মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : আমরা কঠিন এক অবস্থার ভেতরে বসবাস করছি, যেখানে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক একটি দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। আমরা কেউই নিরাপদ নই। একটা সমস্যার রেশ কাটতে না কাটতে আরেকটি সমস্যা এসে ভর করছে। মজলুম মানুষের আর্তনাদ কান পাতলেই শোনা যায়। ক্ষমতাসীনদের কানে ওই কান্নার আওয়াজ পৌঁছে না বা তাদের শোনার গরজ নেই। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের বর্বরতার শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু। রাজধানীসহ সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনা আশংকাজনকহারে বেড়েই চলেছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গৃহবধূ এমনকি অবুঝ শিশুও ধর্ষণের বর্বরতা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। ধর্ষক শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছে না, ধর্ষিতাকে মেরেও ফেলেছে। সংবাদ মাধ্যমে ধর্ষণের যে সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে তা সঠিক সংখ্যা নয়। ধর্ষণের প্রকৃত চিত্র এর চেয়েও ভয়াবহ। অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষিতা নারী লোকলজ্জার ভয়ে আইনি বা সামাজিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। ফলে পার পেয়ে যায় ধর্ষক। আবার ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে নানা অপমান-অপদস্ত ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। যে কারণে কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।
দেশে যে হারে ধর্ষণ, গণধর্ষণ বেড়ে চলেছে তা প্রতিরোধ করতে না পারলে সামনে আরো ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে সংঘটিত ধর্ষণের পর অবিরাম ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলেছে। গত ২৯ জুলাই শুক্রবার বিকালে বগুড়ায় কলেজে ভর্তি করে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এক ছাত্রীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে বগুড়ার শহর শ্রমিক নেতা তুফান সরকার। সে শুধু তুলে নিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ওই ছাত্রী ও ছাত্রীর মাকে মাথা ন্যাড়া করে বগুড়া ছাড়ার হুমকি দিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের নাম যখন ধর্ষক হিসেবে পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয় তখন সত্যিই লজ্জা লাগে। সরকারের মন্ত্রী এমপি থেকে শুরু করে নেতা-নেত্রীরা ধর্ষণের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। অথচ আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তার সিংহভাগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীর দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। আমরা মনে করি, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সরকারের আমলে যতগুলো ধর্ষণের ঘটনা সংগঠিত হয়েছে তার তালিকা জাতির সামনে উন্মোচন করা যেতে পারে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ছয় মাসে ২৮০ জন নারী ধর্ষিতা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ জন ধর্ষিতা নারী আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ৩৯ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। আমরা যদি বিগত কয়েক বছরের সংবাদপত্রের আলোচিত কিছু প্রকাশিত খবর দেখি তাহলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারব। ১৩ জুন চট্টগ্রাম মহানগরীরর পাঁচলাইশ থানা এলাকায় সালামা নামের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে ধর্ষণকারীরা। ১ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডায় খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে রাজধানীর বাড্ডায় তিন বছরের শিশু তানহাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ঘাতক শিপন। ৩ আগস্টে সিদ্ধিরগঞ্জে চলন্ত ট্রাকে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে ট্রাকের চালক ও হেলপার পালিয়ে যায়। গত ৫ জুলাই রাজধানীর বনানীতে জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে বাসায় ডেকে এক তরুণীকে ধর্ষণ করে বাহাউদ্দীন ইভান নামের এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। ৭ জুলাই সাভারের সোবানবাগে ডিবি পুলিশ অফিসের ৫০ গজ সামনে একটি কলেজের অফিসের কক্ষে এক তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। ৯ জুলাই নোয়াখালীতে বসতঘরে ঢুকে এক তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। ময়মনসিংহের নান্দাইলে দশম শ্রেণীর এক স্কুলছাত্রীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে পাটক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করে একই এলাকার ইব্রাহীম নামে এক যুবক। ১৬ জুলাই বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন মোল্লা চাঁদা না পাওয়ায় স্বামীকে আটকে রেখে নববধূকে ধর্ষণ করে। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রলীগ নেতা বদরুল চাপাতি দিয়ে পাশবিকভাবে জখম করে খাদিজা নামের এক ছাত্রীকে। ২০১৫ সালের ২১ মে রাতে কুড়িল থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে আশরাফ খান ওরফে তুষারের নেতৃত্বে ৫ নরপশু এক গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়। এদিকে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ভাষ্যমতে, ২০১৬ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ২৮৬। বছরটিতে ধর্ষণের চেষ্টাসহ মোট ৯১ জন এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৮৭। ২০১৩ সালে ধর্ষণের পর হত্যাসহ সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ১৮৩। ২০১৪ সালে শুধু গণধর্ষণেরই শিকার হয় ২২টি শিশু। সব মিলে সংখ্যাটি ছিল ২২৭।
সংসদে আইন ঠিকই পাশ করা হয়েছে ধর্ষকের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং মৃত্যুদন্ড, কিন্তু কার্যকর করা হয় খুবই কম। আর তাই মানুষরূপী নরপশুগুলো এহেন কুকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। দন্ডবিধির ধারা নং ৩৭৫ এতে ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আর শান্তির কথা দন্ডবিধির ৩৭৬ ধারাতে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ধারাটিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ধর্ষণের অপরাধ করে, তবে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম অথবা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং অর্থ দন্ডে দন্ডিত হবে। আইন থাকার পরও কেন ধর্ষণের বীভৎসতা বেড়েই চলেছে সে বিষয়টি রাষ্ট্রের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ধর্ষণ বৃদ্ধির পেছনে বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ধর্ষণের যে রুট রয়েছে তা আগে বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা আগেও ছিল এবং ভবিষ্যতেও হয়তো তা পুরোপুরি দূর হবে না। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ধর্ষণের ঘটনা কমবে। যেমন- ব্লফিল্ম, পর্ণসাহিত্য, অশ্লীল ম্যাগাজিন, অশ্লীল ছায়াছবি, মাদক, তরুণ-তরুণীদের অল্পবয়সে প্রেমে জড়িয়ে পড়া, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, অশালীন পোশাক, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের নামে অশ্লীলতা, তরুণ-তরুণীদের হোটেলে অবাধ চলাফেলার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার বাড়ানো গেলে ধর্ষণের বীভৎসতা থেকে রেহাই পেতে পারে এদেশের হাজারো নারী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন