মীর আব্দুল আলীম : গত ৫ জুলাই দৈনিক ইনকিলাবের শেষের পাতায় ‘ভারত থেকে ফেন্সিডিল ঢুকছেই’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আরও দু’টি পত্রিকার শিরোনাম ছিল যথাক্রমে ‘ইয়াাবা আসা বন্ধে মিয়ানমার থেকে ইতিবাচক সাড়া পায়নি বাংলাদেশ’ এবং ‘মিয়ানমার চায় ইয়াবা দিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংস করতে’। এসব খবরের বর্ণনায় যাবার প্রয়োজন আছে কি? শিরোনামেই বোঝা যায়, কোথায় চলেছি আমরা। মিয়ানমার এবং ভারত সীমান্তে অসংখ্য ইয়াবা আর ফেন্সিডিলেরর কারখানা গড়ে উঠছে। এসব কারখানায় বাংলাদেশের যুবসমাজের জন্য মিয়ানমার মরণ নেশা ইয়াবা এবং ভারত থেকে ফেন্সিডিল উৎপাদন করে তা নির্বিঘেœ সরবরাহ করা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, এসব মাদক তৈরি হচ্ছে আমাদের জন্যই। বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারে অসংখ্য ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখানায় প্রতিদিন কোটি কোটি পিস ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। আর বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত তৈরি করেছে অসংখ্য ফেন্সিডিল তৈরির কারখানা। অবাক করা কথা, মিয়ানমার আর ভারতের মানুষ, সেখানকার যুবসমাজ খুব একটা ইয়াবা কিংবা ফেন্সিডিল আসক্ত নয়। মিয়ানমারে আর ভারতের কোনো কোনো এলাকায় তো ইয়াবা আর ফেন্সিডিল কি তা সেখানকার অধিবাসীরা জানেনই না। এজাতীয় নেশা দ্রব্য নিয়ে কেবল বাংলাদেশেই মাতামাতি। মূলত বাংলাদেশিদের জন্যই এ দুই দেশের সীমান্তে ফেন্সিডিল আর ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। যতদূর জানতে পারি, তাতে নাকি সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের মৌন সম্মতিও আছে। ভারত, মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা, ফেন্সিডিলের কারখানার কথা আমরা জানি, আমাদের সরকারও জানে, কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান রোধ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না?
মিয়ানমার আর প্রতিবেশী ভারত ইয়াবা আর ফেন্সিডিল তৈরি করে প্রতিদিন আমাদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে আমাদের যুবসমাজ এসবে আসক্ত হয়ে ধ্বংসে নিপতিত হচ্ছে। এতে আমাদের সরকারের সম্মতি আছে এ কথা বলার সুযোগ নেই, তবে কর্তাবাবুদের ম্যানেজ হয়ে যাবার কারণে মাদকপাচারকারীরা দেশকে মাদকে সয়লাব করে দিচ্ছে। মাদক তথা ইয়াবা ব্যবসা নির্বিঘেœ হচ্ছে তা বলছি না। মাদক কারবারীরা ধরাও পড়ছে মাঝেসাজে। আবার ছাড়াও পেয়ে যাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদেরও মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকা কথা বিভিন্ন মাধ্যমে খবর হয়। যারা মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে তারা কেবল চুনপুঁটি। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আমাদের দেশে মাদকের বাজার তৈরি করে নিয়েছে। এ জন্যই হয়তো দেশ মাদকে সয়লাব হচ্ছে। মাদক ব্যবসার সাথে দেশের অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। তাই ওদের টিকিটিও ছোঁয় না কেউ। তাই যা হবার তাই হচ্ছে দেশে। আমরা দেশবাসী দুর্ভাগা বলেই আমাদের যুবসমাজ সহজে মাদক হাতের নাগালে পাচ্ছে।
দেশ থেকে কেন মাদক নির্মূল হয় না? যাদের দায়িত্ব মাদক নিয়ন্ত্রণ করার কী করছেন তারা? মাদক পাচার, ব্যবসা ও ব্যবহারকারীর ক্রমপ্রসার রোধকল্পে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে নানারকম কার্যক্রম দেখা গেলেও তেমন কোনো ইতিবাচক ফল মিলছে না। মাদক শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের জন্যই অভিশাপ বয়ে আনে না, দেশ-জাতির জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে। নানারকম প্রাণঘাতী রোগব্যাধি বিস্তারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ করে তুলছে। এবার প্রত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মাদক ব্যবসার অত্যন্ত নিরাপদ স্থানগুলোর একটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারারক্ষীদের সতর্ক পাহারা থাকতেও যদি কারাগারে মাদক ঢুকতে পারে তাহলে সারা দেশের অবস্থা যে কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। দেশের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় মাদকদ্রব্য বিকিকিনির বিষয়টি এ দেশে বলতে গেলে ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযানে মাদকদ্রব্য আটক ও এর সঙ্গে জড়িতদের আটকের কথা শোনা গেলেও মাদক ব্যবসার নেপথ্যে থাকা ‘গডফাদার’দের আটক করা হয়েছে কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে এমন কথা শোনা যায় না। ফলে মাদকবিরোধী নানা অভিযান শুরু হলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো নতুন করে মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটে। মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে তরুণ সমাজ। দেশের তরুণ সমাজ মাদকের ভয়াবহ প্রভাবে বিপথগামী হচ্ছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। যা একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ।
মাদক সেবনের কুফল সম্পর্কে মহাসমারোহে আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। বিভিন্ন এনজিও মাদক সেবনে নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। মাদক পাচার, বহন ও ব্যবহারের বিভিন্ন শাস্তি রয়েছে। তবু মাদকের ব্যবহার কমেনি। ফেন্সিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, প্যাথেডিনের ব্যবসা রমরমা। নারী, পুরুষ উভয় শ্রেণীর মধ্যে মাদক সেবন প্রবণতা বাড়ছে। ঘুমের ওষুধ, হেরোইন, গাঁজা, এমনকি কুকুর মারার ইনজেকশন সেবন করছে মাদকসেবীরা। বিষ শরীরে ঢুকিয়ে নেশা করার মতো অভ্যাসও গড়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার।
বর্তমান সমাজ জীবনে মাদকের ব্যবহার সবাইকেই উদ্বিগ্ন করেছে। এর বিষাক্ত ছোবল অকালে কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী হচ্ছে বিপথগামী। ভারতে তৈরি ফেন্সিডিল সিরাপ আমাদের দেশে মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই সিরাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আফিম থেকে উদ্ভূত কোডিন, এই কারণেই ফেন্সিডিল সিরাপ সেবন করলে মাদকতা আসে। এলকোহল ব্যতীত অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানি-রফতানি, সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার আইনে নিষিদ্ধ। বিংশ শতাব্দীর নবম দশকে (১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল) বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাদকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় বিদেশ থেকে আসা মাদক সম্পর্কিত অপরাধের বিচার করা হতো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুসারে। সেখানে শুধু শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাপথে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য দেশে নিয়ে আসা বা নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধেই আসামির বিচার হতো। জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি সাধনকারী এই মাদকসংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য ওই আইন পর্যাপ্ত ছিল না। তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৯০ সালে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করা হয়। ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ১৯ পৌষ মোতাবেক ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি থেকে এ আইন কার্যকর হয়। কিন্তু এতদিনেও মাদকদ্রব্য ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়নি। বরং এর ব্যবহার এবং প্রসার বেড়েই চলেছে। অভিভাবকরা আজ চিন্তিত তাদের সন্তানদের মাদকাসক্তি নিয়ে। মাদকের হিংস্র ছোবল থেকে সারা জাতি চায় আত্মরক্ষা করতে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ হয়নি বলেই আজ মাদক নিয়ে এতো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, দেশে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হয়। মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। সরকার বলছে, ৫০ লাখ। কিন্তু বেসরকারি সূত্র মতে, ৭০ লাখেরও বেশি। এদের অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। মাদক গ্রহণকারীর ৮০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছর। বিশ্বের নেশাগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। এর ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয়েছে শহর হতে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। বিভিন্ন মাদকের মরণ নেশায় প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে ৮-১০ বছরের শিশু হতে শুরু করে নারী এমনকি বৃদ্ধরাও। ২০০২ সালে দেশে মাদক অপরাধীর সংখ্যা ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা ৪০ শতাংশের বেশি। এর ব্যবসা জমে ওঠেছে দেশে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওস নিয়ে গঠিত ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’, ভারত, নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ‘গোল্ডেন ওয়েজ’ এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলেছে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম মাদক উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের থাবার মধ্যে অবস্থান করছে। বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেন্সিডিলের কারখানা। সংঘবদ্ধ চক্র মিয়ানমার হতে কক্সবাজার দিয়ে সারাদেশে সুকৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইয়াবা। নতুন নেশা ইয়াবার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। বিশেষ করে স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েরা। ফেন্সিডিল, হেরোইন, ইয়াবার কোনটি দেশে উৎপাদিত না হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র। সামাজিক সমস্যা ছাপিয়ে এটি যেন গত দু’দশকে পারিবারিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রায়ই চোখে পড়ে মাদকের করাল গ্রাস থেকে ফেরাতে না পেরে পরিবারের শান্তি রক্ষায় বাবা-মা তার সন্তানকে, সন্তান বাবাকে পুলিশে সোপর্দ করছেন। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে পিতা-মাতা খুন-জখমের ঘটনা অহরহ ঘটতে শুরু করেছে। সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বাবা-মা ও সমাজের দৃষ্টি রাখা দরকার।
আমরা মনে করি, মাদক সংশ্লিষ্ট চুনোপুঁটি থেকে রাঘব-বোয়াল পর্যন্ত প্রত্যেকের ব্যাপারেই আইন প্রয়োগে কঠোরতা দেখাতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগই মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে সহায়ক হতে পারে। মাদক আমাদের সমাজকে কীভাবে ধ্বংস করছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্যা সমাজ ও রাষ্ট্রের। দেশের উদীয়মান শ্রেণী যদি সমাজ বৈশিষ্ট্যের বিরূপতার শিকার হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দেশকে রক্ষা করতে হলে সংশ্লিষ্টদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মাদকাসক্তি, যৌনাচার এবং পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে সুচিন্তিত ও সমন্বিত কর্মপন্থা গ্রহণ করা দরকার। একটি প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করা। এজন্য যে যার জায়গা থেকে মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। হুঙ্কার দিতে হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করার। আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র চাইলে দেশের মাদক প্রসারতা কমবে। আর রাষ্ট্র তা সহসাই করবে, এ প্রত্যাশাও রইল।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন