শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

হজরত শাহ জালাল (রহ.) সম্পর্কে তথ্য বিভ্রাট

| প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কে. এস সিদ্দিকী : এদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব পীর মাশায়েখ আওলিয়া তথা সূফি সাধকের ভূমিকা ইতিহাস খ্যাত ও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে, তাদের মধ্যে সিলেটে চিরশায়িত হজরত শাহ জালাল (রহ.) ও তাঁর ৩৬০ সহযাত্রীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের বদৌলতে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের যে ঢেউ আরম্ভ হয় পরবর্তীতে তা সয়লাবের রূপ লাভ করে। ভিন্ন ধর্ম হতে দলে দলে লোক এসে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে সৌভাগ্য লাভ করতে থাকে। মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর প্রদর্শিত পথ ধরে পরবর্তী মাশায়েখ সূফি ও উলামায়ে কেরাম ইসলামের প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখে চলেছেন। হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর অগ্রণী ভূমিকার কারণে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ দেশের মুসলমান মত ও পথ নির্বেশেষে অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা ও যথাযথ মর্যাদা সহকারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যিলকদ মাসের ২য় দশকের শেষ দিকে তাঁর ওফাত বার্ষিকী পালন করে থাকেন এবং হযরতের জীবন ও অবদানের কথা এবং তাঁর আদর্শ শিক্ষার কথা স্মরণ করে থাকেন। তিনি ইসলামের অমীয়বাণী প্রচারকালে কত লোক ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিল সঠিক সংখ্যা অজানা।
হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর অসংখ্য কেরামত অলৌকিক বিস্ময়কর ঘটনাবলী পাঠ করে মুসলিম-অমুসলিম সবাই হতবাক হয়ে যায়। পৌত্তলিকতা কবলিত সে যুগের সামাজিক-নৈতিক অবক্ষয় এবং মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর আন্দোলন ও ভূমিকার কথা যারা জানে না অথবা জেনেও না জানার ভান করে, তারা ছাড়াও আরেক শ্রেণির লোক আমাদের এ সমাজে বাস করে, যাদেরকে ইসলাম বিদ্বেষী বলে আখ্যায়িত করা যায়। এ শ্রেণির লোকেরাই হযরত শাহ জালাল (রহ.) ও তাঁর ৩৬০ সঙ্গীকে কুরুচিপূর্ণ অভিধায় চিহ্নিত করে।
কেননা শাহ জালাল (রহ.) এমন এক আধ্যাত্মিক সাধক ও কামেল পীর ছিলেন, যার তবলীগ প্রচারের ভূমিকার ওপর এযাবত বিভিন্ন ভাষায় বিস্তর বই পুস্তক রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষা ছাড়াও আরবি, ফারসি, উর্দূ, এমনকি ইংরেজি ভাষায়ও বহু পুস্তক, পুস্তিকা রচিত হয়েছে। বিশেষত বাংলা ভাষায় স্বতন্ত্র জীবন চরিত ছাড়াও বিরাট আকারের বহু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ বিপুল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এতদ্ব্যতীত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার সম্পর্কিত প্রকাশিত সকল পুস্তক-পুস্তিকায় হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর ভূমিকা প্রাধান্য পেয়েছে। এখানে উদাহরণ হিসেবে আমরা কয়েকটি মাত্র বাংলা পুস্তকের নাম উল্লেখ করতে চাই। সেগুলোর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: ১। সৈয়দ মুর্তাজা আলী কৃত- হযরত শাহ জালাল (রহ.) ও সিলেটের ইতিহাস। ২। মুফতী আজহার উদ্দীন আহমদ রচিত শ্রী হট্টে, ইসলামের জ্যোতি। ৩। আবদুর রহিম রচিত শ্রীহট্ট, নূর। ৪। আবুদল ওহাব রচিত শ্রীহট্ট, শাহ জালাল। ৫। আবদুল মালিক চৌধুরী রচিত শ্রীহট্ট, শাহ জালাল। ৬। অমিত ভাত চৌধুরী রচিত, শাহ জালাল। ৭। নরেন্দ্র কুমার গুপু চৌধুরী রচিত শ্রীহট্ট, প্রতিভা।
ইসলামী বিশ্বকোষসহ আরো অসংখ্যা গ্রন্থ, পুস্তক-পুস্তিকা, পত্র-পত্রিকা, জার্নাল, ম্যাগাজিন, সাময়িকী, সরকারি গেজেট, ইত্যাদিতে হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর ওপর প্রচুর তথ্য উপাত্ত রয়েছে। এ যাবত বিশেষভাবে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার সংক্রান্ত বাংলা ভাষায় অসংখ্য বই পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রত্যেকটিতে অল্প বিস্তর হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর ওপর আলোচনা স্থান পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে আলহাজ মাওলানা এম. ওবাইদুল হক সংকলিত বাংলাদেশের পীর আউলিয়াগণ এবং গোলাম সাকালায়েনের বাংলাদেশের সূফী সাধক গ্রন্থদ্বয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমোক্ত গ্রন্থে হযরত শাহ জালাল (রহ.) সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
সৈয়দ মুর্তাজা আলী, মাওলানা ওবাইদুল এবং গোলাম সাকালায়েন প্রমুখ সকলেই তাদের রচনায় হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর জীবন বৃত্তান্ত ও তার ভূমিকা আলোচনা করতে যে কটি প্রাচীন গ্রন্থ উপাখ্যানকে মূল ভিত্তি বা সূত্র হিসেবে অবলম্বন করেছেন সেগুলো হচ্ছে: ১। ইবনে বতুতার সফর নামায় বর্ণিত শাহ জালাল সংক্রান্ত বিবরণ। ২। হিজরী ১১২৪ সালে রওজাতুল সালেহীন সম্পাদন করেন হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর অনুচর হামিদ উদ্দিন নারুন্দ্রির জনৈক উত্তরাধীকারী দিল্লীর রাজা মূলতান ফররোখ সিয়ামের এর রাজত্বকালে। ৩। ১১৩৪ হিজরীতে আরো এক খানা গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এটি হলো, তৎকালীন বাঙ্গালার সুবাদার জাফর খান নুসেরী ওরফে মুর্শিদ কুলি খানের নির্দেশে মঈদ উদ্দীন নামক হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর দর্গার জনৈক খাদেম কর্তৃক বিরচিত। উভয় গ্রন্থই সিলেটে প্রচলিত উপাখ্যানের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে প্রসিদ্ধ। ৪। ত্রিপুরার অধিবাসী নাসির উদ্দীন হায়দার নামক জনৈক মুনসিফ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে যখন দরগাহ মহল্লাতে অবস্থান করছিলেন তখন তিনি ‘সুহেলিয়ামন’ নাম দিয়ে উল্লেখিত উভয় গ্রন্থের একটি চুম্বক প্রস্তুত করেছিলেন। এই উভয় মূল গ্রন্থই বর্তমানে বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে জানা যায়, কিন্তু ‘সুহেলিয়ামন’ এর উপাখ্যান এখনো দরগার খাদেমগণ কর্তৃক রক্ষিত হচ্ছে বলে মনে করা হয়।
‘সুহেলিয়ামন’ সম্পর্কে আরো একটি তথ্য জানিয়ে রাখতে চাই এবং তা এই, মাসিক আখতার নামক একটি উর্দূ সাহিত্য পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ১৯২৪ সালে ‘সুহেলিয়ামন’ এর প্রথমাংশ ছাপা হয়েছিল। এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ময়মনসিংহের এক পাড়া-গাঁয়ে জন্মগ্রহণকারী মাহমুদুর রব সিদ্দিকী, যিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন ‘খালেদ বাঙালী’ নামে। তিনি মরহুম জাহেদ সিদ্দিকীর পিতা ছিলেন। জাহেদ সিদ্দিকী ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারের উর্দূ সংবাদ পাঠক ছিলেন। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের উর্দূ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও সংবাদ পাঠক ছিলেন। তার পিতা খালেদ বাঙালী ছিলেন পঞ্চাশের অধিক গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা আবদুল হাই আখতারের পুত্র। পিতার নাম স্মরণে খালেদ বাঙালী ‘আখতার’ নামক পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন এবং এ পত্রিকায় তার প্রবন্ধের প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছিল, কিন্তু পত্রিকাটি প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সুহেলিয়ামন এর পরবর্তী অংশ আর প্রকাশিত হতে পারেনি। ‘আখতার’ সম্পাদক লেখার শেষে নাম উল্লেখ করেন সাইফী বাঙালী।
৫। ‘তাজকেরায়ে শায়খ সৈয়দ জালাল মোজাররদ কেনিয়ায়ী’ শীর্ষক ৬৩ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি উর্দূ পুস্তিকা রচনা করেছেন। ১৯৬৭ সালে সিলেট হতে প্রকাশিত এ পুস্তিকায় ‘গুলজারে আবরার’ গ্রন্থের পরিচয় প্রদান করা হয়েছে এইভাবে, মোহাম্মদ গাওসী ইবনে মূসা শাত্তারী মান্দভী কর্তৃক রচিত হিন্দুস্থানের আওলিয়ার ইতিহাস। হিজরী ১১৫৫ মোতাবেক ১৭৪২ সালে এটি ফারসি ভাষায় লিখিত এবং এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯২০। পুস্তিকা লেখকের মতে, এটি হযরত শাহ জালাল উদ্দীন মোজারবাদের জীবনী গ্রন্থ তার উৎস ‘শরহে নুজহাতুল আরওয়াহ’ যা শায়খ আলী কর্তৃক রচিত, যিনি ছিলেন শায়খ নুরুল হুদার বংশধর। শায়খ নুরুল হুদা ছিলেন হযরত শায়খ জালাল উদ্দীন মোজারবাদের একজন মুরীদ ও খলিফা। তার পূর্ণ নাম শায়খ নুরুল হুদা আবুল কারামাত সাঈদ হাসানী। শরহে নুজহাতুল আরওয়াহ আলী শের কর্তৃক হিজরী ৯৭৯ (১৫৭১ খ্রি.) সালে রচিত।
বস্তুতঃ ফারসি ভাষায় প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে হযরত শাহ জালাল (রহ.) সম্পর্কে তথ্য উপাত্তের আধিক্য বিদ্যমান থাকলেও কয়েকটি বিষয়ে পরস্পর বিরোধী তথ্যও রয়েছে। ফলে যারা সরাসরি ওসব তথ্য গ্রহণ করেছেন অথবা ওসব তথ্যের অনুবাদের আশ্রয় নিয়েছেন, তারাও সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়েছেন, অনেকে যথার্থতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেছেন। বিরোধমূলক বা বিতর্কিত বিষয়গুলোর মধ্যে হযরত শাহ জালাল (রহ.) যার মাজার সিলেটে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে তিনি কে ছিলেন এ বিতর্কের কারণ প্রধানত একই সময়কালের মধ্যে চারজন শাহ জালালের বিদ্যমান থাকা।
এ কারণে সিলেটে সমাহিত শাহ জালাল (রহ.) কে নিশ্চিত করার জন্য কোনো কোনো গবেষক লেখক চারজন শাহ জালালকে আলাদাভাবে চি‎িহ্নত করার চেষ্টা করেছেন, এ বিষয়ে বিতর্ক অবসানের এটি ছিল সঠিক উদ্যোগ। সিলেট বিজেতা শাহ জালাল (রহ.) এর জন্ম তারিখ নিয়ে বিতর্কের ফলে তার বয়স ১৫০ বছর পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে। পক্ষান্তরে এটাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করে কেউ কেউ বিভিন্ন ফারসি কবিতা উদ্ধার করেছেন যার একটি ছত্রে আবজাদ পদ্ধতিতে মৃত্যু তারিখ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ বিখ্যাত উর্দূ কবি ও সাহিত্যিক আবদুল গফুর (ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফের বড় ভাই) তার এক ফারসি কবিতায় আজাদ প্রণালীতে মৃত্যু তারিখ হিজরী ৮৯১ সাল নির্ণয় করেছেন। গবেষক লেখকগণ এ তারিখই সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন। আরো বিভিন্ন বিষয়ে সৃষ্ট বিরোধ বিতর্কের অবসান ঘটেছে বলে মনে করা হয় না।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নিজামউদ্দীন আওলিয়া নামক এক সাধকের সাথে হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর সাক্ষাতের তথ্য। এ সাক্ষাতের ফলে যুগ নির্ণয়ে আরো কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের পীর আউলিয়াগণের লেখক সংশয়টি দূর করে দিয়েছেন এই বলে দিল্লীতে তখন নেযামুদ্দীন আওলিয়া নামীয় প্রসিদ্ধ নেযামুদ্দীন আওলিয়া যিনি বাবা ফরিদ (রহ.) এর মুরীদ ছিলেন তিনি নহেন (পৃ. ২৪৯)। ইতিহাসে এইরূপ বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, একই সময়কালের মধ্যে একই নামের ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব থাকেন নেযামুদ্দীন আওলিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। খোদ শাহ জালাল নামে একই যুগের চারজন আওলিয়া ছিলেন, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং সিলেটের হযরত শাহ জালাল (রহ.) সম্পর্কিত বিতর্কিত সব বিষয়ের অবসান হওয়া উচিত।
গুলজারে আবরার গ্রন্থের বরাতে সৈয়দ মুর্তাজা আলী উল্লেখ করেছেন, শাহ জালাল মুজররদ কুতুববুদ এই ফারসী বাক্যাংশ থেকে আবজাদ প্রক্রিয়ায় গণনা দ্বারা তার ওফাতের তারিখ ৭৪০ হিজরী পাওয়া যায়। সুতরাং তিরোধানের সময় তাঁর বয়স উনসত্ত¡র বছর হয়েছিল। ২০ জিলকদ তারিখে তার ওফাত হয়। ঐ তারিখে প্রত্যেক বছর তার উরস পালন করা হয়। তিনি তার সঙ্গীদের শ্রী হট্টের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ও নিকটবর্তী জেলা সমূহে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে প্রেরণ করেন। তারা স্ব স্ব প্রচার ক্ষেত্রে চিরস্থায়ীভাবে বাসস্থান নির্মাণ করে অবস্থান করেন। (পৃ. ২৪-২৫)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন