পারভেজ হায়দার : আজ ৯ আগস্ট, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। সরকারের বিভিন্ন গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। তবে সা¤প্রদায়িক রীতিনীতির ভিন্নতার কারণে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট স¤প্রদায়ের জনগোষ্ঠী থাকায় সরকার ওইসব জনগোষ্ঠীকে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ হিসাবে পরিগণিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যারা ইতিপূর্বে ‘উপজাতি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছিলো। সরকার দেশের ঐতিহাসিক পটভূমি বিবেচনায় এবং বাংলাদেশে বসবাসরত ওই জনগোষ্ঠীসমূহের উৎস ও প্রাথমিক আগমনের বিষয় আমলে নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবী তাদের মনগড়া মতাদর্শ সরকারের সিদ্ধান্তের উপর চাপিয়ে দিতে চান। যদিও তাদের এই দাবির পিছনে ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই। আশা করা যায়, তারাও বিষয়টি বোঝেন, কিন্তু নিজেদের অহংকারপ্রসূত অথবা অন্য কোন স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে ব্যক্তিগত লাভের আশায় তারা তাদের ভ্রান্ত মতাদর্শ দেশের উপর চাপিয়ে দিতে চান। তাদের এই দাবি এবং কার্যক্রম চরমভাবে দেশের স্বার্থবিরোধী হতে পারে এ বিষয়টি তারা একেবারেই বুঝতে চান না।
বাংলাদেশের ভূখন্ডে বসবাসরত ‘ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর’ অধিবাসীগণ এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবীদের ‘আদিবাসী’ সংক্রান্ত দাবি একেবারেই নতুন। ইতিপূর্বে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর’ অধিবাসীগণ নিজেদের ‘উপজাতি’ হিসেবে পরিচয় দিতে সম্মানিত বোধ করতো। এমনকি ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তিতেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এই অধিবাসীদের ‘উপজাতি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ অধিবেশনে The Nation Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (UNDRIP) বিল পাশ হওয়ার পর থেকে তারা নিজেদের ‘আদিবাসী’ দাবি করতে শুরু করেন। তবে অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশসমূহ ঐ বিলের বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং বাংলাদেশসহ আরও ১১টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। বাংলাদেশ UNDRIP-তে ভোটদানে বিরত থাকলেও জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক শর্তানুযায়ী বাংলাদেশে ‘আদিবাসীদের’ উপস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা করে সরকার ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর এই স¤প্রদায়সমূহকে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ নামে অভিহিত করেছে।
২০০৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত UNDRIP-তে আদিবাসীদের কয়েকটি নির্দিষ্ট অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আদিবাসীদের ভূমি অধিকার, জীবন ও নিরাপত্তার অধিকার, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় স্বীকৃতি, শিক্ষা ও তথ্যের অধিকার এবং চাকরি, দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার, আদিবাসী অধ্যুষিত ভূমিতে খনিজ সম্পদসহ অন্যান্য সম্পদের অধিকার, জ্ঞানের অধিকার, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রশাসন পরিচালনা করার অধিকার ইত্যাদি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে কোন নিদিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে ওই ভূখন্ডের উপর স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সরকারের কর্তৃত্ব খর্ব হবে। এমনকি ওই ভূখন্ডে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হলে ‘আদিবাসী’ ওই জনগোষ্ঠীর সাথে পরামর্শ করতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে সত্য না হলেও সুযোগের সদ্ব্যবহার এবং বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে চাকমা সার্কেল প্রধান ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়সহ উপজাতিদের সমমনা বুদ্ধিজীবীগণ বাংলাদেশে বসবাসরত ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর জাতিসত্ত্বাসমূহকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিগণিত করার দাবি তুলেছেন।
একটি দেশের বসবাসরত অধিবাসীদের মধ্যে ‘Minorities’ এবং ‘আদিবাসী’ বিষয়টি এক নয়। তবে কিছু কিছু দেশে স্বীকৃত আদিবাসীগণ ‘Minorities’ নয়। যেমন- গুয়েতেমালা, ভলিবিয়া ইত্যাদি। বাংলাদেশে বসবাসরত ছোট ছোট জাতিসত্ত্বার অধিবাসীগণকে ‘Minorities’ হিসেবে পরিগণিত করা অধিক যুক্তিযুক্ত। জাতিসংঘ কমিশনের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার হোসে মার্টিনেজ কোবে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, কোন ভূখন্ডের আদিবাসী স¤প্রদায়, জাতিগোষ্ঠী বা জাতি বলতে তাদের বোঝায়, যাদের ঐ ভূখন্ডে প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-উপনিবেশকাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে, যারা নিজেদেরকে ওই ভূখন্ডে বা ভূখন্ডের কিয়দাংশে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র মনে করে। সেই সাথে তারা নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পূর্বপুরুষের ভূখন্ড ও নৃতাত্তি¡ক পরিচয় ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে।
জাতিসংঘ এখানে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। যারা কোনো উপনিবেশ স্থাপনের আগে থেকেই ওই ভূখন্ডে বাস করছিল, যারা ভূখন্ডের নিজস্ব জাতিসত্ত¡ার সংস্কৃতি ধরে রেখেছে ও তা ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে এবং যারা নিজেদের স্বতন্ত্র মনে করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘আদিবাসী’ হবার জন্য পূর্বশর্তসমূহ পূরণ করে না। তারা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে চট্টগ্রাম তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ১৭শ খ্রিস্টাব্দ ও ১৮শ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ের দিকে অবস্থান নিয়েছিল। আদিবাসীদেরকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন: অষ্ট্রেলিয়াতে ‘Aboriginal Peoples’, ফ্রান্সে ‘Aboriginal Peoples’, কানাডাতে ‘First Nations’, যুক্তরাষ্ট্রে ‘Indians’ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদিবাসীগণ প্রকৃতির উপর নির্ভর করতে গিয়ে চরম দারিদ্রতার মধ্যে দৈনন্দিন জীবন অতিবাহিত করছে। তারা সাধারণত সভ্য সমাজের অন্যান্য স¤প্রদায়ের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে নিজেদের মতো করে চলতে পছন্দ করে। তাই আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের দৃষ্টিগোচরে আনার জন্য ১৯৬৫ সালে জাতিসংঘে International Convention To Eliminate All Forms Of Racial Discrimination (ICERD) বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে পাশকৃত UNDRIP--তে আদিবাসীদের জন্য কয়েকটি মৌলিক অধিকারের বিষয়ে সমুন্নত রাখা হয়েছে। তার মধ্যে Convention--১৬৯ অনুযায়ী আদিবাসীগণ যে দেশের ভূখন্ডে অবস্থান করছে সেই দেশের সরকার বিভিন্ন আইনগত বিষয়ে যা আদিবাসীদের সরাসরি প্রভাবিত করবে সে বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনা করতে বাধ্য থাকবে। Convention-১৬৯ এ আরো উল্লেখ আছে, সরকার আদিবাসীদের সাথে আলোচনার সময় সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে আলোচনা করবে। ২০০৭ সালের জাতিসংঘ অধিবেশনে আদিবাসী বিষয়ে পাশকৃত ইস্যুটিতে তিনটি মৌলিক বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, প্রথমত তাদের ভূখন্ডে সম্পদের অধিকার, দ্বিতীয়ত নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার এবং তৃতীয়ত রাজনৈতিক অধিকার অর্থাৎ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ও পদ্ধতিতে প্রশাসন ব্যবস্থাপনা।
২০০৭ সালের জাতিসংঘের অধিবেশনে পাশকৃত UNDRIP-তে আদিবাসীদের যেসকল অধিকার দেওয়া হয়েছে তা অনেকটা ওই নির্দিষ্ট ভূখন্ডে স্বায়ত্বশাসনেরই নামান্তর। তথাপি এদেশে বসবাসরত ছোট ছোট জনগোষ্ঠী যদি আসলেই ‘আদিবাসী’ হবার পূর্বশর্তসমূহ পূরণ করতো তাহলে তাদের দাবী অনুযায়ী সরকার নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে দৃঢ়ভাবে বিবেচনা করতো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবীগণ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সুযোগ সন্ধানী কিছু নেতৃবৃন্দ তাদের সুদূরপ্রসারী দেশবিরোধী স্বার্থের কারণে ২০০৭ সালের পর থেকে হঠাৎ করেই ‘আদিবাসী’ বিষয়ে দাবি তুলেছেন। ভ্রান্ত এই দাবিটি দেশের স্বার্থবিরোধী, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তথাপি দেশের কতিপয় স্বার্থান্বেষী নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত ব্যক্তিবর্গ, এমনকি একশ্রেণির সাংবাদিকও ইদানীং ছোট ছোট ক্ষুদ্র বিভিন্ন স¤প্রদায়গুলোকে সরকার নির্দেশিত ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ না বলে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করছেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কতা সত্তে¡ও ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, জাতীয় ঐতিহাসিক স্থানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে।
২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন-৩ অধিশাখা থেকে ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নামক অসাংবিধানিক দাবি বাস্তবায়নের অপকৌশল রোধে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো জাতীয় ঐতিহাসিক স্থান ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন’ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে উপজাতীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে উল্লেখ না করার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকা সত্তে¡ও স্বার্থান্বেষী মহল খুব সচেতনভাবেই তা অমান্য করছেন। সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্তে¡ও যেহেতু স্বার্থানেষী কিছু বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে সম্বোধন করছেন সেহেতু তারাও সুদূর প্রসারী কোন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এটা করছেন, তা অনুমান করা যায়। প্রত্যেক মানুষেরই আলাদা আলাদা মতাদর্শ থাকতে পারে। তবে সে মতাদর্শ যেন দেশপ্রেমের সাথে সাংঘর্ষিক না হয় সেটি খেয়াল রাখা দরকার। তাছাড়া দেশের ভাবমর্যাদা রক্ষা, অখন্ডতা রক্ষা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মতো মৌলিক বিষয়ে কোন বিতর্ক সৃষ্টি কাক্সিক্ষত নয়। কেননা, মৌলিক বিষয়সমূহে আমাদের মতাদর্শগত ভিন্নতা দেশপ্রেমের গভীরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
লেখক : পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন