শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

অবহেলা ও অবমূল্যায়নের শিকার জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম

| প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবদুল গফুর : এখন বাংলা সনের হিসাবে শ্রাবণ মাস চলছে। এর দুই মাস আগে জ্যৈষ্ঠ মাসের ১১ তারিখে ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী। আসছে মাস ভাদ্রের ১২ তারিখে কবি এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেছেন কয়েক বছর আগে। যদিও জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে আমাদের সারা বছর ধরেই স্মরণ করার কথা, তবুও দেশের সরকার ও অন্যরা জাতীয় কবিকে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবস বছরের মাত্র এই দুই দিনে স্মরণ করে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও এই দুর্ভাগ্যকেই আমাদের বাস্তবতার নিরিখে মেনে নিতে হচ্ছে।
জাতির জন্য শুধু এটাই দুর্ভাগ্য নয় যে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সারা বছর ধরে স্মরণ করার পরিবর্তে শুধু তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিবসে স্মরণ করা হয়ে থাকে। কবি যে কারণে জাতীয় কবি, নজরুল-স্মরণের অধিকাংশ অনুষ্ঠানে কবিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে তাঁর জাতীয় কবি হওয়ার প্রমাণ খুব কমই থাকে। একজন কবির রচিত কবিতা বা গানের অনুষঙ্গ অনেক কিছুই থাকতে পারে। এ অনুষঙ্গ হতে পারে প্রেম, মানবতা বোধ, অন্যায়-অসাম্য-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ¯্রষ্টার প্রতি প্রেম, সা¤্রাজ্যবাদের পদলেহন, সা¤্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরোধিতা, জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়া, সর্বপ্রকার শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতিকে জাগিয়ে তোলার সংকল্প ইত্যাদি। বাংলা কবিতা ও গানের পাঠকরা একটু সচেতন হলেই বুঝে নিতে পারেন নজরুলের সৃষ্টি-সম্ভার এসবের কোন্ পর্যায়ে পড়ে।
বাংলা সাহিত্যের দুই শ্রেষ্ঠ কবির একজন রবীন্দ্রনাথ আরেক জন নজরুল ইসলাম। দু’জনেরই জন্ম ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬১ সালে, মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪১ সালে। পক্ষান্তরে নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালে। তিনি দৈহিকভাবে ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করলেও ১৯৪২ সালে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার কারণে ঐ বছরই তাঁর কবি-জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে। এ কারণে তাঁর কবি-জীবনের ব্যাপ্তি সীমাবদ্ধ ছিল মাত্র দুই-আড়াই দশকের মধ্যে। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর কবি-জীবন সীমাবদ্ধ থাকা সত্তে¡ও বাংলা সাহিত্যে তিনি ভাব, ভাষা ও ছন্দ-বৈচিত্রে এমন এক ব্যতিক্রমী বিপ্লবী ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন, যার গুরুত্ব তাঁর শত্রæ-মিত্র কেউই অস্বীকার করতে পারেননি।
আগেই বলেছি, বাংলা সাহিত্যের দুই শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম উভয়ের জন্ম ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে। পরাধীন ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেও ব্রিটিশ শাসকদের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে যেখানে রবীন্দ্রনাথ ‘নাইট’ উপাধি লাভ করেন, সেখানে পরাধীনতার বিরুদ্ধে লেখালেখির অপরাধে নজরুলকে ব্রিটিশ সরকারের কারাগারে বন্দী জীবন কাটাতে হয় একাধিক মেয়াদে। জাতির স্বাধীনতা-সংগ্রামে কবির স্বীৃতি দিতে বাংলার মুক্তিকামী জনগণ অবদানের স্বীকৃতি দিতে কখনও ভোলেননি। রবীন্দ্রনাথের কবি খ্যাতি যখন মধ্য গগনে, তখন ১৯২৯ সালে সেকালের বাংলার হিন্দু-মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে কলকাতার অ্যালবার্র্ট হলে কবিকে জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করেন। এই অনুষ্ঠানের যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, এস ওয়াজেদ আলী, উদীয়মান বিপ্লবী নেতা সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু বলেন, আমরা যখন রাজপথে থাকব, তখন নজরুলের লেখা আমাদের প্রেরণা যোগাবে। আবার আমরা যখন কারাগারে যাব সেখানেও নজরুলের গান গাওয়া হবে।
নজরুল ইসলাম মূলত কবি হলেও রাজনীতি সম্বন্ধে তিনি অসম্ভব সচেতন ছিলেন। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হলে ঐ প্রস্তাবের মর্মানুসারে উপমহাদেশের মুসলিম-অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠায় অনাগত সে রাষ্ট্রের ভাষী নাগরিকদের ছোট বয়স থেকেই উপযুক্ত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সেকালের বাঙালি মুসলমানদের প্রধান মুখপত্র দৈনিক আজাদ-এ ছুটে গিয়েছিলেন ছোটদের জন্য ‘মুকুলের মাহফিল’ নামের একটি পাতা খোলার প্রস্তাব নিয়ে। এ পাতার পরিচালকের নামও তিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন ‘বাগবান’। এসব তথ্য আমরা জানতে পাই ঐ মুকুলের মাহফিল পাতার প্রথম পরিচালক বিখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে।
এসব তথ্য প্রমাণ করে কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবিই ছিলেন না, জাতির ইতিহাসের একজন সচেতন পর্যবেক্ষকও ছিলেন তিনি। তাই বলা যায় লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে, তার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আর যেহেতু নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ নামের আজকের স্বাধীন রাষ্ট্রটির স্বপ্নদ্রষ্টা ও জাতীয় কবি, তাই তাঁকে স্মরণ করা উচিত তাঁর এ মহান মর্যাদার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে। শুধু আনুষ্ঠানিকতার দায়ে যান্ত্রিকভাবে নয়।
কাজী নজরুল ইসলামের উল্লেখিত মহান মর্যাদার স্বরূপ কি? প্রকৃত বিচারে নজরুল ইসলাম আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জনক। নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হবার কারণে লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে অংশ নিতে সমর্থ না হলেও ঐ রোগে আক্রান্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত তিনিই ছিলেন বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর মূল পথিকৃৎ। তাই তাঁকে অবজ্ঞা করে বা বাদ দিয়ে সেদিনের বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক জাগৃতির ইতিহাস রচনার কথা কল্পনা করা শুধু অন্যায়ই নয়, অসম্ভবও বটে। এ কারণেই বাঙালি মুসলিম সাংস্কৃতিক জাগরণের ইতিহাসে নজরুলের অবদান নিয়ে আলোচনা আমাদের আজকের স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের ইতিহাসের সাংস্কৃতিক ভিত্তি জানার স্বার্থেই অপরিহার্য।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কবে শুরু হয় এ প্রশ্নের জবাবে কেউ কেউ হয়তো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের অভিশপ্ত রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর আগ্রাসী কর্মকাÐের জবাব দিতে ২৬ মার্চ থেকে যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তার কথা বলবেন। কেউ আবার সম্ভবত ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট এ সংগ্রাম শুরু হয় বলে তাঁর অভিমত দেবেন। সে ক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় ১৩ আগস্ট পর্যন্ত এ দেশ স্বাধীন ছিল, যার চাইতে বড় অসত্য আর কিছু হতে পারে না। আসলে আমাদের স্বাধীনতা ফিরে পাবার সংগ্রাম শুরু হয় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে বহিরাগত ইংরেজদের কাছে আমাদের স্বাধীনতা হারানোর পর থেকেই। স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার এ সংগ্রামের প্রথম একশ’ বছর এ সংগ্রাম পরিচালিত হয় সশস্ত্র পথে। পরে এ সংগ্রাম পরিচালিত হয় নিয়মতান্ত্রিক পথে। এ সংগ্রামের প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যখন সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের অবসানে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ছিল আমাদের একটি অস্বাভাবিক অর্জন। কারণ দেড় হাজার মাইলের বৈরী জনপদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন দু’টি পৃথক ভূখÐ নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই বললেই চলে। তাই সমস্যা শুরু হয় প্রায় প্রথম থেকেই। প্রথমে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে, পরে লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার প্রশ্নে। সমস্যা চরম আকার ধারণ করে ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের অভিশপ্ত রাতে, যখন পাঞ্জাবী-প্রভাবিত পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে মেজরিটি অর্জনকারী দলের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দেয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের বিরুদ্ধেই আগ্রাসন শুরু করে দেয়। ফলে জনগণ বাধ্য হয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে নয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
এ তো গেল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা। যে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে যেমন রাজনৈতিক ভূমিকা থাকতে হয়, তেমনি থাকতে হয় সাংস্কৃতিক ভূমিকা। সে প্রসঙ্গেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম আসে অপরিহার্যভাবে। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন-প্রচেষ্টার চূড়ান্ত ফসল। এ প্রস্তাবের আংশিক বাস্তবায়ন হয় ১৯৪৭ সালে, যখন ১৯০ বছরের ব্রিটিশ পরাধীনতার অবসানে অবিভক্ত ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান নামের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর লাহোর প্রস্তাবের মর্মানুসারে ১৯৭১ সালে জন্মলাভ করে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ নামের এ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা টের পেয়েছিলেন লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরপরই এবং এ রাষ্ট্রের ভাবী নাগরিকদের ছোট বয়স থেকেই উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দৈনিক আজাদ-এ ছুটে গিয়েছিলেন ছোটদের জন্য মুকুলের মাহফিল নামের একটি বিশেষ পাতা খোলার প্রস্তাব নিয়ে, এ কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। তাই নজরুল ইসলাম ছিলেন আজকের বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটির স্বপ্নদ্রষ্টা।
শুধু স্বপ্নদ্রষ্টা নয়, নজরুল ছিলেন আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জনকও বটে। যেমন করে, এবার সে কথাই বলছি। উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে কোনো দিন ইসলামের আগমনের ফলে যদি এক বিশাল মুসলিম জনপদ গড়ে না উঠত, তা হলেও কি ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা আদৌ সম্ভবপর হতো? হতো না। তাহলে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটির আদর্শিক তথা সাংস্কৃতিক ভিত্তি যে ইসলাম, এ কথা অস্বীকার করা আর বাস্তবতাকে অস্বীকার করা একই কথা।
বাংলাদেশের এই আদর্শিক তথা সাংস্কৃতিক ভিত্তি নির্মাণে যে কবির ঐতিহাসিক অবদান ছিল, তিনিই কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন সে যুগটা ছিল এ দেশের জনগণের জন্য পরাধীনতার যুগ, যার শুরু হয়েছিল ১৭৫৭ সালে পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে। ১৭৫৭ সালে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে আসা ইংরেজদের হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় বরণের মাধ্যমে নেমে আসা সে পরাধীনতাকে উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ মেনে নিলেও মুসলমানরা তা একদিনের জন্যও মেনে নিতে পারেননি। তারা পলাশী বিপর্যয়ের পর একশ’ বছর ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান স্বাধীনতা ফিরে পাবার লক্ষ্যে।
পলাশী-পরবর্তী মুসলিম নেতৃবৃন্দ যে লক্ষ্যে তাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যান, নজরুল ইসলাম সেই একই লক্ষ্যে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে তাঁর কলমযুদ্ধ চালিয়ে যান সারা জীবন। অসংখ্য উদ্দীপনাময়ী কবিতা ও গান রচনার মাধ্যমে এবং দেশের সর্বত্র অসংখ্য জনসভায় জ্বালাময়ী ভাষণের মাধ্যমে তিনি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন।
ইংরেজ শাসনে পর্যুদস্ত মুসলিম জনগণকে জাগিয়ে তুলতে তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন ইসলামের স্বর্ণযুগের কথা:
আবু বকর উসমান উমর আলী হায়দর
দাঁড়ি যে এতরণীর, নাই ওরে নাই ডর।
কাÐারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা
দাঁড়ি মুখে সারিগান-লাশরীক আল্লাহ।
বিদেশী শাসনে জর্জরিত কৃষক সমাজকে জাগিয়ে তুলতে নজরুল বলেন :
ওঠরে চাষি জগদ্বাসী ধর কষে লাঙ্গল।
আমরা মরতে আছিÑ ভাল করেই মরব এবার চল \
আজ জাগরে কৃষান, সব তো গেছে, কিসের বা আর ভয়
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়।
ঐ বিশ্বজয়ী দস্যুরাজার হয়-কে করব নয়,
ওরে দেখবে এবার সভ্যজগৎ চাষার কত বল \
নজরুলের বহু কবিতা ও গান সেদিনের পটভূমিতে রচিত হলেও শাসনব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন না হওয়াতে আজও সমান প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। এমনি একটি গান:
কারার ঐ লৌহ-কবাট
ভেঙ্গে ফেল, কররে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল-পুজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান।
বাজা তোর প্রলয় নিশান।
ধ্বংস নিশান
উড়–ক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি!
এছাড়া দিকভ্রান্ত মুসলমানদের জন্য রয়েছে :
তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ, ক্ষমা করো হজরত।
ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ তোমার দেখানো পথ।
ক্ষমা করো হজরত \
বিলাস বিভব দলিয়াছ পায়ে ধূলি-সম তুমি প্রভু,
আমরা হইব বাদশা নওয়াব তুমি চাহনাই কভু \
এই ধরণীর ধন-সম্ভার,
সকলের তাতে সম-অধিকার,
তুমি বলেছিলে ধরণীতে সবে সমান পুত্রবৎ\
ক্ষমা করো হজরত \
দুনিয়াতে এখন মুসলমানেরা সংখ্যার নিরিখে বিশাল। কিন্তু এ সত্তে¡ও মুসলমানদের মতো অসহায় জনগোষ্ঠী খুব কমই দেখা যায়। এর কারণ কবি খুঁজে পেয়েছেন আল্লাহতে পূর্ব সমর্পিত মুসলমান না থাকার মধ্যে।
তাই কবি গেয়েছেন :
আল্লাহতে যাঁর পূর্ণ ঈমান, কোথা সে মুসলমান।
কোথা সে আরিফ অভেদ যাহার জীবন মৃত্যু জ্ঞান \
যাঁর মুখে শুনি তওহিদের কালাম
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম;
যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জ্বীন-পরী-ইনসান \
স্ত্রী-পুত্রের আল্লাহের সঁপি জেহাদে যে নির্ভীক
হেসে কোরবানি দিত প্রাণ, হায় \ আজ তারা মাগে ভিখ।
কোথা সে শিক্ষা- আল্লাহ ছাড়া
ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা,
আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে লয়ে কোরআন \
কবি স্বজাতির দুর্গতির কারণই শুধু দেখাননি। কোণ পথে সে দুর্গতির অবসান হতে পারে, তা বাতলে দিতেও ভুলে যাননি তিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজকের কথাকথিত নজরুল সাধকদের অনেকেই নজরুলের সেসব জাতি-জাগনিয়া দিকনির্দেশনামূলক কবিতা ও গান সম্পর্কে পারতপক্ষে আলোচনাই করেন না ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
নূরুল্লাহ ১৩ এপ্রিল, ২০২০, ৯:৪১ এএম says : 0
বাঙালি মুসলমানের প্রধান কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে দারুণ লিখছেন জাযাকুমুল্লাহ
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন