এম. আবদুল্লাহ : সেলুকাস ছিলেন একজন গ্রিক বীর যোদ্ধা, আলেকজান্ডারের সেনাপতি। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সফল শাসক। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানে প্রধান সেনাপতি হিসেবে তার অবস্থান ইতিহাসে পাওয়া যায়। সিন্ধু উপত্যকা দিয়েই তাঁরা ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। ইরান-আফগানিস্তান এলাকা পার হয়ে ভারতে এলে এখানকার মানুষের গঠন, চালচলন, কৃষ্টি, সভ্যতা ইত্যাদির ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য দেখে অবাক ও বিস্মিত হয়ে আলেকজান্ডার সেলুকাসকে উদ্দেশ্য করে গ্রিক ভাষায় যা বলেছিলেন তা হুবহু জানা যায়নি। তবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তার একটি লেখায় আলেকজান্ডারের ওই মুহূর্তটির অনুভূতি সম্পর্কে লিখেছেন, সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ! সেই থেকে বাংলা ভাষায় এই বাক্যটির প্রচলন।
আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশও সত্যিই বিচিত্র। এখানে হরহামেশা এমন সব ঘটনা ঘটে যা শুধু বৈচিত্র্যপূর্ণই নয়, কখনো উপভোগ্য আবার কখনো বিস্ময়জাগানিয়া। এখানে কে কখন খলনায়ক থেকে মহানায়ক বনে যাবেন তার কোন পূর্বাভাস মেলে না। যখন তখন যে কেউ ভিলেন থেকে হিরো হয়ে যান, আরেকজন হিরো থেকে পতিত হন ভিলেনে। ফুলের মালার পরিবর্তে যেমন পঁচা ডিম কপালে জোটে, তেমনি অভিযুক্ত-নিন্দিত আসামি নাটকীয়ভাবে হয়ে উঠতে পারেন নন্দিত নায়ক। এই সময়ে তেমনই একজন নায়কের নাম গাজী তারিক সালমান। সরকারের উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তা বা ইউএনও। বলা যায়, ভাগ্যের জোরে এখন তিনি সত্যিকারের ‘গাজী’।
ঘটনা এরই মধ্যে সবারই জানা। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় এক ক্ষুদে শিক্ষার্থীর আঁকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্রে ছেপে তিনি এখন রীতিমত মহানায়ক। বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে ফেঁসে গিয়েছিলেন মামলায়। জেলও খেটেছেন ঘণ্টা দুয়েক। পুলিশ টেনে নিয়ে ঢুকিয়েছিল গারদে। তার পর দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে বদলাতে শুরু করে। খোদ প্রধানমন্ত্রী তাঁর পাশে দাঁড়ান। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তাঁর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাল্টা অ্যাকশনে মামলার বাদী দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। ৬ পুলিশ ক্লোজড। ডিসিও বেকায়দায়। এলজিআরডি মন্ত্রী হুঙ্কার দিয়েছেন ইউএনও হেনস্থার শেষ দেখে ছাড়বেন। জামিন নাকচকারী বিচারক এখন কৈফিয়ত দিতে গলদঘর্ম।
পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণে তারিক সালমানকে ভাগ্যের বরপুত্র বলতে হয় এ কারণে যে, ক্ষমতাসীন দলের এমপিসহ জেলা পর্যায়ের সব প্রভাবশালী এমনকি জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের কোপানলে পড়েও মাত্র দু’ঘণ্টা জেল খেটে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁর জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে এবং অতি দ্রæততার সঙ্গে তার ফল তিনি পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে পুরষ্কৃত করা উচিৎ বলে মন্তব্য করেছেন।
গাজী তারিক ভাগ্যবান এ জন্যও যে, দেশের তাবৎ মিডিয়া তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তাঁকে হয়রানির নেপথ্য কারণ উদঘাটনে ব্যস্ত মূলধারার সব মিডিয়া। তিনি যে কত সৎ, কত সাহসী, পেশাগত জীবনে তিনি কী কী ভালো কাজ করেছেন এমনকি তাঁর গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায় তিনি কেমন ছিলেন তাও সরেজমিন তুলে এনে মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। যারা বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করেন না কিংবা সরকার ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদেরকেও দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারিক সালমানের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিতে। এমন ভাগ্য ক’জনের হয়?
এটা বোঝার জন্য সম্ভবত খুব বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার নেই যে, ইউএনও তারেক সালমান আমন্ত্রণ পত্রে কাঁচা হাতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি কেন ছেপেছিলেন। আর তাকে ‘হেনস্থা’ করতে প্রশাসনিক ও দলীয় যেসব কর্তা ভূমিকা রেখেছেন তারা কেন সে ভূমিকা রেখেছেন তাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। শেষোক্তরা হয়তো ভেবেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ছবি ছাপার অপরাধে’ সালমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলেই বরং তাদের কপালে শনির দশা নেমে আসবে। কিন্তু বিধি বাম। ঘটেছে তার উল্টো।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিরোধী মত দমন ও হয়রানির উদ্দেশ্যে মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলার হিড়িক পড়েছে। বিশেষ করে সরকার অপছন্দ করে এমন কিছু বললে বা প্রকাশ করলে সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের ডজন ডজন মামলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যদিও একই মানহানিকর অভিযোগে একাধিক মামলা হওয়ার আইনত সুযোগ নেই, এমনকি যার মানহানি হয়েছে তিনি নিজে বাদী হওয়া বাধ্যতামূলক। হাল আমলে এসবের থোড়াই তোয়াক্কা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ দলীয় অনেক আইনজীবী ও নেতা নিজেদের নাম ফাটানো বা আলোচনায় আসার জন্যও যখন-তখন মামলা ঠুকে দিচ্ছেন। পাবলিসিটি ক্রেজ এ ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে উঠছে।
বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিকে অসম্মান ও তাদের সম্পর্কে কটুক্তির অভিযোগে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে, সাংবাদিক, পেশাজীবী এমনকি পাড়া গাঁয়ের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কত মামলায় হেনস্থা হচ্ছেন তার ইয়ত্তা নেই। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ৮৪ মামলার আসামি। তন্মধ্যে মানহানি মামলার সংখ্যা সারাদেশে ত্রিশের অধিক। একটি রিপোর্টের জেরে এ অধমও তাঁর সঙ্গে ২৬ মামলায় বিবাদী। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের মামলা সংখ্যা সম্ভত ৬৯। মূলধারার এমন কোনো পত্রিকা নেই যার সম্পাদক-সাংবাদিককে মানহানি মামলায় কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে না। এসব মামলার অধিকাংশের বাদী সরকারি দলের নেতা-কর্মী।
তারিক সালমান অহেতুক হয়রানির মুখে পড়ায় তার পাশে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুরো সরকার। আপাতঃ দৃষ্টিতে এটা সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু সব কিছুতে কমবেশি পাশর্^প্রতিক্রিয়া থাকে। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে প্রায়ই বলা হয় যে, ‘আইন সবার জন্য সমান। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’। এখন কেউ যদি প্রশ্ন তুলেন যে, ইউএনও গাজী তারিক সালমানের ক্ষেত্রে আইন নিজস্ব গতিতে চললো না কেন? এ আপ্তবাক্য কি শুধু প্রতিপক্ষের জন্য?
আসলে দেশটা যেমন বিচিত্র ততোধিক বিচিত্র এ দেশের শাসকদের অনুভূতির রঙ। এক ইউএনও’র দুই ঘণ্টার জেল নিয়ে যতটা আহা-উহু করে পাল্টা অ্যাকশন চলছে তার ছিটেফোটাও কি অন্য ক্ষেত্রে দেখা যায়? দেশের সন্মানিত কত নাগরিককেই না তুচ্ছ কারণে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হচ্ছে হরহামেশা। অন্যায়-অবিচার আর জুলুম-নির্যাতনে যাদের পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় দেখা যায় তারা যখন ক্ষেত্রবিশেষে অতিবিপ্লরী হন তখন সাধারণ মানুষ ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। সব অনিয়ম-অনাচারে প্রতিক্রিয়ার পারদ সমানভাবে ঊর্ধ্বমুখি হয় না কেন সে প্রশ্ন ওঠে জোরেশোরে? এই যে শাহবাগে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার ন্যায্য দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালনের সময় পুলিশ বিনা উসকানিতে একেবারে কাছে থেকে টিয়ার শেল ছুঁড়ে এক ছাত্রের দু’চোখ চিরতরে নষ্ট করে দিল, আবার ১২০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টার বানোয়াট মামলা ঠুকে প্রহসনের আশ্রয় নিল তা ক্ষমতাবানদের বিবেক ও অনুভূতিকে কতটা নাড়া দিতে পেরেছে? তারিক সালমানের হাতধরা পুলিশদের সাজা দেয়া গেলেও তিতুমিরের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমানের পৃথিবীটাকে চিরতরে যারা অন্ধকার করে দিল তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না কেন?
লেখক : সাংবাদিক ও মহাসচিব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন