দেশের বিশিষ্ট লেখক, কলামিস্ট, কবি ও সমাজচিন্তক ফরহাদ মজহার গত সোমবার ভোরে নিজ বাসার সামনে থেকে অপহৃত হওয়ার ২০ ঘন্টা পর যশোরের অভয়নগর থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছেন। দলমত নির্বিশেষে পুরো জাতির জন্য এটি স্বস্তিদায়ক সংবাদ। পরিবারের পক্ষ থেকে ফরহাদ মজহার অপহৃত হওয়ার তথ্য প্রকাশের পর থেকে প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, অত:পর মূলধারার সব মিডিয়ায় তার অপহরণ সম্পর্কিত তথ্য বিশেষ গুরুত্বসহ প্রকাশিত হচ্ছিল। গত কয়েক দশকে দেশের বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ মহলে ফরহাদ মজহার স্বমহিমায় একটি বিশিষ্ট অবস্থান তৈরী করেছেন। পরিবেশ-প্রতিবেশসহ কৃষিব্যবস্থা নিয়ে মাল্টিন্যাশনাল এগ্রো-কেমিকেল কোম্পানীর ষড়যন্ত্র ও মুনাফাবাজি সম্পর্কে ফরহাদ মজহার একটি স্বতন্ত্র প্রতিবাদি প্লাটফর্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। প্রতিবেশী দেশের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও তার ভূমিকা আপসহীন। তিনি বরাবরই জনস্বার্থ বিরোধি ভ‚মিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার। এ কথা অস্বীকার করা যাবেনা যে, তাঁর সাম্প্রতিক লেখালেখি ও সাংগঠনিক তৎপরতা সরকারের পক্ষে ছিলনা। সোমবার ভোরে অপহৃত হওয়ার আগের দিনও ঢাকায় একটি ব্যতিক্রমী সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। সেই সম্মেলনটি ছিল ভারতে গো রক্ষা আন্দোলনের নামে সংখ্যালঘু মুসলমানদের পিটিয়ে মারা এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে। অনেকে মনে করেন সেদিনের সম্মেলনে বক্তৃতা দেয়ার কারণেই তিনি কোন বিশেষ চক্রের দ্বারা অপহৃত হয়ে থাকতে পারেন। তবে দেশের পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তাৎক্ষনিক নজরদারি ও প্রযুক্তিগত সক্রিয় তৎপরতার কারণে অবস্থান শনাক্ত করে তাঁকে দ্রæত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
ফরহাদ মজহারের লেখালেখি, সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কারণেই তার অপহরণের তথ্য প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই সর্বত্র ও সর্ব মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনায় তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং তাঁকে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহনের আহŸান জানায়। গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফরহাদ মজহারের সক্রিয় ও জনপ্রিয় অবস্থানের কারণে এবং সাম্প্রতিক কয়েক বছরে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বসহ অসংখ্য মানুষ গুম ও অপহরণের শিকার হওয়ার বাস্তবতায় তার অপহরণের সাথে সাথেই ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার পায়। অপহরণের ঘটনার পর দেশি-বিদেশি স্টেকহোল্ডারদের পক্ষ থেকে অভাবনীয় প্রতিক্রিয়ার কারণেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ উদ্যোগে ফরহাদ মজহার অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হলেও এখনো বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ দেশের বহু মানুষের হদিস পাওয়া যায়নি। অপহৃত হওয়ার কয়েক মাস পরে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিনকে ভারতে খুঁজে পাওয়া অথবা হুম্মাম কাদের বা ডাক্তার ইকবাল মাহমুদের ফিরে আসার মত এসব হতভাগ্যদের পরিবার তাদের অক্ষত ফিরে আসার ব্যাপারে এখনো আশায় বুক বেঁধে আছে। অপহরণের শিকার হওয়ার ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের সন্ধানের জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ ধরনের ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বেøইম গেম কাঙ্খিত নয়। ফরহাদ মজহার উদ্ধার হওয়ার পরও নানা ধরনের অপ্রাসঙ্গিক বির্তকসহ যুক্তিহীন ও অরুচিকর কথাবার্তা ও বিষয়ের অবতারনা করতে দেখা যাচ্ছে। এসব অনাকাঙ্খিত বিষয় এড়িয়ে প্রকৃত তথ্য উৎঘাটনই সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
প্রতিটি অপহরণের ঘটনার পরই নানা ধরনের অভিযোগ ও জল্পনার ডালপালা বিস্তৃত হতে দেখা যায়। এমনকি রাজনৈতিক পক্ষগুলোও পরস্পরের দিকে আঙুল তুলে বেøইম গেমে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে কোন ঘটনারই প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসেনি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এই ব্যর্থতার কারণেই গুজব ও জল্পনার ঢেউ সরকারের বিপক্ষে যায়। ফরহাদ মজহার উদ্ধার হওয়ার পরও অনেক অবান্তর প্রশ্ন তুলে খোদ অপহৃতকেই বিব্রত করার চেষ্টা করার প্রবণতা দেখা গেছে। কোন পক্ষের তরফেই এ ধরনের অমানবিক ও অরুচিকর ভ’মিকা কাঙ্খিত নয়। অপহৃত বা গুম হওয়ার পর অনেকেই আর ফিরে আসেননি। তাদের ফিরে না আসা এবং যারা ফিরে এসেছেন তারা কিভাবে কি কারণে অপহৃত হয়েছিলেন, কোথায় অবস্থান করছিলেন তদন্ত করে তা খুঁজে বের করা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সমূহের দায়িত্ব। বাহিনীগুলো এসব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। ফরহাদ মজহারকে ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। এ থেকে তাদের সক্ষমতার প্রমান পাওয়া যায়। এখন গুজব, জল্পনা ও রাজনৈতিক বেøইম গেম এড়িয়ে প্রকৃত দোষিদের খুজে বের করার মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ভ’মিকা রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার তার সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন