মুজিবুর রহমান মুজিব : ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই মতান্তরে ২ জুলাই নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সুবে বাংলার নবাবি এবং শাসনযন্ত্রকে নিষ্কণ্টক করাই ছিল নবাব হত্যার মূল কারণ। মীরজাফর পুত্র মীরন ঘাতক মোহাম্মদী বেগকে দিয়ে সিরাজুদ্দৌলাকে হত্যা করায়। পাষাণ মোহাম্মদী বেগ নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে ছুড়িকাঘাতের মাধ্যমে হত্যা করে। মানুষ নামের অমানুষ মোহাম্মদী বেগ সিরাজুদ্দৌলার পিতার আশ্রয়ে লালিত-পালিত ছিলেন। বালক সিরাজের কাছে বাল্যকালে সহোদরের সহমর্মিতা-মান-সম্মান ও মমতা পেয়েছিলেন। সেই মোহাম্মদী বেগ স্বার্থের বশবর্তী হয়ে সিরাজহত্যায় বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেনি।
নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশবাসীকে ভয়ভীতি এবং কোম্পানির কর্মকর্তা ক্লাইভ ও সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য নবাবের লাশকে খন্ডবিখন্ড করে হাতির পিঠে উঠিয়ে সমগ্র মুর্শিদাবাদ শহর প্রদক্ষিণ করা হয়। মুর্শিদাবাদের নিরীহ জনসাধারণ এই করুণ দৃশ্য দেখে নীরবে অশ্রুপাত করে। পরিপূর্ণ ধর্মীয় আনুষ্টানিকতা ছাড়াই সাধারণভাবে সিরাজুদ্দৌলাকে সমাহিত করা হয় খোশবাগের গোরস্থানে, দাদু নবাব আলীবর্দী খাঁর কবরের পাশে। করম আলী খান কর্তৃক ফার্সি ভাষায় রচিত তথ্যবহুল গ্রন্থ ‘মোজাফ্ফর নামার’ তথ্য মতে, মীর জাফর চক্র নবাবের মৃতদেহ বাজার চত্বরে ফেলে দিলে মির্জা জয়নুল আবেদীন বাকাওয়াল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেন।
নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় দৌহিত্র মির্জা মোহাম্মদ সিরাজুদ্দৗলা হায়বৎজং বাহাদুর নাম ধারণ করে বাংলার-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসন আরোহণ করেন। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হন তরুণ নবাব। দেশপ্রেম, বুদ্ধিমত্তা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা দিয়ে দেশি-বিদেশি সকল ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেন তিনি। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সিপাহশালার মীরজাফর আলী খান, জগৎ শেঠ, উর্মি চাঁদ, রায় দূর্লভদের বিশ^াসঘাতকতা, শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণের অনিবার্য পরিণতি ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পলাশীর যুদ্ধ।
নবাব সিরাজুদ্দৌলা ইংরেজদের কাছ আত্মসমর্পণ করেননি। বাংলা ও বাঙালির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোম্পানি ও ক্লাইভকে নিয়ে ঐক্যমতের সরকার গঠন করেননি। অধিক সৈন্য সংগ্রহ করে পুনরায় ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার মানসিকতা নিয়ে তিনি সপরিবারে পাটনায় পলায়নের পথে গ্রেফতার হন। ৩ জুলাই নবাবকে মোহাম্মদী বেগ ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করার পর নবাব পরিবার অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, অপমান, অবহেলা ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়। নবাব পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দী করে রাখে মীর জাফর চক্র।
নবাবের মৃত্যুর পর অন্তত ত্রিশ বছর জীবিত ছিলেন নবাব মহিয়ষী বেগম লুৎফুন্নেছা। বেঈমান মীরজাফরের বেআদব পুত্র মীরন ও তার সহযোগীগণ নবাব সিরাজের সহধর্মিনী বেগম লুৎফুন্নেছাকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখান, অসৌজন্যমূলক প্রস্তাব দেন; কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা ও প্রত্যাখ্যান করে পতিব্রতা লুৎফুন্নেছা স্বামীর কবর জিয়ারত, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, কবরের পরিচর্যা করে জীবন কাটিয়ে দেন নিজেদের ধনসম্পদ ফিরে পাওয়ার জন্য কোম্পানির সঙ্গে দেনদরবার করলেও তিনি কানা কড়িও ফিরে পাননি। সিরাজ-লুৎফার প্রিয় কন্যা উম্মে জহুরাকে শাদী দেন দীনহীনভাবে। পৃথিবীর অভিজাত ও বিত্তবান বিধবাদের মধ্যে একটি অনুকরণীয় আদর্শ, চিরস্মরণীয় ও পরম পূজনীয় হয়ে আছেন বেগম লুৎফুন্নেছা।
১৭৮৬ সালের ১০ নভেম্বর লুৎফুন্নেছা এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তার দুঃখিনী জীবনের অবসান ঘটান, আলিঙ্গন করেন মহান মৃত্যুকে। বেগম লুৎফুন্নেছাকে নবাব সিরাজুদ্দৌলার কবরের উপর শায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী তাকে তাঁর প্রিয় স্বামীর পায়ের কাছে সমাহিত করা হয়। খোশবাগের শাহী গোরস্থানে চির শয়ানে শায়িত আছেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা, তার প্রিয় বেগম লুৎফুন্নেছা।
সিরাজুদ্দৌলার সমাধি সৌধে এখনো প্রতিদিন শত শত মানুষ যায়, নবাবকে স্মরণ করে, শ্রদ্ধা জানায়, ফাতেহা পাঠ করে, রুহের মাগফিরাত কামনা করেন। আর মীর জাফর আলী খানের বাসস্থান নিমকহারামের দেউড়িতে মানুষ ক্ষোভ-ঘৃণা প্রকাশ করে। মীর জাফর আলী খান বেঈমান মীরজাফর হিসাবে কুখ্যাত। বাংলা ভাষায়, বিশ^াসঘাতকের আরেক নাম মীরজাফর।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, হাইকোর্ট এবং সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন