শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

কাশ্মীরের স্বাধীনতা অবশম্ভাবী

নিবন্ধ

| প্রকাশের সময় : ১৯ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সরদার সিরাজ : কাশ্মীরের স্বাধীনতা অবশম্ভাবী হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রতিদিনই সেখানকার ভূমি স্বাধীনতাকামী মানুষের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছে মানবতা। তাই বিশ্ব বিবেক পুনরায় জাগ্রত হয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের ভাগ্য নির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওআইসি নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য নয়াদিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। উপরন্তু সংস্থাটি কাশ্মীরের জনগণের ওপর চলমান নিপীড়নের নিন্দা জানিয়েছে। সর্বপরি কাশ্মীরে অব্যাহত হত্যাকান্ড ও রক্তপাত বন্ধে নির্ধারিত ভূমিকা পালনের জন্য জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে। গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান দ্ব›েদ্বর কেন্দ্রবিন্দু হলো কাশ্মীর ইস্যু এবং জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়নই হচ্ছে দক্ষিণএশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।
ইতোপূর্বে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ভারত সফর করেন। উক্ত সফরের আগে ভারতীয় এক টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘কাশ্মীরে এই রক্তপাত আমরা চলতে দিতে পারি না। চিরতরে এই সঙ্কটের সমাধানের জন্য আমরা বহুপাক্ষিক একটা সংলাপের সূচনা করতে পারি, তাতে তুরস্কও জড়িত হতে পারে। আর এতে ভারত, পাকিস্তান উভয়েরই লাভ হবে। আমার প্রিয় বন্ধু, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আমার অনেকদিন ধরেই কথাবার্তা হচ্ছে। আমি খুব ভালো করেই জানি, তার সদিচ্ছা আছে। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও চান এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হোক’।
কাশ্মীরের স্বাধীনতাপন্থীদের আন্দোলন ক্রমশই তীব্রতর হচ্ছে। একের পর এক হরতালে সবকিছু নীরব-নিথর হয়ে পড়ছে। কখনো কখনো তা সহিংসতার রূপ পরিগ্রহ করছে। তাতে ইভয় পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সেখানে ৫ লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করেও এবং তাদের ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েও কাশ্মীরীদের স্বাধীনতার কণ্ঠ স্তব্ধ করা যাচ্ছে না। বরং সবকিছুই স্বাধীনতাপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। এ কথা শুধু আমার নয়। খোদ দিল্লিস্থ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অশ্বিনী রায়ের। তিনি তুর্কী প্রেসিডেন্টের উক্ত আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কাশ্মীরে ভারত তো নিজেরাই দিনকে দিন তাদের অবস্থান হারাতে বসেছে’।
কাশ্মীর সঙ্কট নতুন নয়। সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু। তথা পাক-ভারত স্বাধীনতাত্তোর থেকেই। ভারত এবং পাকিস্তান যখন স্বাধীন হয়, তখন কাশ্মীর একটি স্বাধীন দেশ ছিল। ৯০% মুসিলম অধ্যুষিত দেশটির রাজা ছিলেন ডোগরা। তিনি ছিলেন হিন্দু। তাই তিনি ধর্মীয়আবেগের বশীভূত হয়ে ভারতে যোগদানের ঘোষণা দেন। সাথে সাথেই ভারত সামরিক অভিযান চালিয়ে কাশ্মীরের একটি অংশ তথা জম্মু কাশ্মীর দখল করে নেয়। আর অন্য অংশ পাকিস্তান দখল করে নেয়। যা আজাদ কাশ্মীর বলে খ্যাত। পাকিস্তান জম্মু কাশ্মীরও দখল করে নিতে উদ্যত হলে ভারত বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করে। এই অবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়েন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ভারত ও পাকিস্তান জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ‘কাশ্মীরী জনগণের গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে যে, কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে থাকবে, না পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে, না স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে’। কিন্তু পরবর্তীতে ভারত আর জাতিসংঘের উক্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি। বরং ১৯৫৭ সালে ঘোষণা করে যে, ‘কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’। কিন্তু কাশ্মীরী জনগণ তা মেনে নেয়নি। তারা স্বাধীনতার আন্দোলন অব্যাহত রাখে। তাতে ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হয়। তখন ভারত কাশ্মীরকে ‘অধিকতর স্বায়ত্বশাসন’ প্রদান করে। তবুও স্বাধীনতাপন্থীরা সন্তুষ্ট না হয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। কাশ্মীরীদের এক কথা- হয় স্বাধীনতা, না হয় শহীদ। পাকিস্তান তাতে নৈতিক সমর্থন জানায়। এনিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাভাব সৃষ্টি হয়। ফলে দু’দেশই পাল্লা দিয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। এমনকি পরমাণু বোমা পর্যন্ত তৈরি করে। যার সংখ্যা এখন শতাধিক এবং তা দুই দেশেরই। এমনকি দুইবার যুদ্ধ পর্যন্ত সংঘটিত হয়। উপরন্তু সব সময় সীমান্তে সংঘর্ষ লেগেই আছে। সর্বপরি দ্ইু দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে মদদ দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়টি সত্য কি-না তা বলা কঠিন। তবে, দুই দেশেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে দুই দেশেরই সামরিক ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এই দুই দেশেরই জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক দরিদ্র। সামরিক ব্যয়ের অর্থ যদি এই দারিদ্র বিমোচনে ব্যয় করা হতো; তাহলে, এতোদিনে তারা দারিদ্রমুক্ত হতে পারতো।
ভারত জাতিসংঘের কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি। অপরদিকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হলে তাদের ৯৬ হাজার সেনা আত্মসমর্পণ করে। পরবর্তীতে তাদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। পাকিস্তান তার বন্দী সেনাদের স্বদেশে ফেরত নেওয়ার জন্য ভারতের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করে যা সিমলা চুক্তি বলে খ্যাত। সেই চুক্তিতে কাশ্মীরের বিষয়টি ‘বহুপাক্ষিক’ এর স্থলে ‘দ্বি-পাক্ষিক’ বলে সংযুক্ত করা হয়। পাকিস্তান তখন পরাজিত শক্তি। তাই তাদের এটা মেনে নিতে হয়েছিল। এরপর থেকে ভারত দ্বিপাক্ষিক বিষয় বলে কাশ্মীরের স্বাধীনতা এড়িয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে কাশ্মীর স্বাধীনতার জন্য মরিয়া। এই অবস্থায় কাশ্মীরের স্বাধীনতার বিষয়টি পুনরায় আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর সংকটের সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
অবশ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণই যথেষ্ট নয়, তা বাস্তবায়নই মূলকথা। তাই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে এখনই। তাহলেই কাশ্মীরীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হবে। আর সেটা হলে ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, দাগেস্তান, উইঘুর ইত্যাদিরও স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। তারাও দীর্ঘদিন যাবত স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করছে। পরম করুণাময় কাশ্মীরের মজলুম মুসলিমদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করুন- এটাই কাম্য।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন