শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

ঢাকার সংকট নিরসনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা আবশ্যক

| প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সরদার সিরাজ : মুগল আমলের ঢাকা কালক্রমে বিশ্বের দ্বিতীয় বসবাসের অনুপযোগী শহরে পরিণত হয়ে পড়েছে। এখানে সমস্যার অন্ত নেই। এর মধ্যে যানজট ও জলজট, রাস্তার বেশিরভাগই অবৈধ দখলে থাকায় নির্বিঘেœ চলাচল দূরহ, ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ের অসহনীয় দুর্গন্ধ, মারাত্মক বায়ু ও নদী , আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি, বিশুদ্ধ পানির অভাব, আবাসন ও শিক্ষাঙ্গণের সংকট, বহু ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিং ও স্থাপনা, অপর্যাপ্ত রাস্তা এবং যেটুকু আছে তাও ব্যাপক ভাঙ্গাচুরা, স্যুয়ারেজ লাইনের অধিকাংশই ভেঙ্গে মজে যাওয়া, এক তৃতীয়াংশ লোকের বাস নোংরা বস্তিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এসব সংকট নিরসনের জন্য বহু লেখা-লেখি, বক্তৃতা-বিবৃতি ও প্রতিশ্রæতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনকিছুতেই কাজ হয়নি। বরং সংকট বেড়েছে। আর এভাবেই দীর্ঘদিন যাবত অবনতি হতে হতে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। সর্বোপরি বৃষ্টি হলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তা কয়েকদিন আগে সকলেই দেখেছেন। শহরের অধিকাংশ স্থানেই অথৈ পানিতে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। নৌকায় চলাচল এবং পানির মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচল ও বিকল হয়ে যাওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন সব মিডিয়ায়ই ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল। এই অবস্থায় আগস্ট মাসেও বৃষ্টি ও বন্যার প্রকোপ বাড়বে বলে আবহাওয়াবিদদের ভবিষ্যৎবাণীতে মানুষেরমধ্যে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। এই জলজটের প্রধান কারণ হচ্ছে: সব খল দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করায় বৃষ্টির পানি দ্রæত নামতে পারছে না। ফলে এই করুণ দশার সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিআইডবিøউটিএর চেয়ারম্যান মোজাম্মেলহোসেনের অভিমত হচ্ছে: ‘রাজধানী ঢাকার আশপাশে মানচিত্র অনুযায়ী ৫১টি খালের অস্থিত্ব পাওয়া যায়। রাজউক ও সিটি করপোরেশনের মতে এ সংখ্যা ৪৬টি। ওয়াসার নথিতে ২৬টি খালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বাকি সব খালবিলীন। তবে প্রাকৃতিক কারণে এই বিলীনের ঘটনা ঘটেনি। রাজউক থেকে বেআইনী অনুমোদনপত্র নিয়ে খাল ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে অট্টালিকা। ফলে ভারী বা হালকা কিংবা মাঝারি যে ধরনের বৃষ্টিই হোক না কেন সে পানি আর নিষ্কাশন হতে পারছে না। এক কথায় ফুসফুসে আক্রান্ত রাজধানী ঢাকা’। গত ২৬ জুলাই মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ ভবনের নিচের জলাবদ্ধতার বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রীর দৃষ্টিআকর্ষণ করা হলে মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ঢাকার চারপাশে ৪৬টি খাল আছে। খালগুলো শনাক্ত করা, উদ্ধার করা, জরুরি ভিত্তিতে কমপক্ষে ১৮টি খাল সংস্কার করার নির্দেশ দিয়েছি ওয়াসাকে। আশা করছি, এ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে রাজধানীতে আর জলাবদ্ধতা হবে না’। খাল ৫১টি, মন্ত্রী উদ্ধার করার নির্দেশ দিয়েছেন মাত্র ১৮টি। আর বাস্তবায়নে গেলে কী হবে তা ভবিষ্যতই জানে। কারণ, এরূপ বহু উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে! এই হচ্ছে খাল উদ্ধারের নমুনা। একই অবস্থা প্রতিটি ক্ষেত্রেই। আর এভাবেই দিনে দিনে মরণের পথে ধাবিত হয়েছে ঢাকা। এরই মধ্যে হঠাৎ করে নতুন একটি প্রকট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, যার নাম চিকুনগুনিয়া। এই নয়া ব্যাধিতে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়ে চরম যন্ত্রণা ভোগ করছে। কিন্তু শুরুতে বেশিরভাগ ডাক্তার এর ট্রিটমেন্ট করতে পারেননি। কারণ, এটা কী ব্যাধি,কী ওষুধ দিতে হবে তাই-ই বুঝতে পারেননি। এই হচ্ছে আমাদের চিকিৎসা সেবার মান! এরূপ হয়েছিল কয়েকবছর আগে ডেঙ্গু নিয়েও। যাহোক, ব্যাপক মশা থেকে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর উৎপত্তি হচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবত মশার ওষুধ না দেওয়ার কারণে মশার অত্যাচার সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবং এসব ব্যাধি সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোপরি এসব শুরু হয়েছে ২/৩ মাস আগে এবং তা দেখতে দেখতে মহামারির আকার ধারণ করেছে। এমনকি দক্ষিণের মেয়রের মা-ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু এতোদিন সিটি কর্পোরেশনের কারো উচ্চ-বাচ্য শোনা যায়নি কিংবা কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি! এখন ব্যাধি বিদায়কালে বিভিন্ন কর্মকান্ড করা হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার ভয়াবহ সংকট নিরসনে নানাজনের নানামত রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হকের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘সোজা কথা বললে আমি অন্তত সামনে সুখবর দেখছি না। নগরব্যবস্থাপনায় সুশাসনের অভাব এমন পর্যায়ে চলে গেছে, এখন স্বল্পমেয়াদি কোনো টোটকায় আর কাজ দেবে না। বরং ঢাকার সমস্যা চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা থেকে আস্তে আস্তে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এটা ক্যান্সারের মতো। এভাবে চললে প্রথমে রাজধানী মরবে, একপর্যায়ে মরবে দেশও’। অবশ্য সাধারণ মানুষ এতো নিরাশ নয়। তাদের অভিমত হচ্ছে, জঙ্গী দমনের ন্যায় সব সংকটের সংশ্লিষ্ট অপরাধীর বিরুদ্ধে অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেই ঢাকার আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে। আর সেটা হতে পারে- ভয়াবহ যানজট নিরসনের জন্য শহরের সব রাস্তাকে দোকান, স্থাপনা, পার্কিং ও অবৈধ যানবাহন চলাচল মুক্তকরণ। এক্ষেত্রে যেসব অফিস বা বাড়ীর সামনে রাস্তায় দোকান ও যানবহান থাকবে, সেসব বন্ধ করে দেওয়া, যেসব যানবাহন অবৈধভাবে পার্কিং, যাতায়াত, হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহার ও ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করবে তার ইঞ্জিন খুলে নিয়ে অজ্ঞাতস্থানে ফেলে দেওয়া এবং চাঁদাবাজ ও দখলবাজের চরম শাস্তি প্রদান। তাহলেই যানজট, চাঁদাবাজী ও দখলবাজী প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। রাস্তা চলাচলের উপযোগী হবে।
রাস্তা মুক্ত হয়ে জলজট কমবে, নদীর আয়তন ও পানি বৃদ্ধি পাবে। রাস্তা প্রশস্ত হবে। উপরন্তু, যেসব কল-করখানার বর্জ্য নদীতে পড়ছে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া দরকার। কারণ, এসব দিয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং ঐ এলাকার পরিবেশ ও বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষা পেয়েছে। কিছুদিন আগে জার্মানিতে ২০তলা এক বিল্ডিং নিমিষের মধ্যেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কেমিকেল দিয়ে। তদ্রুপ এখানেও ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিং ও স্থাপনাকে কেমিকেল দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে বহুতলবিশিষ্ট আধুনিক বিল্ডিং নির্মাণের ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলেই এখানে মরা গাছে ফুল ফুটবে। নতুন বিল্ডিং কোড বাস্তবায়িত হবে। রাস্তা প্রশস্ত হবে এবং যানবাহন রাখা যাবে বিল্ডিংয়ের গ্যারেজে। সর্বোপরি যেসব বাড়ি ও স্থাপনায় রাজউক অনুমোদিত প্লানের বাইরে গ্যারেজে ও ঘর তৈরি করা হয়েছে, তা ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়া এবং সব বসতি এলাকা থেকে ব্যবসা কেন্দ্র উচ্ছেদ করা আবশ্যক। পুরান ঢাকার কেমিক্যালের সব দোকানও অতি দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া আবশ্যক। কারণ, মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এসব বন্ধ করার জন্য মেয়র সাহেব কয়েকবার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। কিন্তু কার্যকর হয়নি। তাই জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এরপর কেমিকেল কারখানার জন্য ঢাকার বাইরে স্থান নির্ধারিত হচ্ছে। সেটা সম্পন্ন হলে সেখানে স্থানান্তর হবে। অন্যদিকে, শহরের সর্বত্রই প্রয়োজনীয় গাছ লাগানো এবং অবৈধভাবে গাছকাটা বন্ধ করা আবশ্যক। বিল্ডিং কোড সংশোধন করে গাছ দালান, ছাদ বাগান ও ঝুলন্ত বাগান সংযুক্ত ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তাহলেই বায়ু দূষণ হ্রাস পাবে। অপরদিকে, যথাশিগগির সরকারি সব যায়গা ও বাড়ি দখলমুক্ত করা আবশ্যক।
লেখক :সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন