয়াল নির্মাণ করে নিরাপত্তা বলয় গড়ে দিতে হবে। দুর্ঘটনার পর ত্রাণের ঝুলি নিয়ে সরকার এগিয়ে আসবে, আমরা এটা দেখতে চাই না। সাধারণ বর্ষণেই যদি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে তাহলে ভয়াবহ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বড় কোনো ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটলে দেশের মধ্যে কী ধরনের অবস্থা হবে তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। আগের ঘটনা থেকে পাহাড়ের মানুষ শিক্ষা নেয়নি বলেই তাদের এ করুণ পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে।
গত কয়েক বছরে পার্বত্য জেলাগুলোয় পাহাড়ের নিচে বসতি বেড়েছে। এ নিয়ে আর শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। পাহাড়ের নিচের অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। তারা এখনো আছে বেশ বহাল তবিয়তে। যৎসামান্য তৎপরতা ছাড়া সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবারো উদাসীন। কানে তুলা দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমে বিভোর। তাই যা হওয়ার তাই হয়তো হবে, হচ্ছেও। দেশবাসীকে পাহাড় চাপাপড়া লাশ দেখতে হলো, হয়তো হবে আবারো। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? আসলে ঠেকানো যায়; কিন্তু ঠেকানো হয় না।
পাহাড় ধসের পর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞদের নানা বক্তব্য ও উদ্যোগ অবশ্যই লক্ষণীয়। বিশেষ করে সরকারের নানা উদ্যোগের পর সংশ্লিষ্ট অনেকেই আশ্বস্ত হয় এই ভেবে, ভবিষ্যতে এমন করুণ পরিণতি আর হবে না। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই সবই আগের মতো হয়ে যায়। একের পর এক পাহাড় চাপা পড়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা পাহাড় ব্যবস্থাপনায় আমাদের অক্ষমতাকেই প্রকাশ করছে। প্রতি বছর ভয়াবহ নিশ্চিত দুর্ঘটনায় এমন করুণ মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া যায় না। এর আগে একটি শক্তিশালী টিম গঠন করা হয়েছিল। এ টিম মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পাহাড়ি ভূমিধসের আশঙ্কার ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করবে। কিন্তু সে টিমের হদিস আছে কি? তবে এসব সুপারিশের অধিকাংশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ব্যর্থ হলেও পাহাড়ি ভূমিধসে চাপাপড়া লাশ উদ্ধার কিংবা লাশের মিছিলে ছুটে গিয়ে সরকারি দায়িত্বশীলদের অতিমাত্রায় লম্ফঝম্ফ ও প্রতিশ্রুতির কোনো অন্ত থাকে না। বিষয়টি এখন অনেকটা হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই এখন সময় এসেছে প্রতিশ্রুতি ও লম্ফঝম্ফ বন্ধ করে কিছু কাজ করে দেখানোর। দয়া করে নিরাপদে পাহাড়ি বস্তিবাসীদের জীবন রক্ষা করুন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করুন; এ ধরনের দায়িত্বহীনতার কারণে মৃত্যুর দায়-দায়িত্ব আপনাদের ওপরেই বর্তায়। আপনারা এসব জানমাল রক্ষায় আর দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেবেন না।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন