শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

যেখানে জবাবদিহিতা নেই

নি ব ন্ধ

| প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

তৈমূর আলম খন্দকার  : ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ এ কণ্ঠস্বর জাতি শুনেছিল আজ থেকে ৪৬ বছর পূর্বে; জাতির এক ক্রান্তিকালে। সেই থেকেই জাতির সাথে জিয়ার সখ্য। তিনি The Second Proclamiation (Fifteen Amendment) order 1978 এর মাধ্যমে সংবিধানে ‘বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেছেন, তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা। তিনি কিসিঞ্জারের ভাষায় তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে তিনি নিহত হওয়ার পরও এ জাতি তাকে মনে রেখেছে এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও জিয়া নামের আতঙ্ক তাদের কাটেনি, তাই দেশব্যাপী রাতারাতি জিয়ার নামে নামকরণকৃত সকল প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা, স্মৃতি, ম্যুরেল, বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তন করে দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর নারায়নগঞ্জে রাতের অন্ধকারে শহীদ জিয়া হলের সাইনবোর্ড অপসারণ করে নাম রাখা হয় ‘শহিদ মুক্তিযোদ্ধা হল’। এতে জাতির শ্রদ্ধাভাজন ও সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা হয়নি, বরং করা হয়েছে বিতর্কিত। কারণ জিয়া নিজেও ছিলেন সম্মুখ যুদ্ধের সমরনায়ক, যে কারণে তৎসময়ের আওয়ামী সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। কিন্তু অতি উৎসাহী আমলা ও রাজনৈতিক নেতা সরকারপ্রধানের দৃষ্টিতে আসার জন্য এমন কিছু কর্ম করে নিজেরাই নিজেদের বিতর্কিত করছে। জনগণের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন জেলা প্রশাসন জিয়া হলের নাম পুনঃ স্থাপন করতে বাধ্য হয়। ২০১১ সালে পুনরায় শহীদ জিয়ার ম্যুরোলে কালো কালি লেপন করা হয়েছিল। তখনো জনতার দাবির মুখে ম্যুরোলটি পরিষ্কার করতে প্রশাসন বাধ্য হয়েছিল।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হওয়ার পর শহীদ জিয়া হলের নামকরণের বিরুদ্ধে শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। এখন জেলা প্রশাসক জিয়া হলের নামের পরিবর্তে ‘টাউন লেখা’ শুরু করেছে। উল্লেখ্য, নারায়নগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের পূর্বপার্শে¦ একটি বড় পুকুর ভরাট করে ৫৯ শতাংশ জায়গার উপর আজকের শহীদ জিয়া হলটি নির্মিত। সি.এস রেকর্ড জরিপে উক্ত সম্পত্তির মালিক ছিল ব্রজেন্দ্র রায় চৌধুরী ও দেবেন্দ্র রায় চৌধুরী এবং তাদের ওয়ারিশ সন্তোষ কুমার রায় চৌধুরী গং। তাদের থেকে ১৯৬৩ সালের ২ ফেব্রæয়ারি ৩২১৯ রেজিষ্ট্রীকৃত দলিল মূলে মং ১৫ হাজার টাকা মূল্যে উক্ত সম্পত্তি একটি মিলনায়তন করার জন্য তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এস.এ. সাত্তারের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ ক্রয় করে। টাউন হল তথা একটি অডিটরিয়াম নির্মাণের উদ্দেশ্যে শহরের তৎকালীন মুরব্বীদের ইচ্ছা আকাক্সক্ষা পূরণের স্বার্থে মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে নগদ মূল্যে উক্ত জমি ক্রয় করা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়া নারায়ণগঞ্জে সফরে এলে দলমত নির্বিশেষে শহরের তৎকালীন মুরব্বীদের দাবির মুখে শহর ও শহরতলীর উন্নয়নের জন্য ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারকে চেয়ারম্যান করে ‘নারায়ণগঞ্জ শহর উন্নয়ন কমিটি’ গঠন করে প্রাথমিকভাবে জিয়াউর রহমান এক কোটি টাকা অনুদান প্রদান করেন। উক্ত কমিটি সংক্ষেপে এন.টি.ডি.সি নামে পরিচিতি ছিল। অডিটরিয়ামটির নির্মাণের অর্থের মূল যোগানদাতা ছিল এন.টি.ডিসি। ইতোমধ্যে জিয়াউর রহমান শাহাদত বরণ করেন। এন.টি.ডি.সি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বীকৃতি স্বরূপ সর্বসম্মতিক্রমে অডিটরিয়ামটি ‘শহীদ জিয়া হল’ নামকরণ করে। সেই থেকেই জিয়া হল নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার জিয়া হল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাতের অন্ধকারে শহীদ জিয়া হলের সাইনবোর্ড পরিবর্তন করা হয়, যা আইনানুগভাবে কোনো বৈধতা পায়নি। শহীদ জিয়া হলটির ব্যবস্থাপনা জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি দ্বারা পরিচালিত।
২০০৪ সালে সংশ্লিষ্ট কমিটি জিয়া হলের নামে নামজারির উদ্যোগ নিলে দেখা যায়, উক্ত সম্পত্তি ভেষ্টেড এন্ড নন-রেসিডেন্ট প্রোর্পাটি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকার পক্ষে তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমা ম্যানেজমেন্ট কমিটি’র পক্ষে লিপিবদ্ধ থাকায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বাধীন জিয়া হল পরিচালনা পরিষদ সরকারের বিরুদ্ধে যুগ্ম জেলা জজ ১ম আদালত, নারায়নগঞ্জ দে. নং- ১৪৬/২০০৫ মোকদ্দমা দায়ের করলে সরকারের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নারায়ণগঞ্জ উক্ত মোকদ্দমায় কনটেস্ট করে। ১ম যুগ্ম জেলা জজ মো. আবু মোহসিন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ইং প্রদত্ত রায়ে উক্ত সম্পত্তি জিয়া হলের অনুক‚লে প্রদান করলে সরকার উক্ত সম্পত্তি জিয়া হলের নামে নামজারি করে। আইনশুদ্ধভাবে জিয়া হলের নিজস্ব ভ‚মিতেই জিয়া হল প্রতিষ্ঠিত।
নারায়ণগঞ্জ প্রায় ৪৫০ বছরের পুরাতন একটি জনপদ। শিল্প, সাহিত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, ক্রীড়া প্রভৃতিতে নারায়ণগঞ্জের উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রয়েছে। অথচ শহরে দুটি মাত্র মিলনায়তন। একটি সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত মিলনায়তন যা ‘আলী আহাম্মদ চুনকা পৌর পাঠাগার ও মিলনায়তন’ নামে পরিচিত, কিন্তু নির্মাণধীন থাকায় বিগত ৮ বছর যাবৎ নারায়ণগঞ্জবাসী এর সুবিধা ভোগ থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে শহীদ জিয়া হল শুধুমাত্র জিয়ার নামে হওয়ায় জেলা প্রশাসন এটাকে পরিত্যাক্ত রেখেছে। হলটি ব্যবহারের অনুপযোগী করে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে হলের সামনের জায়গাটুকু ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারি অনুষ্ঠান করার জন্য, তাও করা হচ্ছে টাউন হল নামে। এ ধরনের হীনমন্যতা থেকে জাতি কবে রক্ষা পাবে তা শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারবে।
যে জাতি তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান দিতে জানে না, সে জাতিকে অবশ্যই ভবিষ্যত প্রজন্মের নিকট জবাবদিহি করতে হবে। সময়ের সন্ধিক্ষণে আল্লাহর রহমতে কোনো কোনো মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে। সে শ্রেষ্ঠত্বকে হিংসা করা সভ্যতার পরিপন্থী। অতি উৎসাহীদের দ্বারা অনেক কাজই হয় যা জনগণ স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করে না, বরং বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যেমন গত ২১ জুলাই অতি উৎসাহীদের দায়ের করা রং চড়ানো একটি মামলায় বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার গাজী তারেক সালমানকে গ্রেফতার করা হয়; যা জনগণের সমর্থন পায়নি, বরং বুমেরাং হয়েছে।
দেশে এখন জবাবদিহিতা নেই বলেই সরকারি ঘরানার লোকেরা মনে করে তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, যার জন্য কারো নিকট জবাবদিহিতার প্রয়োজন নেই। সরকারি ঘরানার লোক হলেই তারা যা কিছু করতে পারে এটাই তাদের বদ্ধমূল ধারণা। সিলেটে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে ২০০ কোটি টাকার অনিয়ম পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি গোয়ালবাজার আদর্শ মহিলা কলেজের বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে। সরকারি-বেসরকারি দেশের সকল ঠিকাদারীর ব্যবসা একচেটিয়াভাবে করে যাচ্ছে সরকারি ঘরানার লোকেরা, তাই তাদের পক্ষে এগুলি করা সম্ভব হচ্ছে। তাদের কোনো অপরাধ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী/কর্মকর্তাদের চোখে পড়ে না। দেশের আইন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দ্বিমুখী নীতির কারণেই আজ দেশে নীতিবহির্ভূত কর্মকান্ড অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন