মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : সকল ধর্মই নারীর প্রতি যে কোন ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে। নারী যেন কোন সহিংসতার শিকার না হয় তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ধর্মসমূহ বিভিন্ন বিধান দিয়েছে, বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অথচ কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মের নামে নারী নির্যাতিত হয়, সহিংসতার শিকার হয়। এর মূলে রয়েছে পুরুষের নারীকে বশীভূত রাখার অসুস্থ মানসিকতা এবং কখনো কখনো ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার। বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র নারী নানাভাবে সহিংসতার শিকার। খুন, গুম, অপহরণ, উত্যক্তকরণ, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, বৈষম্য, ধর্ষণ প্রভৃতি নারীদের জীবনযাত্রা বিভীষিকাপূর্ণ করে তুলেছে। নারীদের ক্ষেত্রে যদি ইসলাম প্রদত্ত নির্দেশনা ও আইনগুলো সবাই মেনে চলতো তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা এমন প্রকট আকার ধারণ করতো না। বিভিন্ন ধর্মে নারীদের অবস্থা ও অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। ধর্মীয়ভাবে তাদের প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতনের যে কোন সুযোগ নেই। আর ধর্মীয় আইনসমূহ যে একান্তই নারীর প্রতি সংবেদশীল তা বিশদ ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।
কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর যখন অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হুমকি বা বল প্রয়োগ করে তাকে নির্যাতন বলে। নারী নির্যাতন বলতে তাই যে কোনো বয়সের যে কোনো সম্পর্কের নারীকে নিগ্রহ, অত্যাচার ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা বুঝায়। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Molestation/persecution of a woman æBengali-Crudelty to Women. তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রণীত সকল সংবিধান, দেশে-বিদেশে নারী মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় সকল গোষ্ঠী ও আন্দোলনে নারী নির্যাতন বুঝাতে সাধারণভাবে Violence-Against Women পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে।
সাধারণভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে পুরুষ কর্তৃক নারীদেরকে কোনো না কোনো প্রকারে কষ্ট দেয়াকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে নারীদের উপর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতনকে বুঝায়। নারীর যে কোনো অধিকার খর্ব বা হরণ করা এবং কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বিষয় চাপিয়ে দেয়া বা কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠীর ইচ্ছানুসারে কাজ করতে বাধ্য করাও নারী নির্যাতনের অন্তর্গত। সার্বজনীন নারী অধিকারের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘনমূলক অপরাধ নারী নির্যাতন। ধারণাগতভাবে এটি আবার নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন এবং নারীর সাথে অপব্যবহার ইত্যাদিও বুঝায়। এটি সমাজে মহিলাদের প্রতি অমানবিক ও অনৈতিক আচরণের মধ্যেও প্রকাশ পায়। এর একটি সহজ সংজ্ঞা হলো, ... all forms of cruelty and repression on women of all ages.
এভাবে বলা যায়, These forms of violence frequently occur in private in the home and police and other criminal justice agencies have been reluctant to define such violence as criminal or to respond to such family matter. বানচের মতে, নারী নির্যাতন-তা যে ধরনেরই হোক না কোনো কোনো বিক্ষিপ্ত বিষয় নয় এবং যৌনতা সম্পর্কিতও নয়। এই নির্যাতনের একটা সুনির্দিষ্ট সামাজিক উদ্দেশ্য আছে এবং তা হচ্ছে নারীর জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে জাতিসংঘ ১৯৭৫ সাল থেকে বিশ্ব জুড়ে কাজ করে চলেছে। প্রতিবছর এ বিষয়ের উপর আলোচনা, বিতর্ক ও সুপারিশ আসছে। এর ২০ বছর পর ১৯৯৪ সালে পৃথিবীর সব দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিরা নারী নির্যাতন রোধে একটি অবশ্য পালনীয় বিধি তৈরি করেছেন। এটি হলো বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশন। এতে নারী নির্যাতনকে নির্দিষ্ট করে বলা হয়,
...any action of gender violence that results in or is likely to result in physical, sexual or psychological harm or suffering to women, including threast of such acts, coercion of arbitrary deprivation of liberty whether occurring in public or private life.
এ সম্মেলনে তৈরি বিধির বিশ্লেষণ ও ঘোষণাটি নিম্নরূপ: ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বিরাজমান অসম ক্ষমতা সম্পর্কের একটি বিহঃপ্রকাশ, যা নারীর উপর পুরুষের অধিপত্র প্রতিষ্ঠা ও নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের বৈষম্য সৃষ্টি করছে। নারীর পরিপূর্ণ অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে।’ বেইজিং ঘোষণা অনুযায়ী নারী নির্যাতন বলতে এমন যে কোনো কাজ অথবা আচরণকে বুঝায় যা নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় এবং নারীর শারীরিক ও মনস্তাত্তি¡ক ক্ষতি সাধন করে। তাছাড়াও এ ধরনের কোনো ক্ষতি সাধনের হুমকি, জোরপূর্বক অথবা খামখেয়ালিভাবে সমাজ অথবা ব্যক্তিগত জীবনে নারীর স্বাধীনতা হরণকে বুঝায়।
নারী নির্যাতন বা নিগ্রহ বলতে যে বিষয়গুলোকে বুঝায় তা হলো: পরিবারের অভ্যন্তরে শারীরিক, যৌন অথবা মনস্তাত্তি¡ক নির্যাতন যেমন প্রহার, কন্যা শিশুর উপর যৌন নিগ্রহ, যৌতুক সংক্রান্ত নির্যাতন এবং অন্যান্য প্রথাগত যন্ত্রণাদায়ক রীতি, স্বামী ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির যৌনাচরণ এবং নারীকে কোনো কাজে অন্যায়ভাবে ব্যবহারের জন্য নির্যাতন। স¤প্রদায়ের মধ্যে নারীর প্রতি শারীরিক, যৌন অথবা মনস্তাত্তি¡ক নির্যাতন যেমন ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ, যৌন হয়রানি এবং কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভীতিপ্রদর্শন, নারী অপহরণ এবং জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা; রাষ্ট্র কর্তৃক শারীরিক, যৌন এবং মনস্তাত্তি¡ক নিগ্রহ তা যেখানেই ঘটুক না কেন। অতএব নারীর প্রতি সহিংস আচরণ বা নারী নির্যাতন বলতে সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় হত্যা, পরিকল্পিত ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব এবং জোরপূর্বক গর্ভধারণকে বুঝায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের অবস্থান প্রান্তিক। এই প্রান্তিকতা সমাজ ব্যবস্থার স্তর বিন্যাস কাঠামো থেকে তৈরি হয়েছে। অপরপক্ষে এই প্রান্তিকতার দুটি উপাদান অধস্তনতা এবং নির্যাতন স্তর বিন্যস্ত কাঠামোজনিত কারণে শক্তিশালী হয়েছে। সমাজ ব্যবস্থা নারীদের অবস্থা প্রান্তিক হওয়ায় তারা নির্যাতিত। অধস্তনতা এবং নির্যাতন পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে শোষণের সাংস্কৃতি পরিমন্ডল গড়ে তোলে। এই সাংস্কৃতি পরিমন্ডলের মধ্যে শোষণ অর্থনৈতিক শ্রেণি কাঠামো এবং পিতৃতন্ত্র পরস্পরকে প্রবিষ্ট করে তোলে। এর ফলে পুরুষরা নারীদের শ্রম লুণ্ঠন করে কিংবা নারীদের শ্রমের অর্থ ভোগ করে। এদিক থেকে নারীগণ ত্রিবিধভাবে শোষিত: (ক) তারা মানুষ হিসেবে পুরুষ কর্তৃক শোষিত, (খ) তারা গৃহবধু হিসেবে পুরুষ কর্তৃক শোষিত এবং (গ) তারা বেতনভুক্ত হিসেবে শোষিত। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বা নির্যাতনকে সংজ্ঞায়িত করে বলা হয়েছে, নারী নির্যাতন হলো শারীরিক, মানসিক, জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক ব্যবস্থা।
২০০২ সালে ঢাকায় আয়োজিত Sub-Regional Expert Grop Meeting on Eliminating Violence Against Women শীর্ষক সম্মেলনে বলা হয়, নারী নির্যাতন শুধু কোনো ব্যক্তির উপর আক্রমণাত্মক বিশেষ কিছু নয় বরং নারীর বিরুদ্ধে মানসিক অথবা শারীরিক অথবা স্বাধীনভাবে চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ। এতে আরো বলা হয়, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নারীর যখন অন্যের দ্বারা জোরপূর্বক বঞ্চনার সম্মুখীন হয় এবং শারীরিক, যৌন ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, সে পরিস্থিতিকে নারী নির্যাতন বলে।
নারী নির্যাতন এমন একটি লিঙ্গীয় অপরাধমূলক কাজ যার ফলে নারীর লিঙ্গীয় অথবা মানসিক ক্ষতি হয় অথবা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া এ ধরনের দুষ্কর্ম ঘটানোর হুমকি দেয়া, নানা রকম জোর-জবরদস্তি করা, চলাচলে বিঘœ ঘটানো নির্যাতনের সংজ্ঞায় পড়ে। এ অপরাধমূলক কর্ম যেখানেই সম্পন্ন হোক না কেন তা নারী নির্যাতন হিসেবেই গণ্য হবে। এ সংজ্ঞানুযায়ী শারীরিক, মানসিক, লিঙ্গীয় নির্যাতন যেমন: যৌতুক অনাদায়ের নির্যাতন, নারী পাচার ও লিঙ্গীয় শোষণ, স্ত্রীকে মারধোর করা, নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণ ও শারীরিক অত্যাচার, যৌন হয়রানি করা ও পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
নারী নির্যাতন সমস্যার ব্যাপকতা, গভীরতা ও ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ১৯৯০ সালের ৮ মার্চ থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস, সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই দিবসের প্রেক্ষিতেই আজকের নারী সমাজ তাদের অধিকার ও প্রাপ্তি সম্পর্কে সচেতন হতে শিখেছে। যদিও ধর্ষণ, হত্যা এবং নানা প্রকারের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এখন নিত্যদিনের ঘটনায় রূপান্তরিত হয়েছে। নারীর প্রতি নির্যাতনের নতুন মাত্রা যোগ করেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা আর একই সাথে প্রশাসনের বিরূপ আচরণ। নারী নির্যাতনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় Status of Women প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, Violence agaist women is alarmingly on the increase. The Bangladesh Bureau of Statistics, in a special report in 1993 revealed that death due to unnaturai causes (suicides, murder, burn, snake dite, accident and drowing) in almost three times higher for women that pregnancy related causes.
নারী নির্যাতন স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন ধরনের ও প্রকৃতির হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি হলো আঘাত করা বা অপব্যবহার, যৌতুকের জন্য দৈহিক ও মানসিক চাপ, মানসিক নিপীড়ন, অপহরণ, বউ পেটানো, যৌন নিপীড়ন বা অপব্যবহার, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহ, বিদেশে পাচার, অন্যাভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদ, যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি এবং ধর্ষণ করতে গিয়ে জখম বা মৃত্যু ঘটানো ইত্যাদি অপরাধের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশে যত নারী এসিডদগ্ধ হয়েছে তাদের কেউ-ই পর্দানশীন বা বোরখা পরিহিতা নারী নয়। এ থেকে এটাও প্রমাণ হয়, এ সকল নারীর অনেকেই আন্তরিকভাবে পর্দাবিধান না মেনে চললেও কেবল বোরখা পরার কারণে যেখানে অনেকখানি নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে, সেখানে তারা যদি ইসলামের সকল বিধান মেনে চলে, তাহলে তারা যে নির্যাতন থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাবে, তা সহজেই প্রতীয়মান হয়। সাথে সাথে সমাজের পুরুষগণ যদি ইসলামের বিধান মেনে নারীর অধিকার আদায় এবং নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে এগিয়ে আসে, তাহলে আলাদা করে নারী দিসব ঘোষণা করার প্রয়োজন হবে না। বরং প্রতিদিনই নারীর সম্মান ও অধিকার যথাযথভাবে রক্ষিত হবে। এই বাংলাদেশে একজন নারীও আর নির্যাতনের শিকার হবে না।
সনাতন, খ্রিস্ট, বৌদ্ধ বা ইসলাম কোনো ধর্মীয় আইনই নারী নির্যাতন সমর্থন করে না বরং নারীকে নির্যাতন থেকে সুরক্ষার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করে। বিশেষত ইসলাম ধর্মে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য যেমন বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট আইন প্রদান করা হয়েছে তাতে ইসলাম ধর্মের অনুসারী কোনো ব্যক্তির পক্ষে ধর্মীয় কারণেই কোনো ধরনের নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। সনাতন, খ্রিস্ট ও বৌদ্ধ ধর্মের নারী নীতিও একান্তভাবে এটাই প্রমাণ করে ধর্মগুলোর নিষ্ঠাবান কোনো অনুসারী নারী নির্যাতন করতে পারে না। এমনকি তাদের সামনে কোনো নারী নির্যাতনে শিকার হতে পারে না। ধর্মীয় শিক্ষা ও আবেগের জন্যই তারা নারীকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে তৎপর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এ দেশে সনাতন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী লোক সংখ্যাও কম নয়। সকল ধর্মানুসারী লোকের মধ্যে তাদের স্ব স্ব ধর্ম অনুসারে নারী নির্যাতন প্রতিরোধক শিক্ষা ও বিধিসমূহের নির্মোহ, নিরপেক্ষ এবং সঠিক প্রচারণা চালানো হলে এবং তাদের ধর্মীয় আর্দশ ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা গেলে বাংলাদেশে সমন্বিতভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন