শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

বিরল

প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্বাধীন পারভেজ
আমাকে আজ কোর্ট চত্বরে এক উকিলের দরবারে হাজির হতে হয়েছে। কোনদিন ভাবিনি আমাকে মামলা মোকদ্দমায় জড়াতে হবে। অবশ্য মানুষের ভাবনামতো কয়টা ঘটনাই বা ঘটে? মানুষের ভাবনার দৌড়ই বা কতোদূর?। আমার তো এখন মনে হয় দুনিয়ার বেশিরভাগ ঘটনাই অভাবিত। তা না হলে আপন ভাই আমার সাথে এমন শত্রুতা করতে পারলো! এতো কষ্ট করে লাগানো কলাগাছগুলো গরু ছেড়ে দিয়ে খাইয়ে দিলো, পুকুরের পানিতে বিষ মিশিয়ে দিয়ে দেড় লাখ টাকার মাছ মেরে ফেললো। আজ আব্বা বেঁচে থাকলে ঠিকই বুঝতে পারতেন যে, বড় পুকুরটা আমার একার নামে লিখে দিয়ে তিনি মোটেও ভুল করেননি। তার মেজ ছেলে একটা আস্ত বেয়াদব। বড় ভাইয়ের সাথে যে এমন শত্রুতা করে তাকে তো সম্পত্তির ভাগই দেয়া উচিৎ হয়নি।
উকিলের ঘরে প্রায় আধঘণ্টা ধরে বসে আছি, এখনো তার পাত্তা নেই।
আরও আধঘণ্টা পর ঘরে ঢুকেই আমাকে বসে থাকতে দেখে উকিল একটা মেকি হাসি দিলেন। তারপর আমাকে একটু অপেক্ষা করার অনুরোধ করে তার সঙ্গে আসা দুই মক্কেলকে নিয়ে টেবিলে বসলেন। একজন বছর পঁয়ত্রিশের যুবক আরেকজন বৃদ্ধ। বয়স আন্দাজ ষাট বছর হতে পারে। উকিল এবং বৃদ্ধ দুজনই যুবককে বোঝাতে হাত পা এবং মুখ সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। বৃদ্ধের মুখে উত্তেজনা এবং গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ। তবে যুবক বেশ হাসি মুখেই বিপরিত পক্ষের দুজনকে সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে আমার কানে এলো যুবকটি দুইবার ‘আমার বোন’ শব্দটি উচ্চারণ করলো। এতে আমার একটু কৌতূহল হলো, ভাবলাম এও কি আমার মতোই সহদোরের অত্যাচারে কোর্ট অবধি আসতে হয়েছে? আহা বেচারা!
আমি এগিয়ে গিয়ে তাদের পেছনের বেঞ্চিতে বসি। আচমকা আমাকে কাছে ঘেসতে দেখে বৃদ্ধ খেঁকিয়ে ওঠেন- তুমি কে?
উকিল সাহেব আমার পরিচয় দেন। বৃদ্ধ যেন এবার আমারও সহযোগিতা পেতে চান। আমাকে দলে টানার ভঙ্গিতে দরদ মেখে বলতে থাকেন- দেখোনা বাবা, আমার এই গর্ধব মেয়ে জামাইকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। এর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। তা না হলে আধবয়সী বিধবা বড় বোনকে কি কেউ নিজের বসত ভিটেয় এনে বসাতে যায়?। দুই মাস হলো না স্বামী মারা গেছে, কোথায় শোকে পাথর হয়ে থাকবে তা নয় সে আসছে বাপের বাড়ির সম্পত্তির দখল নিতে?
-আব্বা, আমার বোন সম্পত্তির দখল নিতে আসতে চায়নি। আমিই তাকে নিয়ে এসেছি।
যুবকের প্রতিবাদে বৃদ্ধ খেঁকিয়ে উঠে বলে- আরে এই জন্যই তো বলেছি তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তা না হলে এমন পাগলামি  কেউ করে? আর তোমার বোনেরই বা কেমন আক্কেল শুনি? ছোট ভাই একটা ভুল করে বসলো আর সেও সেই ভুলের সুযোগ নিয়ে ছোটভাইয়ের ঘাড়ে চেপে বসলো!।
-সে কোথায় আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে? বাপের জমিতে তো তারও ভাগ আছে। সে তার নিজের জমিতে থাকবে, নিজের ফসল খাবে। তাতে আমার কি অসুবিধা আছে?।
-ধুত্তর তোর ভাগের গুষ্টি!
বৃদ্ধ মেজাজ হারিয়ে দুম করে টেবিলে থাবা মেরে বসেন।
এ পর্যায়ে উকিল সাহেব স্বভাবসিদ্ধ কৌশলী ভাষায় বলতে শুরু করেন- দেখো বাবা, বুঝতে পারছি তুমি অনেক ভালো মনের মানুষ। সহজ সরল চিন্তা ভাবনা তোমার। কিন্তু দুনিয়াটা অনেক কঠিন জায়গারে বাপ। তুমি যদিও তোমার ছোট ছোট ভাগনে ভাগনীদের মুখের দিকে তাকিয়ে বোনকে সাহায্য করার জন্য খোলা দিলে হাত বাড়ায়ে দিছো, কিন্তু হয়তো একদিন দেখবা ওই ভাগনে ভাগনিরাই তোমার গলার কাটা হয়ে দাঁড়াবে। তোমার এই সহযোগিতার কথা তারা হয়তো মনেও রাখবে না।
যুবক এবার বোধহয় খানিকটা রেগে যায়। উকিলের দিকে বেশ কড়া নজরে তাকিয়ে বলতে থাকে- আচ্ছা, আমি আমার বোনকে কিভাবে সাহায্য করলাম বলুন তো? আমি শুধু তার সম্পত্তিটুকু তাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। এতে সহযোগিতার কি দেখলেন? তাকে তো আর আমি আমার নিজের জমি দিতে যাইনি।
বৃদ্ধ একটা আঞ্চলিক খিস্তি করে ওঠেন। উকিল তাকে সামলে নিয়ে যুবককে বাগে আনতে অন্য পথ ধরেন। আগের তুলনায় আরো নরম ও আদুরে ভঙ্গিতে বলতে থাকেন- তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু বাবাজি, তোমাকে তো আরো কিছু ব্যাপার বোঝা লাগবে। শোন, সে তো আর তোমার ভাই না যে কড়ায় গ-ায় তাকে হিসাব বুঝিয়ে দিতে হবে। মেয়েমানুষ, সারাজীবন তোমাদের কাছ থেকে খরচ খরচা খসিয়ে গেছে। জীবনে তো চার আনা পয়সা তোমাকে বা বাপ মাকে দিতে পারেনি। তার ভাগের হিসাব কি আর বেটা ছেলের মতো অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে করলে হবে? তুমি বরং তাকে লাখ খানেক টাকা দিয়ে দাও। তাতেই তার বেশ উপকার হবে। খামাখা বাড়ির উপর ঝামেলা টেনে আনার কি দরকার বলো?
উকিলের যুক্তি শুনে যুবক হেসে ওঠে। বৃদ্ধ তাতে খুশি হন নাকি ভিরমি খান কে জানে?
যুবক কিন্তু বেশ মিষ্টি করেই উকিলকে জবাব দেন- দেখেন, কাকু, আমিও আমার বাপের ছেলে আর আমার বোনও আমার বাপের মেয়ে। আমাদের মোট সম্পদ প্রায় দশ বিঘা। আমিতো এমনিতেই প্রায় সাত বিঘা পাবো। তাহলে তার বাপের মাত্র যে তিন বিঘা জমি সে পাচ্ছে সেইদিকে কুদৃষ্টি দেয়াটা কি আমার মানুষের মতো কাজ করা হবে, বলেন? ছেলে হয়েছি তো কি হয়েছে? বাপ মা বোনের পিছনে কয়টাকা খরচ করেছি আমি? বোনের চেয়ে যে সাড়েতিন বিঘা জমি বেশি পাচ্ছি তার সমপরিমাণ টাকা কি খরচ হয়েছে আমার? দশ ভাগের এক ভাগও না।
উকিল ক্ষান্ত হলে বৃদ্ধ আবার তিড়িং বিড়িং শুরু করেন। হাত পা ছুড়ে নানা ভঙ্গিতে বলতে থাকেন-  এ উল্লুকের সাথে কথা বলে লাভ নেই, উকিল সাব। এ নিজে তো বুঝবেই না, উল্টা আপনাকেই ছাইপাশ বুঝিয়ে ছাড়বে। লজ্জার কথা আপনাকে কি বলবো? আমার নিজের মেয়েরও তো মাথা খেয়েছে সে। এর সাথে থাকতে থাকতে মেয়েটারও বুদ্ধি শুদ্ধি গোল্লায় গেছে। আমাকে বলে কিনা ননদ আর ননদের ছেলে মেয়ে নিয়ে তার সংসার আরো সুখের হবে। কি আর বলবো আমি, সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। এই আর কি!।
নিজের বৌয়ের প্রসঙ্গ চলে আসায় যুবক যেন খানিকটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। পরিতৃপ্ত একটা হাসি মুখজুড়ে ফুটিয়ে তুলে বলেন- আব্বা, ওই তো আমার আসল সম্পদ। ওর মন মানসিকতা যদি আপনার মতো হতো তাহলে আর আমার সংসারে এতো সুখ শান্তি থাকতো না। যেই সুখ শুধু আমাদেরকেই না, আমাদের আশপাশের মানুষদেরও শান্তি দিতে পারে!
যুবকের এই সুখবোধ বিশ্লেষণে আমরা সবাই কেমন যেন চুপসে যাই। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তিনি বৃদ্ধকে আরেকটা ধাক্কা মারেন- আব্বা আপনি কি চান আপনার মেয়েজামাই নাতি নাতকুর হারাম খাওয়ার অপরাধে দোযখের আগুনে জ্বলুক? তাদের নামাজ রোজা বাজেয়াপ্ত হোক? চান না তো?। তাহলে আর ফেরাউনের মতো আচরণ কইরেন না। কেয়ামতের মাঠে আপনারা সবাই আমার কথার সত্যতা যাচাই করে নিয়েন।
যুবক টুক করে বেরিয়ে পড়ে। ঘোর কেটে গেলে বৃদ্ধও গালাগালি করতে করতে উধাও হয়ে যান। তবে যাওয়ার আগে উকিলের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে যেতে ভুল করেননি। সেই টাকার উত্তাপেই কিনা জানি না, উকিলের মুখে হাসি হাসি ভাব ফুটে ওঠে। বিগলিত কণ্ঠে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন- তা ভাই সাহেব কি পারিবারিক আদালতেই মামলা করবেন নাকি ফৌজদারী? কাল মোবাইলে কি যেন বলেছিলেন ঠিক বুঝতে পারিনি। আরেকবার খুলে বলবেন ব্যাপারখানা?
আমি উদাস ভঙ্গিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। উকিল সাহেবের দ্বিতীয় ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়া আছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত কচলাতে কচলাতে বললাম- না, তেমন কিছ ুনা। একটা বড় পুকুর সমান চারভাগে ভাগ করতে চাইছিলাম। আমাদের চারভাইয়ের মধ্যে। করা যাবে না?। কী কী কাগজপত্র লাগবে একটু বলে দেন তো উকিল সাহেব?
আমার মুখে অপ্রত্যাশিত কথা শুনে উকিল হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন। আমি চোখ মোছার জন্য রুমাল বের করতে পকেট হাতড়াতে থাকি....।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন