কে. এস সিদ্দিকী : পশ্চিমা অমুসলিম লেখকদের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষীদের সংখ্যাই অধিক। তারা বিশেষভাবে ইসলামের মহানবী (স.)কে সাধারণত বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে অভ্যস্ত। তবে তাদের মধ্যে কিছু কিছু সত্যনিষ্ঠ নিরপেক্ষ লেখকও রয়েছেন, যাদের পক্ষপাত দোষে দুষ্টু বলা যায় না। এখানে আমরা উদাহরণ স্বরূপ একটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করতে চাই যাতে একই ঘটনায় দুইটি দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। আর সেটি হচ্ছে রাসুলুল্লা হ (স.)-এর বিপদসংকুল তায়েফ সফর সম্পর্কিত। এ সফরে তায়েফবাসী রাসুলুল্লা হ (স.)-এর ওপর কী নিষ্ঠুর, নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল তা বর্ণনা করার পূর্বে এ সম্পর্কে দুইজন বিখ্যাত পশ্চিমা লেখকের একই ঘটনায় দুইটি ভিন্ন মতের কথা উল্লেখ করতে চাই। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মার্গিয়ুলুম এবং অপর জন হচ্ছেন স্যার উইলিয়াম মিয়ুর। মার্গিয়ুলুম তায়েফ সফর সম্পর্কে তার বিদ্বেষাত্মক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তিনি রাসুলুল্লা হ (স.)-এর এ সফরকে ‘অশুভ চেষ্টা’(নাউজুবিল্লাহ) বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘তায়েফ মক্কার খুব নিকটবর্তী স্থান এবং মক্কাবাসীদের অধীনে ছিল এবং সেখানে মক্কার নেতৃস্থানীয় লোকদের বাগান ছিল। যার কারণে তাদের আসা যাওয়া ছিল। সুতরাং যখন মক্কার সর্দারগণ হজরত (স.)-এর বিরুদ্ধে ছিল, তখন তায়েফের লোকদের কাছে কী আশা করা যেতে পারে?’ তার দৃষ্টিতে এ অবস্থা বা পরিস্থিতিতে রাসুলুল্লা হ (স.)-এর তায়েফ সফর ছিল সুয়ে বা অপকৌশল। মার্গিয়ুলুসের এ ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির অসারতার বলিষ্ঠ প্রমাণ রয়েছে তারই স্বজাতীয় লেখক স্যার উলিয়ম মিয়ুরের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে। তিনি লিখেছেন, মোহাম্মদ (স.)-এর জোরালো আত্ম-বিশ্বাস ও আস্থা ছিল যে, সমস্ত ব্যর্থতা সত্তে¡ও তিনি একাকী একটি বিরোধী শহরে গমন করেন এবং ইসলামের তাবলীগ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন।
পশ্চিমা লেখকরা মহানবী (স.)-এর প্রায় কাজ ও পদক্ষেপকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত। এমনকি তার পবিত্র সিরাতকেও বিতর্কিত করার সুযোগের সন্ধানে থাকে। তবে স্যার উলিয়াম মিয়ুরের ন্যায় আরো কিছু পশ্চিমা নিরপেক্ষ সত্যাশ্রয়ী লেখক রয়েছেন যারা বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর চারিত্রক বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করতে দ্বিধান্বিত হননি।
মক্কী জীবনে রাসুলুল্লা হ (স.)-এর প্রতি মক্কার কোরেশরা নিষ্ঠুর, অমানুষিক নির্যাতন করেছিল। এমনকি তার প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রে পর্যন্ত তারা লিপ্ত হয়েছিল। সিরাতগ্রন্থগুলো তার বড় স্বাক্ষী। হজরত রাসূল করিম (স.) এর প্রাণপ্রিয় চাচা মহাত্মা আবু তালেবের প্রভাব প্রতিপত্তির ফলে এবং রাসুলুল্লা হ (স.)-এর প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন ও তার নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণের ফলে কাফেররা প্রকাশ্যে দুঃসাহস করতে না পারলেও তাদের গোপন ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। মহাত্মা আবু তালেব ও হজরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.) প্রায় কাছাকাছি সময়ে ইন্তেকাল করেন। রাসুলুল্লা হ (স.) এ বছরকে আমুল হুজন বা শোকের বছর ঘোষণা করেন। এ দুই ব্যক্তিত্বের ইন্তেকালের ফলে রাসুলুল্লা হ (স.) অসহায় হয়ে পড়েন। অপরদিকে মক্কার কোরেশ কাফেরদের আনন্দের সীমা থাকে না। তারা রাসুলুল্লা হ (স.)-এর প্রতি অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় যার বিশদ বিবরণ দিতে গেলে বিরাট পরিসর প্রয়োজন।
মক্কার কাফের কোরেশদের অত্যাচার-নির্যাতন যখন চরম আকার ধারণ করে এবং তাদের নিকট তাবলীগ প্রচার অসম্ভব হয়ে পড়ে, এমনকি রাসুলুল্লা হ (স.)-এর প্রাণের নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন তখন তিনি নিরাশ হয়ে পড়েন এবং তায়েফে গমন করে ইসলাম প্রচারের ইচ্ছা পোষণ করেন। মক্কার কোরেশদের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম গোত্র বনি সাকীফ তায়েফে বসবাস করতো। রাসুলুল্লা হ (স.) ভাবলেন, হয়তো তারা আল্লাহর দিকে রুজু হবে এবং ইসলামের প্রতি সমর্থন জানাবে। তায়েফে তখন বড় বড় আমির ওমারা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের নিবাস ছিল। তাদের মধ্যে উমাইর এর বংশ ছিল গোত্রীয় প্রধান। এরা তিন ভাই ছিল প্রসিদ্ধ। এদের নাম আব্দে ইয়ালীল, মাসউদ এবং হাবীব। এদের পিতা উল্লেখিত উমাইর এর পূর্ণ নাম আমর ইবনে উমাইর ইবনে আওফ। রাসুলুল্লাহ (স.) দশম নবুওয়াত বর্ষের ২৬ কিংবা ২৭ শাওয়াল জায়দ ইবনে হারেসাকে সঙ্গে করে বর্ণিত তিন ভ্রাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান। কিন্তু তারা তা কবুল করেনি এবং অত্যন্ত অবজ্ঞার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করা ছাড়াও খুবই দুর্ব্যবহার করে। এ বদবখতরা এতেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তায়েফের বাজারগুলোকেও উসকে দেয়, যাতে তারা হাসি-ঠাট্টা, উপহাস, টিটকারী ইত্যাদি অসদাচারণ করে। ঐ তিন ভ্রাতা তাদের গোলাম ও বাদিদের রাসুলুল্লাহ (স.) এর পেছনে লাগিয়ে দেয়; তারা রাসুলুল্লাহ (স.) পেছন থেকে শোরগোল ও চিল্লাতে থাকে। শহরের দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা চতুর্দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলে। দুষ্টু লোকদের সমাবেশ দুইদিকে কাতার বন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং রাসুলুল্লাহ (স.) যখন রাস্তা অতিক্রম করতেন, তখন তার পবিত্র পদ লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করতে থাকে, তাতে তার জুতো পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে যায়। যখন তিনি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বসে যেতেন, তখন পাষÐেরা তার বাহু ধরে দাঁড় করিয়ে দিতো, তিনি চলতে আরম্ভ করলে আবার পাথর নিক্ষেপ করতো এবং অশ্রাব্য গালিগালাজ করতো এবং হাতে তালি বাজাতো।
অবশেষে তিনি কোরেশের দুই ভ্রাতা উতবা ও শায়বার বাসস্থানে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তখন দুষ্টু লোকদের সমাবেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাগানের মালিক ছিল উতবা ইবনে রাবীআ। তিনি কোফর অবস্থায় থাকলেও অত্যন্ত শরীফ ও নেক ছিলেন। তিনি রাসুলুল্লাহ (স.)কে করুণ অবস্থায় দেখে আদ্দাস নামক তার গোলামকে আঙ্গুরের কিছু গুচ্ছ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট পাঠান। আদ্দাস ছিল খ্রিস্টান, সে মোসেলের নিকটবর্তী নিনোয়ার অধিবাসী ছিল। সে মুসলমান হয়ে যায় এবং হুজুর (স.)-এর মস্তক মোবারক ও হস্ত মোবারক চুম্বন করে। উতবা জিজ্ঞাসা করে, তুমি কেন এমন আচরণ করলে? আদ্দাস বলল, বর্তমান দুনিয়ায় তার চেয়ে উত্তম কোনো লোক নেই, তোমরা তার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অবগত নও, তিনি আল্লাহর নবী। তায়েফ সফরের প্রথম পর্ব এভাবেই শেষ হয়। তায়েফবাসীরা তিন ভ্রাতার নেতৃত্বে-উসকানিতে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সাথে যে চরম গোস্তাখি ও বেআদবি করে, তার শাস্তি তারা নিশ্চয় ভোগ করেছে।
সিরাত গ্রন্থগুলোতে তাঁর তায়েফ সফর হতে আঙ্গুর বাগান পর্যন্ত অবস্থান করার করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তন কালে রাসুলুল্লাহ (স.) নাখলা নামক স্থানে অবস্থান করেন। রাতের অন্ধকারে তিনি যখন নামাজ আদায় করছিলেন তখন নাছীবাইন এর সাত জ্বিন তার খেদমতে উপস্থিত হয়ে মুসলমান হয়ে যায় এবং তারা নিজেদের কওমে গিয়ে ইসলাম প্রচার করে, যার বর্ণনা কোরআনে সূরা জ্বিন এ রয়েছে। নাখলায় রাসুলুল্লাহ (স.) কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন বলে একটি বর্ণনা রয়েছে। অতঃপর হেরা নামক স্থানে আসেন এবং সেখানে মোতয়েম ইবনে আদীর নিকট পয়গাম পাঠান যে, আমাকে তোমার সমর্থনে রাখতে পারবে কি? আরবের প্রথা ছিল এই যে, কেউ যদি সমর্থন প্রার্থী হতো, শত্রæ হলেও তা অস্বীকার করতে পারতো না। মোতয়েম রাসুলুল্লাহ (স.)-এর আবেদন গ্রহণ করেন এবং তার পুত্রদেরকে ডেকে বলে দেন, ‘তোমরা অস্ত্র ধারণ করে হেরেমে যাও।’
রাসুলুল্লাহ (স.) মক্কায় আগমন করেন, মোতয়েম উটে আরোহণ করে সঙ্গে ছিলেন। হেরমের নিকট আসার পর তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘আমি মোহাম্মদ (স.)কে আশ্রয় দিয়েছি’। রাসুলুল্লাহ (স.) হেরমে আগমন করেন। অতঃপর তিনি নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। মোতয়েম ও তার পুত্ররা তাকে তরবারির ছায়াতলে গৃহে পৌঁছে দেন। উল্লেখ্য, মোতয়েম বদর যুদ্ধের পূর্বে কোফর অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন বলে বর্ণিত হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর তায়েফ সফরের ঘটনাটি মক্কী জীবনের এবং ২৬ কিংবা ২৭ শাওয়াল তারিখের। তায়েফের কাফের খান্দান আব্দে ইয়ালীল যে কুফরি আচরণ মহানবী (স.)-এর সাথে করেছে, তার নজির বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। পক্ষান্তরে একই সফরে আব্দে ইয়ালীলদের লেলিয়ে দেয়া পশুদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের এক পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ (স.) যখন উতবার বাগানে আশ্রয় নেন, সে উতবাও ছিল কাফের, সে আঙ্গুর গুচ্ছ প্রেরণ করে রাসুলুল্লাহ (স.)কে সাহায্য করেছিল এবং মোতয়েম ইবনে আদীও ছিল কাফের, সে রাসুলুল্লাহ (স.)কে আশ্রয় দিয়ে তাকে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত নিজে এবং তার পুত্ররা যে সাহায্য করেছিল তার তুলনাও বিরল।
তায়েফ সফরের এক পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ (স.) একদিন অত্যন্ত বিচলিত অবস্থায় দো’আ করেন। আল্লাহ তা’আলা মালিকুল জিবলিক পর্বত মালায় ফেরেশতাকে প্রেরণ করেন। ফেরেশতা রাসুলুল্লাহ (স.)কে বলেন, আপনি নির্দেশ করুন, আমি মক্কার দুটি পাহাড় আখশবাইনকে এখনই পরস্পর আঘাত করে চুর্মার করে দেবো, যাতে সকল কাফের নাস্তানাবুদ হয়ে যাবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, না, আমি এরূপ বলব না, হতে পারে তাদের বংশে এমন তাওহীদবাদী জন্ম নেবে, যারা আল্লাহর এবাদত করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন