মো. তোফাজ্জল বিন আমীন ম: সন্তান আর বাবা-মায়ের সর্ম্পক পৃথিবীর কোনো দার্শনিক কিংবা পন্ডিত তৈরি করে দেননি। এটা তৈরি করে দিয়েছেন দুনিয়া ও আরশের মহান মালিক আল্লাহতায়ালা। সুতারাং তাঁর দেয়া সর্ম্পককে ছিন্ন করার অধিকার কোনো মানুষের নেই। সন্তান আর বাবা-মায়ের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব কেন বাড়ছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পারিবারিক জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা অনুসরণ হচ্ছে না বলেই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়ছে। কেউ শিকার করুক বা না করুক বৃদ্ধাশ্রম হচ্ছে পরাজিত মানবতার দুঃসহ বুকফাটা কান্নার অসহ্য বেদনার এক নীড়।
আমাদের সমাজের একশ্রেণির নিষ্ঠুর সন্তান পাশ্চ্যতের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে নির্বাসন দিচ্ছে। বাবা-মায়ের আশ্রয়ের জায়গাটুকু তৈরি করতে বৃদ্ধাশ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এটাও ঠিক, বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার চেয়ে আজ বেশি প্রয়োজন জাতির মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটানো। বয়োবৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করা গেলে অসহায় বাবা-মায়ের যন্ত্রণার অবসান ঘটবে। সমাজের এই কদাকার চেহারাই বলে দেয় আমরা কতটা স্বার্থপর হয়ে গেছি। সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে বাবা-মা অজস্র কাঁটার আঘাত সহ্য করেন। সে ইতিহাসের কথা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। দুঃখ-কষ্ট সয়ে যে কলিজার টুকরা সন্তানকে বড় করে তোলে সেই সন্তান যখন দুঃখ-কষ্টের কারণ হয় তখন আর কষ্টের সীমা থাকে না। নিষ্ঠুর সন্তান যখন বৃদ্ধাশ্রমের অজানা কুঠিরে বা-মাকে পাঠায়, তখন বাবা-মায়ের মনের অবস্থা কেমন হয় তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুধান করতে পারে।
বাবা-মায়ের ঋণ পরিশোধ করা সন্তানের পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। তবে যদি বাবা-মা সন্তানের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ক্ষমা করে দেয়, তাহলে কেবল সন্তানের জীবন ধন্য হতে পারে। পৃথিবীর সব ধর্মই বাবা-মার প্রতি সন্তানের দায়িত্বকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আমরা যদি পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলতে পারতাম, তাহলে আমাদের বাবা-মায়ের জীবনের গল্পটা বৃদ্ধাশ্রমের হতো না; একটু অন্যরকম হতে পারত। বাবা-মায়ের প্রতি অমানবিক আচরণের ঘটনা সবর্ত্র বিরাজ করছে। গাঁও গেরামের কথা না হয় বাদই দিলাম, শহরাঞ্চলের আধুনিক উচ্চশিক্ষিত ও বিত্তবান পরিবারে যখন দেখি, বাবা-মায়ের সাথে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে তখন মনে দাগ কাটে। পাশ্চাত্যের ভোগবাদীদের অন্ধঅনুকরণে গা ভাসিয়ে আমাদের দেশেও অসহায় মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আমাদের যৌথ পরিবারপ্রথা বিলীয়মান হওয়ার কারণেই বয়োবৃদ্ধ মা-বাবাকে ঠাঁই নিতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।
পত্রিকার পাতায় কয়েকটি অমানবিক ঘটনার সংবাদ পড়েছিলাম, যা মনে হলে এখনও গা শিউরে উঠে। গত ২১ জানুয়ারি ২০১৭ সিলেটের কুলাউড়ায় বৃদ্ধা মাতাকে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুত্বর আহত করেছে তারই নিষ্ঠুর পুুত্র জাকির হোসেন খান। বৃদ্ধা মাতা কমরুন নেছা স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেডে শুইয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ৩০ মে ২০১৭ ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার তেজপাটুলি গ্রামের মরিয়ম নেছাকে তার সন্তান গোয়ালঘরে রাতে থাকতে বাধ্য করে। রাতে পাশের জঙ্গলের শিয়াল এসে ঘুমন্ত বৃদ্ধাকে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। তার আর্তচিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে এলেও অসহায় বৃদ্ধার সন্তানেরা মায়ের চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়নি। ১৮ জুলাই খবরে প্রকাশ, কোটিপতি বাবার মৃত্যুর খবর শুনেও তাঁর উচ্চশিক্ষিত সন্তানেরা দাফনে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বাবা কোটিপতি ছিলেন। সন্তানদেরও করেছেন প্রতিষ্ঠিত। লিখে দিয়েছিলেন কোটি টাকার ফ্ল্যাট-বাড়ি। তারপর একটা সময় বাবা বুঝতে পারেন, সন্তানদের ঘরে তিনি জঞ্জাল হয়ে উঠেছেন। সন্তানরাই তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। এক পর্যায়ে অনাহারে অর্ধহারে বাবা মারা যান, আর সন্তানেরা তার দাফন করতেও অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। এই ঘটনাটি কারও কাছে অবিশ্বাস্যও মনে হতে পারে! কারণ কোটিপতি বাবার জীবনে এমন কালো মেঘ নেমে আসার তো কথা ছিল না।
সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের খুব বেশি কিছু বায়না থাকে না। শুধুমাত্র সন্তানের পাশে জীবনের বাকি সময়টুকু অতিবাহিত করার ইচ্ছা পোষণ করে থাকেন। সন্তানের ইচ্ছাপূরণ করার জন্যে বাবা-মায়ের চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকে না। অথচ জীবনের পড়ন্ত বেলায় বাবা-মায়ের আশ্রয় সন্তানের কাছে না হয়ে, আশ্রয় হয় স্বজনহীন বৃদ্ধাশ্রমে। তবু প্রতিবাদ দানা বাঁধে না; মন অভিশাপ দেয় না। কারণ তারা যে বাবা-মা। বিশ্ব মা দিবসে পত্রিকান্তরে মুদ্রিত হয়েছে, দেশে আশ্রয়হীন মায়ের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে , দেশে প্রবীণ মায়েদের ৮৮ দশমিক ৪ ভাগ মানসিক নির্যাতন, ৮৩ দশমিক ৩ ভাগ অবহেলা ও শারীরিক নির্যাতন এবং ৫৪ দশমিক ৪ ভাগ অর্থনৈতিক প্রবঞ্চনার শিকার। ওই রিপোর্টটিতে আমাদের ভয়াবহ মানবিক মূল্যবোধ বিপর্যয়ের চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। ইসলামে বাবা-মায়ের অধিকারের বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। আল্লাহপাক বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার এবং তাদের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের প্রতি অনুগত থাকা, নম্র ব্যবহার করা, কর্কশ কথা বলা এবং শব্দ উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকার জোর তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, আল্লাহর ইবাদত করো এবং এতে অন্য কাউকে শরিক করো না এবং বাবা-মার প্রতি সদাচারণ করো (৪:৩৬)। আল্লাহপাক আরও বলেছেন, আমার প্রতি এবং তোমার বাবা-মার প্রতি কৃতজ্ঞ থাক (৩১:১৪)। সূরা আল ইসরার ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বাবা-মায়ের প্রতি উত্তম ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। নবী করিম (সা:) বলেছেন, বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব পালন করা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার চেয়েও অগ্রগণ্য।
যে বাবা-মা একসময় নিজে না খেয়ে সন্তানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায় ও কেমন আছেন সেই খবর নেয়ার সময় যাদের নেই, তার নিজের সন্তানও হয়তো একদিন তার সাথে এমনই আচরণ করবে- এটি সন্তানদের অনুধাবন করা প্রয়োজন। সম্প্রতি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম একটি আইন প্রণয়ন করতে চলেছে, যাতে সরকারি কর্মচারীরা তাদের বাবা-মায়ের ঠিকমতো দেখাশোনা না করলে তাদের বেতন থেকে একটা অংশ কেটে নেওয়া হবে। আমাদের দেশেও পিতা-মাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩ সালে প্রণীত হয়েছে। এই আইনের ৫নং ধারার (১)এ বলা হয়েছে, কোন সন্তান কর্তৃক ধারা ৩ এর যে কোন উপ ধারার বিধান কিংবা ধারা ৪ এর বিধান লংঘন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবে; বা উক্ত অর্থদন্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৩ মাস কারা দন্ডে দন্ডিত হইবে। আমাদের সকলের মনে রাখা উচিত, আজ যারা সন্তান তারাই আগামী দিনের বাবা কিংবা মা। জীবনের পড়ন্তবেলায় প্রতিটি বাবা-মা শিশুদের মতো কোমলমতি ও পরনির্ভরশীল হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য। আমাদের পারিবারিক বন্ধন ও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন নৈতিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন